পরকাল ভাবনা (পর্ব :১) →পাতা ২←
স্বীকার করতেই হয়, শহরে-বন্দরে মানুষের নিরবচ্ছিন্ন আনাগোনা, ব্যস্ততম পথে অনবরত যাতায়াত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছে— মানুষ তার বসু্তনির্ভর খায়েশও রক্তমাংশের প্রয়োজন মেটানোকেই জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে সাব্যস্ত করে নিয়েছে। পরজগৎ নয় বরং ইহজগতের বিচিত্র চাহিদা পূরণকেই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে ধরে নিয়েছে।মানুষকে উৎফুল্ল দেখালে বুঝে নিতে হবে তার কোনো পার্থিব প্রয়োজন পূরণ হয়েছে। আজকের প্রয়োজন, আজকের সুযোগ-সুবিধা, আজকের ক্ষণস্থায়ী আরাম-আয়েশ ইত্যাদি একটি বিশেষ মাত্রায় অর্জন করতে পারাটাই যেন জীবনের সফলতা। এটাই সে বিষয় যার পেছনে ব্যয় হচ্ছে মানুষের সর্বোত্তম যোগ্যতা, ক্ষরিত হচ্ছে প্রদত্ত শক্তি, সাহস। আসছে কিয়ামত দিবসের ভাবনা কারও নেই। প্রতিটি ব্যক্তির ম্যারাথন দৌড়ের চূড়ান্ত লক্ষ্য বর্তমান নিসর্গ। আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনে কারীমে কাফেরদের বক্তব্য নকল করে বলেন :إن هي إلا حياتنا الدنيا نموت و نحيا وما نحن بمبعوثين – المؤمنون : 37
একমাত্র পার্থিব জীবনই আমাদেরজীবন, আমরা যদি বাঁচি এখানেই এবং আমরা পুনরুত্থিত হবনা। (সূরা মুমিনূন : ৩৭)
বড় শহরগুলোর অবস্থাই যে কেবলএরকম, কথা ঠিক নয়। বরং যেখানেই রয়েছে মানুষের বসতি সেখানেই এ-অবস্থা অত্যন্ত প্রকটভাবে দৃষ্টিগ্রহ্য। আপনি যাকেই টোকা দিবেন, পরখ করতে চাইবেন, তাকেই এ-বিষয়টির বন্দনায় নিষ্ঠাবান পাবেন। কি পুরুষ কিনারী, কি আমীর কি গরীব, কি যুবককি বৃদ্ধ, কি শহুরে কি গেঁয়ো, কি ধার্মিক কি অধার্মিক সকলেইঅভিন্ন পথের তীর্থযাত্রী। আজকের মানুষের সবচাইতে বড় আকুতি, এই নিসর্গে যা কিছু লভ্য সবই লুফে নিতে হবে দুহাত ভরে। ‘ব্যয় করো এর পিছনেই তোমার সর্ব শ্রেষ্ঠ যোগ্যতা, মশগুল রাখো এ চিন্তাতেই তোমারদিবস-রজনী ’ এ-শ্লোগানের পদধ্বনি যেন নিরন্তর ভেসে আসছে চতুর্দিক থেকে। অবস্থা দেখে মনে হয়, ইহকালীন ভোগ-সম্ভোগই একমাত্র দেবতা যার নজরানায় ঈমান ও আত্মোপলদ্ধি কুরবানী করতেও মানুষ প্রস্তুত রয়েছে। মানুষএখানেই সবকিছু পেয়ে যেতে চায়, তা যেভাবেই হোক, যেকোনো মূল্যেই হোক। কিন্তু এ-ধরনের সমস্ত সফলতা, নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইহকালীন সফলতা। পরকালে এসমস্ত সফলতার থোরাই মূল্য রয়েছে। যে ব্যক্তি তার সমকালের নিসর্গকে সাজাতে ব্যস্ত সে পরকাল বিষয়ে নিঃসন্দেহে উদাসীন। যে ব্যক্তি তার যৌবনে বার্ধক্যেরজন্য কিছুই সঞ্চয় করেনা, এ ব্যক্তির উদাহরণ ঠিক তারই মতো। ফলে বয়সের ভার বহনে সে যখন অক্ষম হয়ে পড়ে, শ্লথ হয়ে আসে গতিময়তা, হারিয়ে বসে কর্মক্ষমতা, তখন সে আঁচ করতে পারে : তার দাঁড়াবার মতোকোন জায়গা নেই, নেই মাথা গোঁজার কোন ঠাঁই, গা ঢাকার কোনকাপড়, শোবার কোন বিছানা। কিন্তু বয়স তখন দীর্ঘ পথ মাড়িয়ে এসে শ্রান্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি, গাত্র ঢাকার কাপড়,শোবার বিছানা, দু’মুঠো অন্নের ব্যবস্থা ইত্যাদির পেছনে শ্রমদেয়ার কোন শক্তি সাহসই তার পতিত ছন্দের শরীরে আর থাকে না। সে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে মহাবিশ্বের তাবৎ বিষাদ বুকে ধারণ করে হয়তো কোনো বৃক্ষের শিকড়ে মাথা রেখে আকাশের বিশালতা মাপতে শুরু করে। কোন দেয়ালের গা ঘেষে উদাস দাঁড়িয়ে থাকে, অথবা মুখ থুবরে পড়ে থাকে; উদভ্রান্ত কুকুরের দল তাকে ঘিরে ঘেউ ঘেউ করে, শিশুরা ছুড়ে মারে অজস্র পাথর। আমরা নিজ চোখে এমন বহু ঘটনা দেখে যাচ্ছি, যা থেকে কিঞ্চিৎ হলেও আঁচ করা যায়, পরকালের জন্য যে ব্যক্তি কিছুউপার্জন করছে না তার পরিণতি কত ভয়াবহ হবে। তবে এ বিষয়টি আমাদের মধ্যে কোন চাঞ্চল্যই সৃষ্টি করেনা। আমাদের অনন্ত স্থবিরতায় সৃষ্টি হয় না কোনআন্দোলন। আমারা প্রত্যেকেই বরং আমাদের ‘আজ’কে নির্মাণে বড় ব্যস্ত। আগামীকালের জন্য উদ্বিগ্ন হচ্ছি না মোটেই। যুদ্ধের সময় যদি উৎকট আওয়াজে ঘোষিত হয়, শত্রু পক্ষের বিধ্বংসী বিমানসমূহ ধেঁয়ে আসছে ব্যাপক ধ্বংসলীলাচালাতে, তাহলে সবাই কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে দৌড়ে পালাবে। জনাকীর্ণ রাজপথ নিমিষেই ঢাকা পড়বে শুনশান নিরবতার পুড়ো চাদরে। যদি কেউএ অবস্থায় নিথর নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে, যদি এমন পরিস্থিতিতেও কোনো চঞ্চলতা ছন্দ খুঁজে না পায় কারও শরীরে, অন্তরে, তাহলে সবাই তাকে নির্ঘাৎ পাগল বলবে, একথা দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়। এ-ধরনের উৎকন্ঠা ও চঞ্চলতা এ-পৃথিবীর একটি ছোট বিপদকে কেন্দ্র করে ঘটে থাকে। তবে এ-বিপদের থেকেও হাজারগুণে ভয়ংকর ,বীভৎসতম আর এক নিশ্চিতবিপদ আসছে, যার ঘোষণা স্রষ্টা নিজেই দিয়েছেন। বিশ্বপ্রতিপালক তাঁর প্রেরিত পুরুষদের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছেন – মানুষ যেন একমাত্রতাঁরই ইবাদত করে, অন্যের অধিকার যথার্থভাবে আদায় করে দেয়, একমাত্র তাঁরই মর্জি মোতাবেক জীবনযাপন করে; না করলে মুখোমুখি হতে হবে কঠিন শাস্তির। ইরশাদ হয়েছে :
ومن أعرض عن ذكري فإن له معيشةضنكا ونحشره يوم القيامة أعمى.سورة طه :124
যে আমার স্মরণ হতে বিমুখ তার জীবনযাপন সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ হিসেবে। [ সূরা তাহা:১২৪]
আরো পড়ুন......→পরকাল ভাবনা (পর্ব :১)→পাতা ৩←
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
কোন মন্তব্য নেই :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন