স্ত্রীরোগে বেলুন থেরাপি

কোন মন্তব্য নেই

বিদেশি পত্রিকা অবলম্বনে
আপনার বয়স পঁয়ত্রিশ বা তারও বেশি? মাত্রাছাড়ানো ব্লিডিং-এর সমস্যায় আপনি বিধ্বস্ত? আলট্রাসাউন্ড বা অন্য পরীক্ষা করে জরায়ুতে কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি আপনার? ব্লিডিংকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আপনার গায়নোকোলজিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী হরমোন ট্যাবলেট খেতে খেতে আপনি ক্লান্ত? প্রায়ই মনে হয় এই আপদ চুকে গেলে বেঁচে যান? জরায়ুর বেলুন থেরাপি হতে পারে আপনার মুশকিল আসান।
নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে আবিষ্কৃত ইউটেরাইন বেলুন থেরাপি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, কানাডা, হংকং, সিঙ্গাপুর, চিন, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড ও আরও কিছু দেশে গত এক দশকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর গবেষণা হয়েছে অনেক। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও কিছু রোগিনীর ওপর বেলুন থেরাপির ফলাফল নিয়ে বিজ্ঞানসমমত কাজকর্ম হয়েছে চেন্নাইয়ের সুরিয়া হাসপাতাল আর গুজরাটের নাদকার্নি হাসপাতালে। এই মুহূর্তে ‘থার্মাল বেলুন থেরাপি’ দিয়ে সারা বিশ্বে চিকিৎসা করানো মহিলার সংখ্য এক লক্ষেরও বেশি। চেন্নাই আর গুজরাটের পর ২০০১ সালে জরায়ুর বেলুন চিকিৎসা চালু হয়েছে ডিব্রুগড়, গৌহাটির পাশাপাশি অন্য রাজ্যেও।
বেলুন থেরাপির সাহায্যে জরায়ুর ভেতরকার এন্ডোমেট্রিয়ামের আবরণীকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায়, নির্দিষ্ট সময় জুড়ে উত্তপ্ত করার ব্যবস্থা থাকে। খুব বেশি তাপ প্রয়োগ করায় জরায়ুর ভেতর দিকের ‘এন্ডোমেট্রিয়াল লাইনিং’ পুরোপুরি বা আংশিকভাবে নষ্ট হয়ে যায়। জরায়ুর যে কোনো ব্লিডিং-এর জন্য দায়ী এন্ডোমেট্রিয়াম আংশিক বা সামগ্রিকভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ব্লিডিং উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে বা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। একটা বয়সে জরায়ুঘটিত অতিরিক্ত ব্লিডিংয়ে একটানা ভুগতে থাকা রোগিনীদের জন্য জরায়ুর বেলুন থেরাপি শতকরা তিরানব্বই শতাংশের বেলায় মূল সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে বলে জানা গেছে। জরায়ু কেটে বাদ দেয়ার অস্ত্রোপচারের তুলনায় বেলুন থেরাপি অনেক সহজ ব্যবস্থা, এর ঝাক্কিও অনেক কম।
বেলুন থেরাপি যাদের জন্য
  • যারা পঁয়ত্রিশ বছর পার করে মেনোপজের আগে নিয়মিত বা অনিয়মিত মাত্রাছাড়ানো ব্লিডিং-এর সমস্যায় ভুগছেন।
  • যারা আর বাচ্চা চাইছেন না।
  • যাদের জরায়ুতে কোনো টিউমার (ফাইব্রয়েড) বা পলিপ নেই।
  • যারা জরায়ু বা জরায়ু মুখের ক্যান্সার (কারসিনোমা এন্ডোমেট্রিয়াম ও কারসিনোমা সারভিক্স) আক্রান্ত নন।
  • যাদের জরায়ুর ভেতরকার গহ্বর বা ক্যাভিটির স্বাভাবিক আকৃতি অটুট রয়েছে।
  • আগে ট্রান্সম্যুরাল মায়োমেকটমি বা ক্লাসিক্যাল সিজারিয়ান সেকশন (এ রকম সিজার বহুকাল আগে করা হত)-এর মতো জরায়ুর অস্ত্রোপচার হয়নি যাদের।
  • যাদের ল্যাটেক্স এলার্জি নেই।
বেলুন থেরাপির ব্যবস্থা থার্মাচয়েস
এরকম চিকিৎসা ব্যবস্থা বা থেরাপি সিস্টেমে থাকে দুটো অংশ। এক, কন্ট্রোলার-এ হল কম্পিউটার সমন্বিত অত্যাধুনিক এক যন্ত্র; দুই, বেলুন ক্যাথেটার-সরু লম্বা প্লাস্টিকের ক্যাথেটারের মাথায় লাগানো বিশেষ ধরনের তাপসহ ল্যাটেক্স দিয়ে তৈরি ছোট একটা বেলুন।
কন্ট্রোলার যন্ত্রের সঙ্গে বেলুন ক্যাথেটার জুড়ে দেয়া থাকে একটা সরু আর একটা মোটা নল দিয়ে। সরু নল বেলুনের ভেতরকার চাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। মোটা নল বা আমবিলিকাল কেবল দিয়ে বেলুনের ভেতরে থাকা বিশেষ এক হিটিং সিস্টেম বা উত্তাপ তৈরির ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে তোলা যায়। এরকম হিটিং সিস্টেম হল জরায়ুর বেলুন থেরাপির মূল ব্যবস্থা যা উত্তপ্ত বেলুনকে দিয়ে চিকিৎসার মূল কাজটুকু করিয়ে নেয়। কন্ট্রোলার যন্ত্রের গায়ে থাকা পরপর তিনটি ‘মনিটর’ প্রত্যেক পর্যায়ের চিকিৎসার সময়, বেলুনের ভেতরকার চাপ আর বেলুনের ভেতরকার তাপমাত্রা জানিয়ে দিতে থাকে সেকেন্ডে সেকেন্ডে। একেবারে ডান দিকের বড় মনিটর চিকিৎসা চলার সময় স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞকে নানা প্রয়োজনীয় তথ্য ও নির্দেশ দিয়ে সাহায্য করে।
যা করা হয়
প্রথমে খানিকটা জীবাণুমুক্ত তরল (৫ শতাংশ ডেক্সট্রোজ দ্রবণ) সিরিঞ্জের ভেতর দিয়ে বিশেষ এক পদ্ধতিতে বেলুনের মধ্যে ভরে আবার বের করে আনা হয়। এভাবে বেলুনের ভেতরকার চাপকে কমিয়ে আনা হয় একটা মাত্রা পর্যন্ত (-১৬০ মিমি পারদস্তম্ভের সমান)। এবার নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বেলুন ক্যাথেটারকে ঢুকিয়ে দেয়া হয় জরায়ুর মধ্যে।
সিরিঞ্জের তরল আবার বেলুনে ঢুকিয়ে বেলুনের মধ্যের চাপকে বাড়ানো হতে থাকে ধীরগতিতে, বিশেষ পদ্ধতি মেনে। চাপ বাড়তে থাকায় ফুলতে থাকা বেলুন আস্তে আস্তে জরায়ুর গহ্বরের আকৃতি পেতে শুরু করে। বেলুন গহ্বরে চেপে বসার সঙ্গে সঙ্গে চাপ দিতে শুরু করে এন্ডোমেট্রিয়ামের প্রতিটি বিন্দুতে।
এভাবে বাড়তে বাড়তে বেলুনের ভেতরকার চাপ নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছে গেলে কন্ট্রোলারের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় গরম হতে শুরু করে বেলুনের মধ্যকার হিটিং সিস্টেম। এভাবে বেলুনের ভেতরকার তরলের তাপমাত্রা ১৮১ ডিগ্রী ফারেনহাইটে পৌঁছে গেলে চালু হয়ে যায় চিকিৎসা শুরু হওয়ার স্বয়ংক্রিয় ‘টাইমার’। ওই তাপমাত্রায় বেলুনকে এন্ডোমেট্রিয়ামের সংসপর্শে রাখা হয় আট মিনিট সময় ধরে। ওই সময়টুকু পেরিয়ে যাওয়া মাত্রা শেষ হয়ে যায় চিকিৎসার মূল কাজ। এবার বেলুনের ভেতরকার চাপকে আগের মতো কমিয়ে এনে তরলের তাপমাত্রাকে কিছুটা কমতে দিয়ে (৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) চুপসে যাওয়া বেলুনসহ বেলুন ক্যাথেটারকে বের করে আনা হয় জরায়ুর ভেতর থেকে।
বেলুন থেরাপির পরে
বেলুনের ভেতর উচ্চতাপে ফুটতে থাকা তরল এন্ডোমেট্রিয়ামকে আংশিক বা পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়। তাপে পুড়ে যাওয়া এন্ডোমেট্রিয়াম প্রথম সাত থেকে দশদিন সাদাস্রাব হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে। থেরাপির পর প্রথম সাতদিন রোগিনীকে বিশেষজ্ঞের পরামর্শমত নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিক খেয়ে যেতে হয়। প্রথম ঋতুস্রাব শুরু হয় কমবেশি একমাসের মাথায়। এই পিরিয়ডের ব্লিডিং পরিমাণে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হবে। পরের মাসে দ্বিতীয় পিরিয়ডের ব্লিডিং বেশি হলে বুঝতে হবে ঋতুস্রাব পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে কয়েক মাসের ভেতর।
দ্বিতীয় পিরিয়ডের ব্লিডিং বেশি না হলে বেশিরভাগ সময় পরে প্রত্যেক সাইকেলে আগের চেয়ে অনেক কম বা খুব সামান্য ব্লিডিং হতে পারে।
বেলুন থেরাপির আগে
থেরাপির আগে দেখে নিতে হবে-
  • অতিরিক্ত ব্লিডিং জরায়ুর কোনো টিউমার বা পলিপের জন্য হচ্ছে না।
  • জরায়ুর মধ্যে বা জরায়ুর মুখে কোনো ক্যান্সার বা ক্যান্সার পূর্ববর্তী অবস্থা তৈরি হয়নি। রোগিনী এইচআইভি সংক্রমণে আক্রান্ত নন।
  • জরায়ুতে জন্মগত কোনো ত্রুটি নেই, নেই জরায়ুর পেশির কোনো ধরনের দুর্বলতা।
এসব তথ্য জানার পর বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে জরায়ুর আলট্রাসনোগ্রাফি, হিস্টেরোগ্রাম, ডি সি, এন্ডোমেট্রিয়াল বায়োপ্সি, ট্রান্সভ্যাজাইনাল সোনোগ্রাফি ও অন্য কিছু পরীক্ষা করাতে হতে পারে।
বেলুন থেরাপি যাদের জন্য নয়
  • যিনি গর্ভবতী, ভবিষ্যতে আবার মা হতে চান
  • যাদের জরায়ুর পেশিতে কোনো দুর্বল জায়গা রয়েছে।
  • যারা জরায়ু বা জরায়ু মুখের ক্যান্সার বা ক্যান্সার-পূর্ববর্তী অবস্থায় আক্রান্ত।
  • থেরাপির ঠিক আগে যারা মূত্রথলি, জরায়ুর মুখ, যোনি, ডিম্বনালী বা এন্ডোমেট্রিয়ামের ইনফেকশনে ভুগছেন।
  • ল্যাটেক্স (কনডম ও ল্যাটেক্স দিয়ে তৈরি) এতে এলার্জি রয়েছে যাদের।
অ্যানেসথেসিয়া
লোকাল বা জেনারেল দু রকম অ্যানেসথেসিয়া দিয়েই বেলুন থেরাপি করা যায়। থেরাপির আগে ও পরে নির্দিষ্ট ইনজেকশন দিতে হয়। লোকাল বা জেনারেল যে আবেদনেই থেরাপি হোক, রোগী ৪-৬ ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে বা একটা দিন ক্লিনিকে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন।
বেলুন থেরাপির প্রতিক্রিয়া
সঠিকভাবে নির্বাচিত মহিলাদের জন্য ইউবিটি যথেষ্ট কার্যকরী ও নিরাপদ পদ্ধতি। থেরাপি চলাকালীন জটিলতা হয় না বললেই চলে। থেরাপির পরবর্তী পর্যায়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে শতকরা মাত্র তিনজনের বেলায়। ৯২ শতাংশ ক্ষেত্রে থেরাপির পর প্রথম এক থেকে দু দিন কোমর ও তলপেটে ব্যথা হতে পারে। নির্দিষ্ট ওষুধ ব্যবহারে ব্যথা কমে যায়। ২৪ শতাংশ ক্ষেত্রে গা গোলানো ও বমির সমস্যা ওষুধে কমে যায়। ২ শতাংশ ক্ষেত্রে এন্ডোমেট্রিয়ামে সংক্রমণ (এন্ডোমেট্রাইটিস) হতে পারে। এই থেরাপির পর নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে সমস্যা মিটে যায়।
জ্বর, তলপেটে তীব্র ব্যথা, মলমূত্র ত্যাগের সময় তীব্র যন্ত্রণা, রক্তমূত্র (হিমাচুরিয়া) বা জরায়ুর মধ্যে রক্ত জমে যাওয়া (হিমাটোমেট্রা)-র মতো জটিলতা আসতে পারে খুব সামান্য কয়েকজনের বেলায়। বেশিরভাগ সময় সাধারণ চিকিৎসায় এরকম জটিলতা কমে যায়।
বেশি কার্যকারিতা, বেশি নিরাপত্তা
এর জন্য দরকার বেলুন থেরাপির আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা ঠিকমতো করিয়ে থেরাপির পক্ষে উপযুক্ত কি না তা জেনে বুঝে তারপর বেলুন থেরাপি করানো। বেলুন থেরাপির ব্যাপারে দক্ষ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের হাতে এরকম সহজসরল চিকিৎসা নিরাপদ।
বিশেষ কিছু তথ্য
  • বিশেষ পদ্ধতিতে বেছে নেয়া রোগিনীদের জন্য ইউবিটি শতকরা ৯৩ জনের ব্লিডিং বন্ধ করে দিতে বা কমিয়ে আনতে পারে। তিন বছর ধরে চালানো বিদেশের এক সমীক্ষায় থেরাপি করানো মহিলাদের ২৩ শতাংশের ব্লিডিং পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ১৬ শতাংশ ফিরে এসেছেন স্বাভাবিক ব্লিডিং-এ, ৩৫ শতাংশ স্বাভাবিকের চেয়ে কম ব্লিডিং-এ। ১৭ শতাংশ মাসে মাসে খুব সামান্য ব্লিডিং অনুভব করছেন।
  • অতিরিক্ত ব্লিডিংয়ের সমস্যায় বেলুন থেরাপি করানো মহিলাদের বেশিরভাগের শুধু ব্লিডিং-এর সমস্যা কমে না, জীবনের মানও স্বাভাবিক হয়ে আসে। কমে আসে এই সংক্রান্ত মানসিক চাপ, টেনশন।
  • থেরাপি করানোর পর যৌনজীবন স্বাভাবিক থাকে। বেলুন থেরাপি কোনোভাবেই মেনোপজ ডেকে আনে না। দেখা দেয় না হট ফ্লাশ বা মেনোপজের অন্য কোনো উপসর্গ।
  • থেরাপির পর প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী কন্ট্রাসেপশনের ব্যবস্থা নিতে হয়। থেরাপির পরে গর্ভবতী হয়ে পড়লে গর্ভপাত করানো আবশ্যিক, জরুরি।
  • বেলুন-থেরাপি সবচেয়ে ভাল কাজ দেয় জরায়ুতে কোনো টিউমার, পলিপ বা অন্য কোনো সমস্যা নেই অথচ মাত্রা ছাড়ানো ব্লিডিং হচ্ছে, এমন ‘ডিফাংশনাল ইউটেরাইন ব্লিডিং’-এ ভুগতে থাকা মহিলাদের সমস্যায়। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় সঠিকভাবে নির্বাচিত মহিলাদের ব্লিডিং সংক্রান্ত সমস্যায় ইউটেরাইন বেলুন থেরাপি অদূর ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে চলেছে সহজসরল, নিরাপদ ও কার্যকর এক জনপ্রিয় চিকিৎসা ব্যবস্থা।


বিষয়ঃ  সেক্স গাইড  


আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুণ। এই ব্লগে পড়তে কি সমস্যা হয়?আপনার কি টাকা বেশি খরচ হয়ে যায়?

কোন মন্তব্য নেই :