পরকাল ভাবনা (পর্ব :১) →পাতা ৪←

কোন মন্তব্য নেই
দুই. মৃত্যু-পরবর্তী-জীবন আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে। আজকের পৃথিবীকে তো সবাই স্পর্শ করছে, চোখে দেখছে। কিন্তু পরবর্তী জগতকে কেউ কখনো দেখেনি। এজন্য আমাদের বিশ্বাস হতে চায় না, এ জীবনেরপর অন্য আরো-একটি জীবন রয়েছে,যে জীবন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখা সবারই কর্তব্য। তাহলে আসুন পরকালীন জীবন সম্পর্কে কিছু আলোচনা করে দেখা যাক। আমার যখন মৃত্যু হবে, নিশ্চিহ্ন হবে আমার শরীর মৃত্তিকাগর্ভে অথবা অন্য কোথাও এরপর আবারও কী ফিরে আসবে আমাতে জীবন স্পন্ধন? এ-প্রশ্নটি এভাবে নির্দিষ্ট করে হয়তো খুব কম মানুষই নিজেকে করে থাকে। মৃত্যুর পর এক নতুন জীবনের মুখোমুখী হতে হবে এ কথায় যারা বিশ্বাস করে তাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় এ-বিশ্বাসটি অবচেতন অবস্থায় পড়ে থাকে। যে-ব্যক্তি পরবর্তী জীবন সম্পর্কে উদাসীন, উৎকন্ঠিত নয়, সে তার আচরণে এ-কথাই প্রমাণ করে যাচ্ছে যে সে পরকাল বিষয়ে সন্দিহান। তবে ঐকান্তিকভাবে ভেবে দেখলে অত্যন্ত সহজেই এ-বষয়টির নিগূঢ় বাস্তবতা আবিষ্কার সম্ভব হয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যদিও পরজগতকে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে রেখেছেন, কিন্তু তিনি সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এমনসব নিদর্শন ছড়িয়ে দিয়েছেন যাতে ভেবে দেখলে পরকালীন সকল বাস্তবতা আমাদের বুঝতে সহজ হয়। উন্মুক্ত হয়ে যায় অনেক কিছুই। আসলে এ-মহাবিশ্ব একটি বিশাল দর্পণ যাতে প্রতিবিম্বিত হয়েছে পরবর্তী জগতের আকৃতি-প্রকৃতি। জন্মের দিন আমার শরীরের যে অবস্থা-আয়তন ছিল, বর্তমানে তা বহু পরিবর্তিত হয়ে শক্ত সুঠাম হয়েছে, দৈর্ঘে-প্রস্থে বেড়েছে। আসলে মানুষের শুরু অতি-সামান্য এক পদার্থ থেকে যা মাতৃগর্ভে বড় হয়ে মানুষের আকৃতি ধারণ করে। মাতৃগর্ভের বাইরে এসে পরিপক্কতা অর্জন করে শক্ত সবলব্যক্তিতে পরিণত হয়। খালি চোখে দেখা যায় না এমন একটি সামান্য পদার্থ থেকে বেড়ে ছ’ফুট লম্বা মানুষে পরিণত হওয়া এমন একটি ঘটনা যা প্রতিদিনই এ-পৃথিবীতে ঘটছে। আমাদের শরীরের অংশসমূহ যা অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরমাণুর আকারে ভূ-গর্ভে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে তা পুূনর্বার মানুষের আকৃতি ধারণ করতে-পারাটা বুঝে না আসার মতো কোনো বিষয় নয়। এ-পৃথিবীতে চলমান প্রতিটি মানুষই মূলতঃ অসংখ্য পরমাণুর সমন্বয় যা একিভূত হয়ে মানুষের রূপ পরিগ্র করার পূর্বে জমিন ও বায়ুমন্ডলের বিশালতায় ছড়িয়ে থাকে বিক্ষিপ্ত আকারে, যা ঐশী প্রক্রিয়ায় পরিণত হয় মানুষের শরীরের অংশে। আমাদের মৃত্যুর পর শরীরের পরমাণুসমূহ বাতাসে-জমিনে ছড়িয়ে পড়ে। আবার যখনস্রষ্টার ইচ্ছা হবে একিভূত হবে যেমনটি হয়েছিল প্রথমবার।প্রথমে একবার যে ঘটনা ঘটেছে তার পুনরবৃত্তি ঘটায় আশ্চর্যের কিছু নেই ; থাকার কোনো অর্থও হয় না। জীবনের পুনরাবৃত্তি ঘটা অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। এর উদাহরণ জড়জগতে বহু রয়েছে। প্রতিবছর বর্ষাকালে আমরা দেখি, লতাগুল্ম, গাছপালা যৌবনপ্রাপ্ত হয়, পৃথিবীর রূপলাবন্যে বিচিত্র মাদকতা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আবার শুকনো মৌসুম আসে। যেখানে ছিলোসবুজের মাতামাতি সেখানে দেখা দেয় ধূসরতা। নেতিয়ে পড়ে সবকিছু। শুকিয়ে ঝড়ে যায় বহু লতাগুল্ম। এভাবে একটি জীবন শ্যামলতায় অবগাহন করে আবার ঝরে যায়, মৃত্যু বরণ করে। কিন্তু পরবর্তী বছর যখন আবার বর্ষা শুরু হয়, বৃষ্টি নেমে আসে, তখন আবার জমিনে প্রাণ ফিরে আসে, জীবিত হয় এতদিন যা ছিল মৃত। শুকনো জমিনে আবারও হিন্দোলিত হয় দ্বিগন্ত-জোড়া সবুজ। মানুষকেও মৃত্যুর পর অনেকটা এভাবেই জীবিত করা হবে পুনর্বার। মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে সন্দেহ এজন্যও জাগে যে, আমরা আমাদের অস্তিত্বটাকে শরীরী অবকাঠামোর আলোকে ভাবি। মনে করি বাইরে চলমান যে শরীর, সেটাই মানুষের মূল বাস্তবতা বা অস্তিত্ব। তাই যখন এই শরীরী খাঁচা ভেঙ্গে পড়ে, পঁচে-গলে মাটির সাথে মিশে যায় তখন ভাবি সবকিছুর বুঝি অবসান ঘটলো। আমরা দেখি একটা জলজ্যান্ত মানুষ মূহুর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, চিরকালের জন্য চুপ হয়ে যাচ্ছে। চলমান শরীর নিথর নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার সমস্ত যোগ্যতা, শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তাকে মাটির নিচেচাপা দিয়ে রেখে দেয়া হচ্ছে, অথবা কোনো কোনো সমপ্রদায়ের প্রথা অনুযায়ী জ্বালিয়ে ভস্ম করে দরিয়ায় ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে। যাকে মাটির নিচেসমাহিত করা হচ্ছে, ক’দিন যেতে না যেতেই তার শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে জমিনের সাথে মিশে যাচ্ছে। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তার শরীরী অস্তিত্ব। একটি জলজ্যান্ত মানুষের এভাবে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রতি মুহূর্তেইঘটছে। যে মানুষটি এভাবে শেষ হয়ে গেলো সে কীভাবে আবার জীবনে ফিরে যাবে? এ যেন এক কঠিন ধাঁধাঁ। তবে একটু ভেবে দেখলে বুঝতে পারবো যে আমাদের আসল অস্তিত্ব এই শরীরী অস্তিত্ব নয়। আমাদের আসল অস্তিত্ব অভ্যন্তর মানস যা ভাবে, চিন্তা করে, শরীরকে চালায়। যার উপস্থিতি শরীরকে রাখে সজীব-সতেজ-চলমান এবং অনুপস্থিতি তাকে করে মৃত, নিশ্চল। প্রকৃত অর্থে মানুষ বিশেষ কোন শরীরের নাম নয়। মানুষ ওই আত্মার নাম যা শরীরের মধ্যে বিরাজমান থাকে। আর আমরা জানি, শরীর অতি-ক্ষুদ্র পরমাণু দিয়ে গঠিত যাকে জীবকোষ (Living Cell) বলে। মানুষের শরীরে কোষের একই অবস্থান যা একটি বিল্ডিং- এ ইটের। আমাদের শরীরী বিল্ডিং এর এই ইটগুলো, অথবা যাকে পারিভাষিক অর্থে কোষ বলে থাকি আমাদের কাজের সময়, নড়াচড়ার সময়, ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। খাদ্যের মাধ্যমে আমরা এর ক্ষতিপূরণ করে থাকি। খাদ্য হজম হয়ে বিভিন্ন প্রকার কোষের জন্ম দেয় যা ক্ষয়প্রাপ্ত কোষের জায়গা দখল করে। মানুষের শরীরএভাবে সার্বক্ষণিকভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে। এ-কাজ প্রতিদিনই ঘটে, এবং কিছুদিন পরসমগ্র শরীর সম্পূর্ণ নতুন শরীরে রূপান্তরিত হয়।

সৌজন্যঃ কুরআনের আলো ডট কম ।

কোন মন্তব্য নেই :