একটি মেয়ের গল্প part 2
কোন মন্তব্য নেই
পাহারা দেয়া অবস্থায় মা একদিন দেখতে পায় রুনার শরীরে খিঁচুনির মতো হচ্ছে এবং সে এক হুলস্থূল ব্যাপার। প্রথমে পাড়ার ডাক্তার। তারপর সাত দিন সিরিয়াল দিয়ে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, নার্সিং হোম ইত্যাদি করা অবস্থায় যখন কলকাতায় গিয়ে চিকিৎসা করাবেন ভেবে পাসপোর্ট রেডি করছেন ঠিক তখনই কী করে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলেন। সাতদিন অবিরাম চেষ্টার পর বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি খাটিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রুনাকে ভালো করে তুললেন। এবার আসুন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের ভাষায় রোগটির বর্ণনা শুনি।
রোগটির নাম ‘হিস্টিরিয়া’।অবিবাহিত কম বয়সের মেয়েদের এটি বেশি হয়। চাওয়া আর পাওয়ার কমতি ঘটলেই অবচেতন মন রোগটি তৈরি করতে সাহায্য করে।
মনে রাখা দরকার এটি কোনো ‘ভান’ নয়। খিঁচুনি প্যারালাইসিস, হঠাৎ অন্ধ হয়ে যাওয়া, হঠাৎ কথা বন্ধহয়ে যাওয়া, স্মৃতিশক্তি হারানো, শরীরে এলোমেলো ব্যথা ইত্যাদি হিস্টিরিয়া রোগের উপসর্গহতে পারে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আপনি কিছুই পাবেন না কিন্তু রোগীর ঠিকই কষ্ট হচ্ছে। এই মুহূর্তে দরকার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কেয়ার ও সাইকোথেরাপি।
রুনার ব্যাপারটা কতকটা এ রকম। দু-এক বছর পরেই প্রেমিককে ভুলে যাওয়ার কারণে (যা কিনা পিতা-মাতার চাপে) রুনার মনে আরেকটি অসুখের উদ্ভব হলো তার নাম অবসেশন।
‘অবসেশন’ রোগটি মেয়েদের মধ্যে বেশি পাওয়া যায়। এটি একটি মৃদু মানসিক রোগবা নিউরোসিস রোগ। ২০ থেকে৩০ বছর বয়সের মহিলাদের এ রোগটি বেশি হয়। পূর্বে ঘটে যাওয়া অপরাধবোধ থেকে এ রোগের সৃষ্টি হতে পারে।অবসেশন রোগের উপসর্গের চরিত্র দুরকম। কিছু উপসর্গ কাজের মাধ্যমে হয়। পাঠকের সুবিধার্থে সাধারণভাবে উপসর্গগুলো আলোচনা করছি। খুঁতখুঁতে ভাব, একই চিন্তা বারবার করা, একই জিনিসের সন্দেহ পোষণ করা, অবিশ্বাস, অতিরিক্ত ঘৃণাবোধ, অতিরিক্ত হিসাবি ইত্যাদিএ রোগের মূল উপসর্গ। সাধারণভাবে আমরা রোগীদেরএভাবে পাই- বারবার হাত ধোয়া, হাতে ময়লা আছে ভেবেহাতে সাবান দিয়ে ঘষা, গোসল করতে অতিরিক্ত সময় লাগা, বারবার গোনা, রাগ, সেক্স সম্বন্ধে কাল্পনিকচিন্তা আসা, বারবার নামাজপড়া ইত্যাদি।
রুনাকে আবারও সেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতেহলো। বলে রাখা ভালো, এর আগে রুনার পিতা মেডিসিন সার্জারি গাইনি রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়েফেলেছেন, যা হোক আবারও মানসিক রোগ চিকিৎসায় আরোগ্য লাভের পর রুনা দুতিন বছর কোনো ওষুধ ছাড়াই কালাতিপাত করল।মেয়ের বয়স যখন ২৫ বছর হলোতখন পিতামাতার ইচ্ছায় বিশিষ্ট শিল্পপতি আবুল হাশেমের সাথে রুনার বিয়ে হয়ে গেল। তিন বছরের মাথায়প্রথম সন্তান হওয়ার পর রুনার কিছু মানসিক পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। দুই পরিবারের মধ্যে রুনার সন্তান অত্যন্ত আদরের। কিন্তু সন্তান ছেলে হওয়া সত্ত্বেও রুনার কেন জানি বাচ্চার দিকে নজর নেই, একটু উদাসীন থাকে। রাতে ঘুম কমহয়। বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ায় না। নিজের পোশাক পরিচ্ছদের দিকে খেয়াল নেয় না। আত্মীয়-স্বজনরা ফুল-মিষ্টি নিয়ে হায় হ্যালো বললেও উত্তর দেয় না। মুখ গোমড়া করে রাখে, মনে যেন শান্তি নেই। এই অসুখটির নাম প্রসবোত্তর ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার রোগে কোনো কিছু ভালো না লাগা, চুপচাপ বসে থাকা, কান্না পাওয়া, খাদ্যে অনীহা, ওজন কমে যাওয়া, বারবার মৃত্যুর চিন্তা মাথায় আসা, স্বাভাবিক কাজে আগ্রহ না থাকা, পারিপার্শ্বিক কাজ থেকে আনন্দ লাভ না করা ইত্যাদিউপসর্গ থাকে। সন্তান প্রসবের পর বিষণ্নতা-এ ধরনের রোগ বাচ্চা জন্মের চার দিনের মাথা থেকে শুরুহয়। অন্য বিষণ্নতা থেকে এবিষণ্নতার তফাৎ এতটুকু যে, এখানে শিশুকে মেরে ফেলা বা আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে।
পাঠকগণ! আমরা রুনার জীবনযাত্রা বিশ্লেষণ এখনো শেষ করিনি। এর পরে সংসার চালিয়ে ওর বয়স যখন ৪৫ বছর হলো তখন আরেকটি সমস্যার মুখোমুখি হলো সে। মাসিক চক্র অনিয়মিত হতে লাগল, দু-এক বছর পর তানিয়মিতভাবে বন্ধ হয়ে গেল। এ সময়টায় শুরু হলো শরীরের জ্বালাপোড়া, ঘাম, অবসন্নতা, তীক্ষ্ণ মেজাজ ইত্যাদি উপসর্গ। এমনিতেইরুনার দু সন্তানের কেউ দেশে নেই। বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, সন্তানদের জন্য মন যেন কেমন খারাপ লাগে। এ সমস্তবিষয়ে রুনার স্বামী আবুল হাশেম সাহেব কম খেয়াল করেন। বেশির ভাগ সময় তাকেব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে আমাদের গল্পের নায়িকা রুনা হাশেম আরেকটি অসুখে ভুগতে শুরু করেন। তার নামও বিষণ্নতা। নারীর মনের অসুখ-এ প্রবন্ধে রুনা হাশেমের জীবন বৃত্তান্ত অনুসরণে আমরা যেসব অসুখের নাম পেয়েছি তা লিপিবদ্ধ করলে এ রকম দাঁড়াবে-
১. ইলেক্ট্রকমপ্লেক্স-যাকিনা পরবর্তীতে ব্যক্তিত্বের অসামঞ্জস্যতার প্রকাশ পায়।
২. ‘পিএমটি’ বা মাসিক-পূর্ব মানসিক সমস্যা।
৩. হিস্টিরিয়া।
৪. অবসেশন।
৫. সন্তান প্রসবোত্তর বিষণ্নতা।
৬. বৃদ্ধ বয়সের বিষণ্নতা।
আপনারা একটু খেয়াল করলেই দেখবেন যে, কোনো পুরুষের ৭ থেকে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত এতগুলো অসুখে ভোগার প্রবণতা মেয়েদের চেয়ে কম। আমরা কথাটাকে এভাবে বলতে পারি, মেয়েদেরমধ্যে মনের অসুখে ভোগার প্রবণতা ছেলেদের চেয়ে বেশি। সম্ভাব্য কারণ নিম্নরূপ-
১. সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক মানসিক চাপ।
২. খর্ব স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা।
৩. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।
৪. পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবহেলা।
৫. এস্ট্রোজেন-প্রজেস্টেরন হরমোন চক্র।
৬. মাতৃত্ব।
৭. মাতৃত্ব-উত্তর দায়িত্ব।
৮. সংসারের প্রতি নারীর অধিক ভালোবাসা।
৯. মেনোপজ বা নারীত্বের খর্বতা।
১০. অধিক একাকিত্ব।
কারণ যা-ই ঘটুক না কেন মনে রাখতে হবে এ কারণগুলোর জন্য শরীরের বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তন হয় ও ফলাফলে মানসিক রোগের সৃষ্টি হয়। তাই কারণ না বুঝে প্রথমে নারীর মনের অসুখের চিকিৎসা করুন ও পরে কারণ সমাধানের চেষ্টা করুন। তাহলেই রক্ষা পাবে নারীত্ব ও মাতৃত্ব।

♥♥♥♥সমাপ্ত♥♥♥♥
প্রকাশক : সৈয়দ রুবেল উদ্দিন
www.facebook.com/sayed.rubel3

কোন মন্তব্য নেই :