বিবাহ ৩
প্রাচীন গ্রিসে যৌতুক হিসেবে দেয়া হতো অর্থ অথবা জমি কিংবা এক সাথে দুটোই। ক্লাসিক্যাল যুগেএথেন্সের একটি মেয়ের জন্য যৌতুক দিতে হতো এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার ড্রাচমা পর্যন্ত। তখনকারদিনের জন্য বিপুল অর্থ। পেরিক্লেসের মৃত্যুর কিছুদিন আগের এক হিসাব অনুসারে দেখা যায় যে, তখনএক দিনের মজুরি ছিল এক ড্রাচমা যা চারজনের একটি পরিবারের ব্যয় নির্বাহেরজন্য পর্যাপ্ত ছিল। বিত্তবান পরিবার তাদের মেয়েদের জন্য যৌতুক প্রদান করত তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এবং বারো হাজার ড্রাচমা যৌতুক দেয়ার দৃষ্টান্ত পর্যন্ত আছে। এর চেয়েও অধিক যৌতুক পেয়েছিলেন অ্যালকিবিয়াডেস, যার পরিমাণ ছিল এক লাখ বিশ হাজার ড্রাচমা। যৌতুকের পরিমাণ আইন দ্বারা নির্ধারিত কোনো ব্যাপার ছিল না, বরং দুই পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত হতো। এই রীতি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ রাষ্ট্র দরিদ্র নাগরিকদের মেয়ের বিয়ের জন্য যৌতুকের ব্যবস্থা করত। এটি ভূমিহীন ও অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের জন্য একটি আইন ছিল, যার দ্বারা দরিদ্র কোনো মেয়ের অবস্থাসম্পন্ন আত্মীয়দের বাধ্য করা হতো তার যৌতুকের অর্থ সংগ্রহ করতে। তাছাড়া যৌতুকের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাশালী পরিবারের মধ্যে বিয়ের সম্পর্ক স্থাপন করে অর্থনৈতিক স্বার্থকে আরো শক্তিশালীকরা এবং সমাজের দুর্বল অংশের মধ্যে সম্পদ বণ্টন করা।বিয়ের মাধ্যমে স্বামী যে যৌতুক লাভ করত তা সে নিজের মর্জি অনুসারে কাজে লাগাতে পারত, যেন এগুলো তার সম্পত্তি। এর কারণ মহিলাদের সম্পত্তিরমালিকানার অধিকার ছিল না। অতএব বিবাহ বিচ্ছেদ অথবা স্বামীর মৃত্যুর ফলে স্ত্রী যৌতুকের আপেক্ষিক মূল্যই ফেরত পেত। কারণ স্বামী ইতিমধ্যে যৌতুক হিসেবে প্রাপ্ত সামগ্রী কোনো না কোনো কাজে লাগিয়ে ফেলে অথবা বিক্রি করে দেয়। এ অবস্থায় স্বামী পরিত্যক্তা অথবা স্বামীহীন ও দারিদ্র্যে নিপতিত কোনো মহিলা যদি পুনরায় বিয়ে করতে চায় তাহলে তাকে নতুন করে যৌতুক সংগ্রহ করার প্রয়োজন পড়ত। অথবা বলা যায় এ দায়িত্ব গ্রহণ করতেহতো তার আত্মীয়দের।
বাগদান সংক্রান্ত আলোচনার সময়ে বিয়ের তারিখ অথবা আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়কনেকে বরের হাতে তুলে দেয়ার বিষয় নির্ধারিত হতো। অধিকাংশ বিয়ে সম্পন্ন হতো ‘গ্যামেলিয়ন’মাসে, অ্যাটিক বর্ষপঞ্জির সপ্তম মাসে, যা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিরমধ্যে পড়ে। কারণ এই মাসটিবিয়ের দেবী হেরার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। কিন্তু যেসব বর ও কনে কোনো কারণে এই শুভ মাসের অপেক্ষায় থাকতে পারত না তারা কোনো মাসের পূর্ণিমাকে বাছাই করে নিত।
বিয়ের একদিন আগে দুটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম পালন করা হতো-ভবিষ্যৎ দম্পতিরত্যাগ ও পবিত্রকরণ। প্রথমত কনের পিতা জিউস, হেরা, আফ্রোদিতে, আর্টেমিস ও পেইথোর উদ্দেশ্যে তার অর্ঘ্য নিবেদন করত। এসব দেবতা ও দেবী বিয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। গ্রিক দেবদেবীর মধ্যে জিউস ও হেরা শুধু গুরুত্বপূর্ণইছিলেন না তারা আদর্শ দম্পতির দৃষ্টান্তও ছিলেন। যদিও জিউস ব্যভিচার করতেন এবং হেরার সাথে তার সংঘাতও হতো। আফ্রোদিতে ছিলেন প্রেমের দেবী এবং প্রজনন উর্বরতারও। আর্টেমিসের সম্পর্ক বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে। তাছাড়া তিনি প্রসব যাতনায় কাতর রমণীদেরও রক্ষাকারিণী ছিলেন। শেষ দেবতা পেইথোর উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদনের কারণ ছিল। দম্পতির মধ্যে আনুগত্য ও সমঝোতার ভিত্তি স্থাপনেরদেবী ছিলেন তিনি, যার ওপরনির্ভর করত বিয়ের স্থায়িত্ব।
আরেক নীতি পালন করা হতো, যাতে বাগদত্তা কনেকে আর্টেমিসের উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে হতো তার শৈশবও কৈশোরের সাথে জড়িত কিছুসামগ্রী, যা সে ইতিমধ্যে পরিত্যাগ করেছে। যেমন খেলনা এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিসপত্র-আয়না, চুল বাঁধার ফিতা, চুলের খোঁপা বাঁধার জালি ইত্যাদি। বিয়ের রীতি হিসেবে বাগদত্তা কনের চুলের গোছা আর্টেমিসের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হতো ডেলোস, ট্রোয়েজেন এবংমেগারায়। এথেন্সে এ ধরনের রীতি পালনের কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। কিন্তু এই রীতি পালনের মধ্য দিয়ে কোনো মেয়ের কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণের ক্রান্তিলগ্নকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। হবু বরকে প্রাচীন গ্রিসের কোথাও এই রীতিগুলো পালন করতে হতো না। কারণ তাদের বয়ঃপ্রাপ্তি ঘটেছে অনেক আগে এবং বিয়ের সময়ে বয়স ত্রিশ অতিক্রম করেছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রীতি ছিল বর ও কনের পবিত্রকরণ অনুষ্ঠান, যা প্রকৃতপক্ষে বিয়ের আগে আনুষ্ঠানিক স্নান করার রীতি। এথেন্সে কনেকে স্নান করানো হতো নগরীর বিখ্যাত ঝর্ণা কালিরহোর পানি দিয়ে। একটি শোভাযাত্রা বের হতো কনের বাড়ি থেকে এবং সে শোভাযাত্রা ঝর্ণার দিকে এগিয়ে যেত। শোভাযাত্রায় থাকত একজন তরুণ বংশীবাদক,সম্ভবত কনের নিকটতম কোনো আত্মীয়ের পুত্র। বন্ধু ও আত্মীয়রা বহন করত মশাল এবং একজন বহন করত দীর্ঘ নল ও দুই হাতলবিশিষ্ট একটি সোরাহি, যা পূর্ণ করা হতো ঝর্ণার পানি দিয়ে। কোনো বিবরণীতে সপষ্ট নয় যে শোভাযাত্রায় কনে স্বয়ং অংশগ্রহণ করত কি না। অবশ্য পরবর্তীতে প্রাপ্ত এ ধরনের সোরাহিতে কনের প্রতিকৃতিদেখা যায়। এমন একটি সোরাহি রয়েছে এথেন্সের ন্যাশনাল আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়ামে।
ওয়ারশ মিউজিয়ামের একটি সোরাহিতে দেখা যায় যে, একজন তরুণ বিয়ের আগে আনুষ্ঠানিক স্নান করছে। সম্ভবত ছেলেরা নিজেরাই ঝর্ণায় স্নান করে নিত, যাকোনো মেয়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
বিয়ে উপলক্ষে বর ও কনের পবিত্রকরণ ছাড়াও আনুষ্ঠানিক স্নানের আরেকটি প্রতীকী বৈশিষ্ট্য ছিল। নদী এবং ঝর্ণার পানি যেভাবে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, একইভাবে এই পানি নব বিবাহিতদের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতায় অবদান রাখবে বলে গ্রিকরা বিশ্বাস করত। তাছাড়া এটা ভুললে চলবে না যে পানির জাদুকরি ক্ষমতা সম্পর্কেমানুষের বদ্ধমূল ধারণা সকল সভ্যতা ও ধর্মে দেখতেপাওয়া যায়। আমরা তো অ্যাচেলোস নদীতে উৎসর্গ প্রদান, জর্দান ও নীল নদীর পানি দ্বারা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ, স্টাইবাস নদীর পানির অমরত্বের গুণ, গঙ্গা নদীর পানিতে জীবিতদের পবিত্রকরণ বা পাপমোচন ও মৃতদের দেহভষ্ম উৎসর্গ করা এবং নামাজের পূর্বে মুসলমানদের অজু করার রীতিগুলো সম্পর্কে অবহিত। তাছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মানব দেহের অধিকাংশ পানি এবং পৃথিবীরও। অতএব পানিকে সবসময় পবিত্র বিবেচনা করা হয়েছে।
আরো
পড়তে থাকুন ৪
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
কোন মন্তব্য নেই :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন