মরে যাচ্ছে পদ্মা

কোন মন্তব্য নেই

পদ্মার তলদেশ স্পর্শ করা যেত না। স্রোতের টানে সাঁতার দেয়ার কথা কখনও মনে করতো না। কিন্তু আজ সেই পদ্মায় পানি নেই। পদ্মা এখন ছোট খাল। পানির অভাবে প্রমত্তা পদ্মা মরে গিয়ে ক্রমেই ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে আসছে। জলরাশির পরিবর্তে চারদিকে শুধু ধু-ধু বালুচর। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর পাদদেশেও এখন বিশাল বালুচর জেগে উঠেছে। এই বালুচরেই সবুজ বিপ্লব ঘটানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে কৃষক। খরস্রোতা পদ্মা নদীর এমন করুণ মৃত্যুতে হাহাকার পড়েছে নদী তীরবর্তী মানুষের মনে। গড়াই, হিসনা, কালীগঙ্গা ও মাথাভাঙ্গা নদীগুলো প্রায় পুরোপুরিই শুকিয়ে এখন মৃত অবস্থা।
পদ্মা নদীর পানির প্রবাহ ধরে রাখতে ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেও কোন লাভ হয়নি বাংলাদেশের। চুক্তির ১৮ বছর শুরু হলেও কখনই হিস্যা অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ। অথচ যৌথ নদী কমিশনের ওয়েবসাইটে (িি.িলৎপন.পড়স) চলতি বছরের ১লা জানুয়ারি থেকে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত ১০ চক্রে ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৪৭৯ কিউসেক পানি ভারত সরকার বেশি দিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। অথচ বাস্তব চিত্র উল্টো। পানি নেই পদ্মায়। পানির অভাবেই দিন দিন আরও শুকিয়ে যাচ্ছে পদ্মা নদী। শুষ্ক মওসুমে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগির লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি পানি চুক্তি করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী ১লা জানুয়ারি থেকে ৩০শে মে পর্যন্ত সময়কে শুষ্ক মওসুম হিসেবে অভিহিত করে প্রতিটি মাসকে তিন চক্রে ভাগ করা হয়েছে। কোন চক্রে বাংলাদেশ কি পরিমাণ পানি পাবে তাও চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। ঠিকমতো পানি বণ্টন হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) সদস্যরা বাংলাদেশ-ভারত সফর করেন। যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) সূত্র জানায়, চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সব সময়ই ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শুধু ব্যতিক্রম এ বছর। প্রতি বছর ১লা জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি বণ্টন কার্যক্রম শুরু হয়ে থাকে। উভয় দেশের প্রতিনিধি দল ফারাক্কা পয়েন্টে এবং বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি বণ্টন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পাঁচ মাস অবস্থান করেন। বাংলাদেশ ও ভারতের ৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ টিম কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টের ৮ হাজার ফিট আপে এই পানির পরিমাপ ও পর্যবেক্ষণ ১লা জানুয়ারি থেকে শুরু করেছেন। ভারতের প্রতিনিধি দলে রয়েছেন সে দেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এস কে চতুর্বেদী ও সহকারী প্রকৌশলী জি ভেনু গোপাল এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে রয়েছেন পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগ নির্বাহী প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেন, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রইচ উদ্দিন ও শাখা অফিসার মো. মোফাজ্জল হোসেন।
চুক্তি অনুযায়ী এবার বাংলাদেশ জানুয়ারির প্রথম ১০ দিনের প্রথম চক্রে পেয়েছে ৯১ হাজার ৫শ’ ৮৯ কিউসেক পানি। পানি বন্টন চুক্তির সংলগ্নি ২-এর ইন্ডিকেটিভ অনুযায়ী, বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ৬৭ হাজার ৫১৬ কিউসেক পানি। এ হিসাবে ভারত বাংলাদেশকে প্রথম চক্রেই ২৪ হজার ৭৩ কিউসেক পানি বেশি দিয়েছে। চুক্তির ধারা অনুযায়ী, ফারাক্কা পয়েন্টে ভারতকে ৪০ বছরের গড় পানিপ্রবাহ অর্থ্যাৎ ১ লাখ ৭ হাজার ৫১৬ কিউসেক পানি প্রবাহ নিশ্চিত করার কথা। এবার পানির প্রবাহ বেশিই দেখিয়েছে ভারত। ১১ই জানুয়ারি থেকে ২০শে জানুয়ারি দ্বিতীয়চক্রে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল ৫৭ হাজার ৬শ’ ৭৩ কিউসেক পানি। কিন্তু যৌথ নদী কমিশনের ওয়েব সাইটে দেয়া তথ্যে দেখা গেছে, এ সময় পাওয়া গছে ৭৭ হাজার ৭শ‘ ২১ কিউসেক পানি। চুক্তির থেকেও ২০ হাজার ৪৮ কিউসেক পানি বেশি পাওয়া গেছে। ২১শে জানুয়ারি থেকে ৩১শে জানুয়ারি তৃতীয়চক্রে ৫০ হাজার ১শ’ ৫৪ কিউসেক পানি দেয়ার কথা থাকলেও খাতা কলমে বেশি দিয়েছে ৩৫ হাজার ৬শ’ ১৫ কিউসেক। ফেব্রুয়ারি মাসের ১ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত ৪র্থ চক্রে ৪৬ হাজার ৩শ‘ ২৩ কিউসেকের স্থলে ভারত দিয়েছে ৯০ হাজার ৮শ’ ৬৮ কিউসেক পানি। ৫ম চক্রে ১১-২০ ফেব্রুয়ারি ৩৭ হাজার ৬শ’ ১৯ কিউসেক, ২১-২৮ ফেব্রুয়ারি’র ৬ষ্ঠ চক্রে ৩৮ হাজার ৮শ’ ১০, মার্চ মাসের ১-১০ তারিখের ৭ম চক্রে ৪৩ হাজার ২শ’ ৫৯, ১১ই মার্চ থেকে ২০ মার্চ ৮ম চক্রে ৫২ হাজার ২শ’ ৯২ কিউসেক, ২১ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ ৯ম চক্রে ৩৯ হাজার ৯শ’ ৫৩ কিউসেক এবং ১লা এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ২৭ হাজার ৫শ’ ২৬ কিউসেক পানি বেশি দেয়া হয়েছে বলে যৌথ নদী কমিশনের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। ৫ মাসের মধ্যে ৩ মাসেই ভারত সরকার ৩ লক্ষ ৬৩ হাজার ৪৭৯ কিউসেক পানি বেশি দিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। অথচ বাস্তব চিত্র উল্টো।
বাস্তবে পানি না পেয়ে পদ্মা আজ মরা খালে পরিণত হয়েছে। ফলে চলতি শুষ্ক মওসুমে পদ্মার বুকে দেখা দিয়েছে ধু-ধু বালুচর। এর প্রত্যক্ষ ফল পানির অভাবে দেশের সর্ববৃহৎ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প মারাত্মক হুমকির মুখে। আর পরোক্ষ ফল আরও মারাত্মক। উত্তর-দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় মরুকরণ প্রক্রিয়ায় তীব্রতর হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। অন্যদিকে শুষ্ক মওসুমে পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যায় দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প। প্রকল্পের আওতায় ৪ লাখ ৮৮ হাজার একর জমিতে সেচ সরবরাহ করার কথা থাকলেও পানির অভাবে ১ লাখ ১৬ হাজার একর জমিতে সেচ সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা সহ উত্তর-দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে। পানির অভাবে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১৫টি গার্ডারের মধ্যে অর্ধেকই এখন দাঁড়িয়ে আছে ধু-ধু বালুচরে। পর্যবেক্ষকরা এখন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মা নদীতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। পিকনিক করছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ ব্রিজের পাদদেশে। পর্যবেক্ষণে আসা ঢাকা সরকারি বিজ্ঞান কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী আবদুল্যাহ-আল-রুমন পদ্মা নদী দেখিয়ে আফসোস করে বলেন, এককালের প্রমত্তা পদ্মা আজ মরে গেছে। ফারাক্কার অশুভ প্রভাবেই এমন অবস্থার সৃষ্টি। ১৯১২ সালে যখন এই পদ্মার ওপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল, তখন পানির গতি নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল দুরূহ কাজ। নানা রকম কৌশল নিয়ে পদ্মার বুকে তৈরি হয়েছিল দেশের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে সেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। আর কালের আবহে আজ পানিশূন্য অবস্থায় বালুচরের ওপর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ ব্রিজ।  মানব জমিন এর কাছে থেকে নেওয়া।


আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুণ।

 এই ব্লগে পড়তে কি সমস্যা হয়?আপনার কি টাকা বেশি খরচ হয়ে যায়?

কোন মন্তব্য নেই :