বৃদ্ধ বাবা মায়ের সমস্যা

কোন মন্তব্য নেই



সংকলিত প্রতিবেদন
রিটায়ার্ড বাবা-মা, যাদের অনেকেই আজ নিঃসঙ্গ একা, যাদের সন্তানরা আজ স্বেচ্ছায় বা বাধ্যবাধকতায় বিচ্ছিন্ন, দূরবাসী-তাদের জন্যই এই নিবন্ধ। ব্যাংকে সুদের হার কমছে, দেশ জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা-এরই মধ্যে কি করে ভাসাবেন দিন যাপনের সচ্ছল তরীখানি? যাদের বয়স অল্প, কিন্তু মাথার উপরে আছে অভিভাবকের গুরু দায়িত্ব-তারাই বা কেমন করে পালন করবেন সন্তানের কর্তব্য? আর যে জন আছে মাঝখানে...অর্থাৎ আজ যিনি মধ্যবয়স্ক, কাল যিনি হয়তো হয়ে পড়তে পারেন বিজনবাসী, একা, তিনি? কি করে প্ল্যান করবেন সুখী ভবিষ্যৎ?-সকলের কথা, সব প্রজন্মের কথা ভেবেই এই লেখাটি।
আমাদের সময়, ওদের সময়
বড্ডই বদলে যাচ্ছে সময়টা। পৃথিবীটা বড্ড দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
বড্ড ইনসিকিওরড সবকিছু। যুদ্ধের সম্ভাবনা, দাঙ্গার সম্ভাবনা, জাতপাত রাজনীতির অশান্তি...সব মিলিয়ে গোটা দেশ ভালো নেই।
আজ রিটায়ার করলে কবে থেকে যে হাতে পাবো পেনশনের টাকা...ভাবতে ভাবতে মাথার শেষ কালো চুলগুলো সাদা হয়ে গেল। মেয়ের বিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছি গত বছর। জামাই বড় ভালো, কিন্তু নাসিকে পোস্টেড, মোটে ছুটি পায় না। ফলে দায় দায়িত্ব, ভালো থাকা মন্দ থাকা সবই নিজের ওপর। মেয়ে মাঝে মধ্যেই চিঠিতে বা ফোনে কান্নাকাটি করে, কিন্তু নিরুপায়। সব মিলিয়ে আমরা খুব অশান্তিতেই ছিলাম। সেটা আরও বেড়ে অথৈ জলে পড়ে গেলাম ওর হঠাৎ হার্টএ্যাটাকের পর। হঠাৎই ঘটল ঘটনাটি, ভোর বেলা পার্কে। এখন ওর মাসে দু হাজার টাকার ওষুধ লাগছে। রাতদিনে আয়া লাগছে। ...কি যে করি!
মাকে আজও যে কতটা ভালোবাসি যা বলে বোঝাতে পারব না। বাবা আর মা আজ ১৭ বছর হল সেপারেট, বাবা আবার বিয়েও করেছেন, মা আমার জন্যই একা রয়ে গেছে আজীবন। এখন যা হয়! আমার স্ত্রী আর মা পরসপরকে মোটেই পছন্দ করে না। আমরা আলাদা ফ্ল্যাটে এসেছি সাত মাস। তারপর থেকেই মায়ের শরীর খারাপ, টাকা পয়সাও কমে আসছে দ্রুত। ব্যাংক তো সুদ দেয়াই ছেড়ে দিয়েছে। মা খালি চিন্তা করে, কাঁদে; আমার ভয় করে ভেতরে ভেতরে হার্ট খারাপ হয়ে যাচ্ছে না তো? মায়ের বড় কোনো অসুখ করলে কোথায় নিয়ে যাবো, কোত্থেকে টাকা পাবো?...কি যে করি!
রিটায়ার্ড মা-বাবা, যাদের অনেকেই আজ নিঃসঙ্গ একা, যাদের অনেকেরই সন্তানই প্রবাসী বা অনাবাসী বা স্বেচ্ছায় প্রায় ত্যাগ করেন বাবা-মাকে; অনেকেই চিন্তা করেন-সঞ্চিত টাকা কোথায় রাখবেন, কিভাবে রাখবেন, মেডিকেল ইন্সিওরেন্স নিলে লাভ হয় কি না, হেল্‌থ চেকআপ প্যাকেজ কতটা ইফেক্টিভ-এসব তো আছেই। অনেক দায়িত্ববান সহৃদয় তরুণ-তরুণীরাও ভাবেন। কিন্তু তাদের সমস্যা ঠিক বিপরীত। তারা বাবা-মায়ের বার্ধক্যের বারাণসী হতে চান, পাশে থাকতে চান বড় ছাতা হয়ে, কিন্তু নিজের সন্তান সংসার সামলে কিছুতেই বাবা-মায়ের জন্য, তাদের চিকিৎসা বা সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্থানটুকু করে উঠতে পারছেন না কিছুতেই। কেউ কেউ আবার আর্থিক ভার বহন করেই কর্তব্য সারতে চান, কিন্তু তার ঠিক রাস্তাটা জানেন না। দোষ দেয়া যায় না কাউকেই। আমরা সবাই আপনজনকে ভালোবাসি, আমরাই পরিস্থিতির চাপে নিজেদের দায়-দায়িত্ব, স্নেহ-ভালোবাসাকে অস্বীকার করি বা এড়িয়ে যাই।
কেন এমন হয় বলুন তো? খুব ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলেই বুঝবেন, এর মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত বা জেনারেশন গ্যাপ বা বউমা-শাশুড়ির চিরন্তন দ্বন্দ্ব বিরাট বিরাট ফ্যাক্টর নিশ্চয়ই, কিন্তু সমস্যার শিকড়টা অন্যত্র। রিটায়ার্ড জীবনের অর্থাভাব, স্বাস্থ্যভাব, বিষয়াভাব-অনেকটাই আপনার নিজের দূরদৃষ্টির অভাবে তৈরি হয়েছে। ৫০ বছর হয়ে যাওয়ার পরে যখন হাতে আর মোটে ৮ বছর চাকরি আছে, আপনি অবসর জীবনটা প্ল্যান করতে বসেছেন। বা, আপনি? বাবা-মা বুকের রক্ত তুলে আপনাকে মানুষ করেছেন, ২৪ বছর বয়স থেকে মোটা মাইনের চাকরি করছেন আপনি। ২৬-এ বিয়ে, ২৭-এ বুবুন জন্মাল, কিন্তু কখনও বাবা-মায়ের জন্য একটা ফান্ড তৈরি করার কথা ভাবেননি আপনি। কেন?
আপনাদের সমস্যাগুলোর একটা গড়পড়তা সমাধান দিতেই আমাদের এই প্রকল্পনা। কেবল মনে রাখবেন, শরীর-স্বাস্থ্য বা ফিন্যান্স-বিষয় যাই হোক না কেন, এগুলো পরামর্শ মাত্র। সিদ্ধান্ত যা কিছু আপনাকেই নিতে হবে। আমাদের পরামর্শ একেকটা মডেল, তাকে ব্যবহার করে ঠিক কিভাবে বার্ধক্যের সময়কে সুখে ভরিয়ে তুলবেন, এ প্ল্যানিং প্রতিটি পরিবারের ক্ষেত্রে আলাদা।
আপনার, আমার ও পার্থিবের গল্প
কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না পার্থিব। মাথায় আসছিল না এখন ঠিক কি করা উচিত। অথচ কিছু না করতে পারলে শান্তি পাবে না সে।
পার্থিবের সমস্যা অবশ্য আর পাঁচটা বছর পঁচিশের বাঙালি ছেলের থেকে খুব একটা আলাদা কিছু নয়। একই গতে বাঁধা।
পার্থিবের বাবা সরকারি চাকরিজীবি। বয়স ৫৫ বছর। দেশ ভাগের সময় একবস্ত্রে চলে এসেছিলেন এদেশে মায়ের হাত ধরে। সঙ্গে ভাই। সে সব দিন চলে গেছে। পার্থিব মায়ের মুখে শুনেছে, বাবার বড় হয়ে ওঠার কাহিনী। দিনের বেলা টিউশনির পর টিউশনি, রাতে নাইট কলেজ। এরই মধ্যে মায়ের দেখভাল, ভাইকে পড়াশোনা করানো। সব অন্ধকারের শেষেই জ্বলে আলো। পার্থিবের বাবার বেলাতেও তাইই হয়েছে। ইন্টারভিউয়ের পর ইন্টারভিউ দিয়ে হঠাৎই হাজির এক সরকারি চাকরি।
সেই শুরু। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি পার্থিবের বাবাকে। ছোট ভাইকে পার করিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি। মায়ের কষ্ট লাঘবের জন্য তিন কামরার ফ্ল্যাটও কিনেছেন। শুভ লক্ষ্মীকে ঘরে এনেছেন। বছর দুয়েকের মধ্যে পুঁচকে পার্থিবের আগমন। তারপর সেই পুণরাবৃত্তি। সেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। এসব করতে করতেই যে ত্রিশটি বসন্ত ঝরে গেছে তা বুঝতেই পারেনি পার্থিবের বাবা। হুঁশ হলে দেখেন চুলে পড়েছে রূপালি রেখা। প্রতিবিম্ব জানান দেয় তার বয়স ৫৫। অবসর কড়া নাড়ছে দরজায়। পার্থিবের চিন্তাটা ঠিক এখানেই।
বাবার কোনো সঞ্চয়ই নেই। সারা জীবন সংসারের জোয়াল টেনে আজ তিনি খাদের কিনারে। যত্ত আয় তত্ত ব্যয়, সঙ্গে পরহিতার্থ-নেট ফল, ব্যাংক ব্যালান্স শূন্য। পার্থিব যদি ভবিষ্যতে দূরে চলে যায়, এমনকি পেশাগত টানেও, অকূল পাথারে পড়ে যাবেন বাবা-মা। ৬০ বছর বয়ম হতে না হতেই।
এই ব্যাপারটাই মেনে নিতে পারছে না পার্থিব। যে মানুষটা সর্বস্ব দিয়ে সংারটাকে ধরে রাখল আর তিন বছর পরে পেনশনের সামান্য টাকা ছাড়া রইবে না কিছুই। কিভাবে চলবে তার? পার্থিব ভালোভাবেই জানে, বাবা মরে গেলেও কারও কাছে জানাবেন না তার দুঃখের কাহিনী। তাই বাবার জন্য কিছু করতে হলে তাকেই করতে হবে।
কিন্তু সে কি করবে?
শেয়ারবাজার, বন্ড, মিউচ্যুয়াল ফান্ডা, ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট, পোস্ট অফিসের মাসিক আয় প্রকল্প-কোনো বিষয়েই কোনো জ্ঞান নেই পার্থিবের। পার্থিব জানুক বা না জানুক, লগ্নি বিশেষজ্ঞরা কিন্তু পার্থিবের ব্যাপারে খুব আশাবাদী।
একটি ইনভেস্টটর সার্ভিসেস লিমিটেডে-এর রিজিওনাল ম্যানেজার তথা ভাইস প্রেসিডেন্ট জানাচ্ছেন, ‘ একটা বছর পঁচিশেকের ছেলের সামনে তো গোটা জীবনটা পড়ে রয়েছে। তার চাকরি সবে শুরু হয়েছে। অথচ দায়দায়িত্বও কিছুই নেই প্রায়। বাবা একটা চাকরি করছেন। সুতরাং সংসারও তাকে টানতে হচ্ছে না। সে এখনও বিয়েও করেনি। ফলে সাংসারিক অন্য দায়িত্বও তার কাঁধে চাপেনি। ফলে আর্থিক দিক থেকে সুরক্ষা পাওয়ার এটা হল ‘ড্রিম এজ’।
একটি সিকিউরিটিস কোম্পানির ডিরেক্টরের ভাষায়-‘জানি কষ্ট হবে। কারণ এই বয়সটা ওসব সঞ্চয়-টঞ্চয়ের ভাবে না। জীবনে তখন ভোগের জন্য থরে থরে সাজানো রয়েছে নানা সামগ্রী। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভাবলে, একটু কষ্ট হলেও এটা করতে হবে এই ২৫ বছরের ছেলেটিকে। দরকার হলে একবার রেস্তরাঁয় যাওয়া কমাতে হবে, কমানো যেতে পারে এন্টারটেনমেন্টও’।
ডিরেক্টর সাহেবের ভাষায় ‘এই বয়সে সঞ্চয় শুরু করলে তার লাভ অনেকগুলো। প্রথমত সঞ্চয় একটা অভ্যাস। একদিনে সেটা গড়ে ওঠে না। এটা অনেক দিনের অভ্যাসের ফল। আর এটা তো সবারই জানা, সঞ্চয় হিসেবে আজ যেটা দেখাচ্ছে, কয়েক বছরের দিকে তাকালে সেটাই হয়ে দাঁড়াবে ভবিষ্যতের পুঁজি।
দ্বিতীয় এই বয়সে যাই লগ্নি করা হোক না কেন, বয়স কম বলে কম অর্থতেও তা করা সম্ভব। বয়স বেশি হয়ে গেলে জীবন বিমার প্রিমিয়াম থেকে শুরু করে সব কিছুরই প্রিমিয়াম বেশি হয়ে যাবে।
তৃতীয়ত ঝুঁকি যদি নিতেই হয়, তবে এটাই তো বয়স। কোনো ঝুটঝামেলা নেই, একবারে যাকে বলে ঝাড়া হাত পা। ফলে এই বয়সে যদি কেউ নিজের জন্য, নিজের প্রিয়জনের কথা ভাবে তবে তো তার কোনো তুলনাই নেই’।
এ তো গেল পার্থিব কাহিনী। তার বাবার কি হবে? ৫৫ বছর বয়সে এসে ব্যাংক ব্যালান্স শূন্য, এ অবস্থায় তিনি কি করবেন? সরকারি চাকরি, অবসরকালে মাসে ক‘টাকাই বা তিনি পাবেন পেনশন হিসেবে। ভরসার কথা একটাই গ্রাচুইটি-সব মিলিয়ে লাখ দশেক মতো টাকা তিনি পাবেন অফিস থেকে। এখন প্রশ্ন হল কিভাবে এই টাকা দিয়ে সংসার চালাবেন তিনি, কিভাবেই বা প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে নিজেকে, স্ত্রীকে রক্ষা করবেন?
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এই অবস্থায় একদম হতাশ নন। তবে একযোগে তাদের বক্তব্য, আর দেরি করবেন না। এখনও অবসর নেয়ার আগে তিন বছর বাকি। এই তিন বছরটাকে ভালো মত ব্যবহার করে নিন। আর খুব সাবধানে বিচক্ষণতার সঙ্গে অবসরের পর যে অর্থ হাতে পাবেন তা লগ্নি করুন।
বার্ধক্য কাকে বলে?
‘এজিং’ বা বৃদ্ধ হওয়া একটি সারা পৃথিবীব্যাপী ব্যতিক্রমহীন পদ্ধতি। কিছুদিন আগে অবধিও মনে করা হত, ‘বার্ধক্য একটি চিকিৎসার অসাধ্য অসুখ’, কিন্তু এখনকার আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, যেখানে মেডিসিন এত উন্নত, সেখানে You dont heal old age, you protect it, you promote it, you extend it. বাধ্যক্য এক স্বাভাবিক, অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া। বৃদ্ধ বয়সজনিত শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন সম্পর্কিত পড়াশোনা ও জ্ঞানকে বলে জেরনটোলজি। বৃদ্ধ বয়সে যে অতিরিক্ত সাবধানতা ও যত্ন দরকার তাকে বলে জিরিয়াট্রিক। ক্রমশ পৃথিবীতে বৃদ্ধ নরনারীর সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে বুড়ো বয়সেও যাতে সুস্থ সুন্দর জীবন-যাপন করা যায় সে সম্পর্কে সচেতনতাও। জিরিয়াট্রিক গায়ানোকোলজি সম্পর্কেও প্রচুর গবেষণা চলছে। এখন অনেক বেশি সংখ্যায় পরিণত বয়সের মহিলারা ডাক্তারের কাছে আসেন- মেনোপজের পর কি করা উচিত, প্রোল্যাপ্স বা জরায়ু নিচের দিকে নেমে এলে কি চিকিৎসা করা যায়, বৃদ্ধ বয়সের স্বামী-স্ত্রীর দৈহিক সম্পর্ক কেমন হবে এইসব তথ্য জানতে ও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে। আগের দিনের বয়স্করা এইসব সমস্যা চেপে রেখেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতেন।
সমস্যার গুরুত্ব
গত কয়েক দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং অপেক্ষাকৃত উন্নত সামাজিক পরিবেশ মানুষের গড় আয়ু কিছু বাড়িয়ে দিয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে আজকাল বেশিরভাগ মানুষই ৭০ বছর বা তার বেশি বাঁচে। ইংল্যান্ডে ১২ শতাংশ মানুষের বয়স ৬৫ বছরের ওপর, আমাদের দেশে সেই তুলনায় অনেক কম। উন্নত দেশগুলোতে চিকিৎসা ও সমাজব্যবস্থা এখন এত আধুনিক যে মানুষের বেশি বয়স অবধি বাঁচার হার সেখানে ক্রমবর্ধমান।
বয়স্কদের স্বাস্থ্য সমস্যা
কেবলমাত্র বয়সের ভারে যেসব সমস্যা হয়
ঠিক কখন বার্ধক্যের শুরু তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না। কোনো মানুষের বায়োলজিক্যাল এজ বা জীব বিজ্ঞান অনুযায়ী বয়স এবং ক্রনোলজিক্যাল এজ বা পঞ্জিকা অনুযায়ী হিসাব করা বয়স অভিন্ন নাও হতে পারে। একটা বেশি বয়স অবধি বাঁচলেই কেউ বুড়ো হয়ে যায় না। অতিবাহিত সময় ত্বকে বলিরেখা ফেলে, কিন্তু সংশয়, সন্দেহ, দুশ্চিন্তা, ভয়, টেনশন, অবিশ্বাস মনকে কলুষিত করে।
শুধুমাত্র বয়স বাড়লেই বার্ধক্য আসবে এ কথা ঠিক নয়, আধুনিক যুগের জীবনের অস্বাভাবিক চাপ মানুষকে প্রায় বার্ধক্য বা সিনেসনস-এর দিকে ঠেলে দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ভেতরের কলকব্জাগুলোতে কিছু পরিবর্তন হবেই। সেই কারণে বৃদ্ধ বয়সে ছানি, গ্লুকোমা, কানে কম শোনা, বাত, মানসিক পরিবর্তন, সূক্ষবোধের অভাব ইত্যাদি অসুবিধা দেখা দিতে পারে।
দীর্ঘস্থায়ী অসুখ সংক্রান্ত সমস্যা
কিছু কিছু ক্রনিক অসুখ থাকে যেগুলো অপেক্ষাকৃত বেশি বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায় যেমন-
হার্ট ও শিরার অসুখঃ চল্লিশ বছর বয়সের পর থেকে রক্তবাহী নালীর ভেতরের দিকের অংশ নষ্ট হতে শুরু করে এবং সেখানে লাইপয়েড জাতীয় এক রকম পদার্থ জমা হতে থাকে। পরে এগুলো ক্যালসিয়ামের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয় এবং তার ফলে রক্তবাহী নালীগুলো সরু হয়ে পড়ে। এই কারণে রক্ত সরবরাহ কমে গিয়ে শিরা ছিড়ে যেতে পারে, রক্তচাপও বৃদ্ধি পেতে পারে। এর বিশেষ কোনো একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না, খাদ্যাভ্যাস, বংশগত কারণ, বেশি ওজন, অত্যধিক স্নায়বিক ও মানসিক চাপ সবই একসঙ্গে কারণ হিসেবে জড়িয়ে থাকতে পারে।
ক্যান্সারঃ মধ্যবয়সের পর ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা বেশি। উন্নত দেশগুলোতে ক্যান্সার বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ।
পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, চল্লিশ বছর বয়সের পর ক্যান্সারের আক্রমণ অল্প বয়সের থেকে অনেক বেশি।
পুরুষদের প্রস্টেট গ্রন্থির ক্যান্সার হয় সাধারণত পঁয়ষট্টি বছরের পর
দুর্ঘটনা
এ্যাক্সিডেন্ট অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের একটি বড় স্বাস্থ্যসমস্যা। বয়স্কদের শরীরের হাড়ে ক্যালসিয়াম কমে যাওয়ার কারণে সহজেই ভঙ্গুর হয়ে যায়, অল্প আঘাতে তা ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাব থাকে। পড়ে গিয়ে হাড় ভাঙার ঘটনা বাড়িতেই বেশি ঘটে, রাস্তাঘাটে কম। কোমরের হাড়ভাঙ্গা বা ফ্র্যাকচার নেক ফিমার বৃদ্ধ বয়সের একটি খুব সাধারণ ঘটনা।
ডায়াবেটিস মেলাইটাস
বৃদ্ধবয়সে ডায়াবেটিস বেশি হতে দেখা যায় তার কারণ এই বয়সের ত্রুটিপূর্ণ বিপাকীয় ক্রিয়া ডায়াবেটিসে অনেক বৃদ্ধবৃদ্ধা মারা যায়। আমাদের দেশের অন্তত ৭৫ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর বয়স ৫০ বছরের ওপর।
বাত
বিভিন্ন ধরনের বাত যেমন ফাইব্রোসাইটিস, মাইওসাইটিস, নিউরাইটিস, গাউট, রিউম্যাটয়েড আথ্রাইটিস, অস্টিও আরথ্রাইটিস, সপনডাইলোসিস সাধারণত একটু বেশি বয়সেরই রোগ। এই ধরনের অসুখ বার্ধক্যের সবচেয়ে বেশি কষ্টদায়ক, স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে একেবারে ব্যাহত করে দেয়।
শ্বাসতন্ত্রের ও ইউরিনারি সিসটেমের অসুখ
বেশি বয়সে এ্যাজমা, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইসিমা ইত্যাদি অসুখ বেশি হয় এবং যাদের আগে থেকেই এই ধরনের কোনো একটি রোগ আছে, বয়স হলে সেই রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া প্রস্টেট এনলার্জমেন্ট, ইউরিনের নানা অসুখ; যেমন ইউরিন চেপে রাখতে না পারা, বারে বারে বাথরুমে যাওয়া, রাতে বেশিবার প্রস্রাব পাওয়া, ইউরিন কমে যাওয়া এগুলোও বার্ধক্যে বেশি দেখা যায়।
মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা
মানসিক পরিবর্তন-যেমন দুর্বল স্মৃতিশক্তি, অনমনীয় ও কঠোর নিয়মানুবর্তিতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, কোনো ধরনের কোনো পরিবর্তনে অনীহা-এই জাতীয় ধ্যানধারণা দেখা দেয় বার্ধক্যে। অবসর গ্রহণের পর আয়ও কমে যায়, তাতে প্রাত্যহিক জীবন যাত্রার মান খানিকটা পড়ে যেতে বাধ্য, সেই কারণে মানসিক ও সামাজিক বদল ও তার নির্দিষ্ট পরিণতি অবশ্যম্ভাবী।
সেক্সুয়াল এ্যাডজাস্টমেন্ট
৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে মহিলাদের প্রজননক্ষমতা একেবারেই কমে যায় এবং পুরুষদের মিলনের ইচ্ছাও অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় হ্রাস পাচ্ছে। এই সময়ে আবেগ সংক্রান্ত মানসিক চাঞ্চল্য ঘটা সম্ভব। তার সঙ্গে শারীরিক অসুবিধাও থাকতে পারে। এর সঙ্গেই দেখা দিতে পারে বিরক্তিবোধ বা ইরিটেবিলিটি, ঈর্ষাপরায়ণতা, অত্যন্ত বেশি নির্ভরশীলতা বা অসহায়তা। এই ধরনের মনোভাব দমন করা শক্ত হয়ে পড়ে।
আবেগজনিত অসুবিধা
সহজেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া এই বয়সে এক বিশেষ সমস্যা। এর কারণ আর কিছুই না, সমাজের সঙ্গে সমন্বয়তার অভাব। বয়স হয়ে যাচ্ছে এটা মন থেকে মেনে নেয়া খুবই শক্ত ব্যাপার। সর্বদা মনে এই পাষাণভার থাকলে জীবনে আর কোনো আনন্দ থাকে না, সাধ আহ্লাদও চলে যায়। ক্রমশ তিক্ততা ও অবসাদ এসে গ্রাস করে,  আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যেতে পারে।
কি কি পরিষেবার ওপর জোর দেয়া যেতে পারে
নিরাপদ বাসস্থান
ক্লাব হোস্টেল বা হোমের ব্যবস্থা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সাবধানে চলাফেরা করা, ওজন কমানো, কোনো অসুখ থাকলে তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা। পেনশন নেয়ার সুবিধা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পৌঁছান, সামান্য কিছু অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা করা, অবসর যাপনের জন্য লেখা, ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ানো বা সই করতে শেখানো, বাড়ির কাছাকাছি একটু হেঁটে বেড়ানো, টিভি দেখা, মাঝে মাঝে তাস বা দাবা খেলা, বই পড়া, নিজের জিনিসপত্র সাধ্যমত গুছিয়ে রাখা, কাগজ পড়া, ক্রসওয়ার্ড সলভ করা, যারা গান করতেন বা বাজনা বাজাতেন তার অল্পস্বল্প চর্চা রাখা-এইগুলোর ওপর জোর দেয়া দরকার। এ জন্য ছেলেমেয়ে বা পরিবারের কমবয়সীরা যা যা করতে পারেন-
  • বাবা-মাকে যতদূর সম্ভব সময় দিন। তাদের পারিবারিক কাঠামো যতদূর সম্ভব বজায় রাখুন।
  • নাতি-নাতনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে দিন।
  • ছোটখাটো বাড়ির কাজ, যেমন হাল্কা বাজার করা, ব্যাংক থেকে টাকা তোলা, হাল্কা বাগান করা, শরীরে কষ্ট না হলে অবশ্যই করতে দিন।
  • মাঝে মাঝে হাওয়া বদলের সুযোগ করে দিন। স্থান পরিবর্তনে মন-মেজাজ সুস্থির হয়।
  • নিয়মিত চেকআপ করানোটা খুবই জরুরি। অনেক ক্ষেত্রেই বড় অসুস্থতার মূল কারণ দুটি। এক, চেক আপের অভাবে ছোটখাটো অসুস্থতা বড় আকার নেয়, ভোগান্তি বাড়ে, খরচও বাড়ে। দ্বিতীয়ত, বয়স হলে খাওয়ার লোভ বাড়ে। কোনো মতেই নোলাকে প্রশ্রয় দেবেন না।
 বিষয়ঃ মনোজগত

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুণ। এই ব্লগে পড়তে কি সমস্যা হয়?আপনার কি টাকা বেশি খরচ হয়ে যায়?

কোন মন্তব্য নেই :