একটি মেয়ের গল্প part 1
রুনার বয়স ১২ বছর। হাফপ্যান্ট, ফ্রক পরে খেলাধুলা করে। বাসায় আরো দুজন ছোট ভাই-বোন আছে। পিতা রশিদ উদ্দিন আহমেদ বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আর বৈশিষ্ট্যতার জন্যই তিনিবাড়িতে কম থাকেন। মা একজনকর্মজীবী মহিলা, আর্থিক কারণে নয়, জাস্ট অভ্যাসগততিনি কাজ করেন। আর এই কাজের জন্যই তিনি বাড়িতে কম থাকেন। সংসারটা চলে চাকর-চাকরানির কেয়ার-অফে। একদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় ১০টার দিকে বাথরুমে গিয়ে রুনা চিৎকার করে উঠল। স্বভাবতই পিতা-মাতা অনুপস্থিত। কাজের বুয়া দৌড়ে গিয়ে দেখল দরজা ভেতরথেকে বন্ধ, রুনা চিৎকার করছে, অনেকক্ষণ চেঁচামেচির পরে দরজা খুলে কাজের বুয়া জমিরন বিবি যা দেখল তার সারমর্মহচ্ছে ‘রুনার প্রথম মাসিকহয়েছে। বুয়া তার জ্ঞানে যতটা কুলায় রুনাকে সান্ত্বনা দান করল। পরে পিতা-মাতা ফিরে এলে রুনা আর ওই ঘটনাটি তার বাবা-মাকে জানাল না।’এই মুহূর্তে রুনার দরকার মাসিকসংক্রান্ত বয়স অনুযায়ী জ্ঞানের ও সহানুভূতি। এই বয়সে কন্যাসন্তানের মধ্যে নানা রকম ভয়-ভীতি, রাগ ও ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স তৈরি হতে পারে। পাঠকগণ লক্ষ করুন, ওই ঘটনার পর থেকে রুনার চালচলন, পোশাক-আশাক পাল্টে গেল। সালোয়ার-পায়জামা এলো, বুকে একটা ওড়না জায়গা দখলকরে নিল। ছেলেদের সাথে ছোটাছুটি, দৌড়াদৌড়ি বন্ধ হয়ে গেল। যদিও রুনার মনে দৌড়াদৌড়ি করার ইচ্ছা বজায় থাকল।
এখন আর মেহমান এলে সহসা সামনে যেতে পারে না। তার ব্যক্তিস্বাধীনতা কতকাংশে খর্ব করা হলো। এ সময় সে বুঝতে পারল ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে কী তফাৎ। কতক কাজ সে বুঝে নিল শুধু ‘ছেলেদের কাজ’ আরকতক কাজ বুঝে নিল শুধু ‘মেয়েদের কাজ’। যেমন- নাশতা তৈরি করা, বিছানা গুছানো, ঘর গুছানো ইত্যাদি। এই সময়ে যে কোনোকন্যাসন্তানের মনে হীনমমন্যতার সৃষ্টি হতে পারে। নিজেকে একটা ‘অদ্ভুত জীব’ মনে হতে পারে। আরো বড় হয়ে দুবছর পরে সে জানল তার ছোটভাই গিলটু যে জিনসটা করতে পারে বা চাইতে পারে তা তার পক্ষে করা বা চাওয়া সম্ভব নয়।
স্কুলে বা কলেজে যাওয়ার সময় রুনা ‘ইভটিজিং’-এর শিকার হয়। মাথা নিচু করে তা সহ্য করে। আরেকটু বড় হয়ে পিতামাতার দৃষ্টিতে ‘বুদ্ধি কম হতে পারে’ মনে করে তাকে আর্টস পড়তে দেয়াহলো। পাঠকগণ! খেয়াল করুন রুনার পিতামাতা যদি তাকে ‘বুদ্ধিমতী’ মনে করতেন, তাহলে রুনাকে সায়েন্স পড়াতেন, সে মেডিকেলে ভর্তি হতো এবং শেষে ‘স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ’ হতো। ব্যতিক্রম যে নেই তানয়। তবে খেয়াল করে দেখবেনবেশির ভাগ মহিলা ডাক্তার ‘স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ’ হয়ে যান।যেন এর বাইরে আরকিছু করার নেই। আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্তটা কিছু চাপিয়ে দেয়া।
এতক্ষণ আমরা জন্ম থেকে ২৬বছর বয়স পর্যন্ত একটা মেয়ে কীভাবে সামাজিক চাপের শিকার হয় তার একটি উদাহরণ দেখলাম। মানসিক রোগের কারণ ব্যাখ্যায় সামাজিক ও পারিবারিক চাপ মেয়েদের জন্য একটি অন্যতম কারণ। অনেক কথা আছে যা রুনা ইচ্ছা করলেও বা মন খুলে বলতে পারবে না, প্রকাশ করতে পারবে না,ইচ্ছামতো বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করতে পারবে না ইত্যাদি সামাজিক চাপ মানসিক রোগ সৃষ্টিতে সাহায্য করে।
‘মাসিক চক্র’ বা ‘পিরিয়ড’-এটি হরমোন এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরনের খেলা। এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরনের চক্র শরীরভাঙে আবার গড়ে। এ হরমোন দুটো নারীর শরীরে নমনীয়তা ও উষ্ণতা তৈরি করতে সাহায্য করে। এস্ট্রোজেন-প্রজেস্টেরন চক্রের মধ্যে হরমোনের মাত্রা কিছুটা কম-বেশি হলেই দেখা দেয় প্রিমিনিস্ট্রুয়াল সিমটম বা মাসিক-পূর্ব মানসিক চিন্তা। এ সময়টাতে মেজাজ খিটখিটে থাকে, বিরক্তিবোধ হয়, শরীরে ওজন বাড়ে, ঘুমের সমস্যা হয়। চক্রের এ সময়টা মানসিক সমস্যার মধ্যে পড়ে। অনেক মেয়ের মাইগ্রেন বা অর্ধ কপালি মাথাব্যথা দেখা দেয়। সামান্য চিকিৎসাতে এর উপশম হয়। চিকিৎসা ছাড়াও এ‘পিএমটি’ আপনাআপনি ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে চলে যায়। তলপেটে ব্যথা হওয়া, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, চোখে ঝাপসা লাগা সব ‘পিএমটি’-এর উপসর্গ এবং তা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। পাঠকগণ কল্পনা করুন ১৭ বছর বয়সের রুনা এক ক্লাসমেটকে ভালোবাসে।রুনা প্রাইভেট পড়তে গিয়ে কোচিং ক্লাসে ছেলেটির বুদ্ধিমত্তা ও স্মার্টনেস দেখে তাকে মন দিয়ে ফেলে। প্রথমে চলল নোট দেয়া-নেয়া, তারপর বই-এর ভেতর চিঠি আদান-প্রদান, ‘ভুলো না আমায়’, মরে যাওয়া গোলাপ ইত্যাদি। তারপর আরেকটু অগ্রসর হলো রজনীগন্ধার ডাঁটায়। পরে জিয়া মাজার, চন্দ্রিমা উদ্যান ও সব শেষে আরো অনেক কিছু। কোনোএকদিন ড্রয়ার পরিষকার করতে গিয়ে বুয়া জমিরন বিবি আবিষকার করেন প্রেম ভালোবাসা মাখানো অনেকগুলো চিঠি। গৃহকর্ত্রী ফিরে এলে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে বুয়া চিঠিগুলো হস্তান্তরকরে গৃহকর্ত্রীর কাছে। আরো পরে গৃহকর্তা ফিরে এলো ‘মাস্টার বেডরুমে শোনা যায় ধমকা-ধমকি, কান্নাকাটির আওয়াজ’। ফলাফলে রুনার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। বন্ধ হয় কোচিংয়ে যাওয়াও। মা অফিস ত্যাগ করে রুনাকে বাড়িতে পাহারা দিতে শুরু করে। বিশ্বস্ত বিরহিনীর মতো রুনার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়। ঘুম নিদ্রা কমে যায় এবং চেহারা খিটখিটে হতে থাকে।
আরো দেখুন
একটি মেয়ের গল্প part 2
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
কোন মন্তব্য নেই :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন