শ্বেতপ্রদর বা লিউকোরিয়া ডা. দিদারুল আহসান

কোন মন্তব্য নেই
শ্বেতপ্রদর আমাদের দেশে সবারই জানা একটি নাম। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়ে থাকে। যেমন-সাদাস্রাব, প্রমেহ, মেহ ইত্যাদি। অনেকের ধারণা, শ্বেতপ্রদর বা লিউকোরিয়া কোনো একটি রোগের নাম, কথাটি সত্য নয়। এ নামে কোনো রোগ নেই।এটি একটি উপসর্গ মাত্র। যোনির নিঃসরণকেই শ্বেতপ্রদর বা লিউকোরিয়াবলা হয়। বিভিন্ন কারণে শ্বেতপ্রদর হতে পারে এবং সেই কারণের ওপরই নির্ভর করবে নিঃসরিত স্রাবের রঙ কী হবে। শ্বেতপ্রদরের অন্যতম ও প্রধান কারণ হচ্ছে যোনিপথের ইনফেকশন বা জীবাণু দূষণ এমনকি সেক্ষেত্রে যদি নিঃসরণ কোনোরকম ইনফেকশন ছাড়াই ঘটে তবে তাকেও শ্বেতপ্রদর বা লিউকোরিয়াহিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনও যদি হয় যে, যোনি বা জরায়ুগ্রীবায় ক্যান্সারের কারণেও রক্তাভ যোনি নিঃসরণ ঘটে তাকেও লিউকোরিয়া ধরা হয়। উপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, লিউকোরিয়ার প্রধান কারণ ইনফেকশন। প্রধান যে দুটো জীবাণু লিউকোরিয়ার জন্য দায়ী তা হলো ট্রাইকোমোনাস ভ্যাজিনালিস এবং ক্যানডিডা এলবিকাসন। দুটো রোগই যৌনমিলনের মাধ্যমে ছড়ায়। এর ভয়াবহতার গুরুত্ব বিবেচনা করে রোগ দুটোকে লঘু যৌনরোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া গার্ডনেরেলা ভ্যাজিনালিস, মাইকোপ্লাসমা হোমিসিন, ইউরিয়াপ্লাসমা ইউরিয়া লাইটিকাম, গনোকক্কাস, ক্লামাইডিয়া, হারপিস সিমপ্লেক্স ইত্যাদি জীবাণুর কারণে বিভিন্ন রকমের ও রঙের নিঃসরণ ঘটতেপারে। তবে এই প্রতিবেদনে মূলত প্রথম গুরুত্বপূর্ণদুটো জীবাণুর উপরেই আলোচনা সীমিত রাখা হবে।
ক্যানডিডিয়াসিস
এর আরেকটি নাম মলিলিয়াসিস এবং এ রোগ যে ছত্রাক জীবাণু দিয়ে হয় সেজীবাণুটির নাম ক্যানডিডাএলবিকাসন। অতি প্রাচীন এ রোগ। তবে এ জীবাণু আবিষকৃত হয়েছে ১৯৩৯ সালে। যে বিজ্ঞানী একে আবিষকার করেন তার নাম ল্যানজেনবেক। এই জীবাণুগুলো মুখ, গলা, বৃহদন্ত্র এবং যোনিপথে সচরাচর সংক্রমণ ঘটায়। তারা ভেজা এবং গরম স্থানেঅতি সহজেই আক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। তবে শুষক স্থানে (ত্বকে) তারা কখনোই আক্রমণ ঘটাতে পারে না। তাই তারা মুখ থেকে শুরু করে ফুসফুস, যোনি, ভেজা ত্বক বা চামড়ার ভাঁজ, অন্ত্রনালি ইত্যাদি স্থানে সংক্রমিত হয়। এটা নারী বা পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই সংক্রমিত হয়ে থাকে।
পুরুষের ক্ষেত্রে উপসর্গ
পুরুষের ক্ষেত্রে প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া বা যন্ত্রণা অনুভূত হয়। প্রস্রাবের পথে চুলকানি এবং সাদা পদার্থের নিঃসরণ, যা পরিমাণে খুবই কম হয়ে থাকে।
পুরুষের ক্ষেত্রে প্রস্রাবের নালির অগ্রভাগে লক্ষ করলে প্রদাহজনিত লালচে ভাব দেখা যায়। মহিলাদের অনেক ক্ষেত্রেই এ রোগের কোনো উপসর্গ থাকে না। যাদের থাকে তাদের সাদা স্রাব বাঅন্য রঙের যোনি নিঃসরণ, যোনিপথের চুলকানি, প্রস্রাবের পথে জ্বালা-যন্ত্রণা। কারো কারো ক্ষেত্রে সহবাসের সময় ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। যোনিপথ পরীক্ষা করলে প্রদাহের কারণে ফোলা লালচে ভাব দেখা যায় এবং ভেতরে যে নিঃসরণ দেখা যায় তা পানিরমতো এমনকি চুনের পানির মতো দেখা যেতে পারে।
রোগ নির্ণয়
এ ক্ষেত্রে সাধারণ ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে ছত্রাক নির্ণয় করা যায় ঠিকই, তবে সাধারণত তাকরা হয় না। রোগের উপসর্গ বা লক্ষণ শুনেই চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। একটা কথা জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, এইজীবাণু আমাদের দেহে বিশেষ করে গলা, মুখে, বৃহদন্ত্রে, যোনিপথে পরজীবী হিসেবে কোনোরকম ক্ষতি করা ছাড়াই মানবদেহে বসবাস করে। তবে নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে। অন্তঃসত্ত্বা হলে, ডায়াবেটিস দেখা দিলে, কর্টিসোন গ্রুপের ওষুধ সেবন করলে, স্বাস্থ্যহীনতা ও দুর্বলতায় ভুগলে, বেশি পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক খেলে, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খেলে, খাবারে বেশি পরিমাণসুগার খেলে দেহের অভ্যন্তরে (বৃহদন্ত্রের)নিষিক্রয় জীবাণু সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আবার আমাদের দেহে ত্বরিত আক্রমণ ঘটায়।
ট্রাইকোমোনিয়াসিস
এই রোগের জীবাণুটির নাম ট্রাইকোমোনাস ভ্যাজিনালিস। ভ্যাজিনালিস শব্দটি শুনলে মনে হয় যেন ভ্যাজিনা থেকে এসেছে। সেই কারণে স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় যেন এ রোগ বুঝি শুধু মহিলাদের হয়। আসলে কিন্তু সেটা নয়। নারী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই এ রোগটি হতে পারে। এ জীবাণু দেখতে ডিম্বাকৃতির এবং শ্বেতকণিকার চেয়ে কিছুটাবড়। এই জীবাণুটি যোনিপথ ছাড়াও কিডনিতন্ত্রের নিচের অংশে আক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। এটিও অন্যান্য যৌনরোগের মতো সহবাসের মাধ্যমে একের থেকে অপরের দেহে সংক্রমিত হয়। আক্রান্ত রোগীর অন্তর্বাস ব্যবহার করলেওসংক্রমিত হতে পারে। জীবাণু শরীরে প্রবেশের ৪-১২ দিনের মধ্যে রোগের উপসর্গ দেখা দেয়।
উপসর্গ
অধিকাংশ আক্রান্ত পুরুষের ক্ষেত্রে এ রোগের কোনো উপসর্গ থাকে না। অনেকের ক্ষেত্রে অল্প পরিমাণ মূত্রনালি নিঃসরণ থাকতে পারে। প্রস্রাবের রাস্তায় সামান্য পরিমাণ জ্বালা-যন্ত্রণাও থাকতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে যোনিরনিঃসরণ, যা পাতলা থেকে শুরু করে হলদে রঙেরও হতে পারে। যোনিপথের চুলকানি, তলপেটের ব্যথা, ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া এবং জ্বালা-যন্ত্রণাও এক সাথে থাকতে পারে।
এ রোগটিনির্ণয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত ল্যাবরেটরি পরীক্ষার সাহায্য ছাড়াই চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। তবে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে রোগটি শনাক্ত করা যায়।
চিকিৎসা
এক্ষেত্রে অন্যান্য যৌনরোগের মতোই স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই এক সাথে চিকিৎসার প্রয়োজন। ট্যাবলেট মেট্রোনিডাজল-২৫০ মিলিগ্রাম রোজ ৩ বার,৭ দিন পর্যন্ত দিতে হবে। অথবা এক সাথে ২ গ্রাম মেট্রোনিডাজল অর্থাৎ ৪০০মিলিগ্রামের সাড়ে ৪টি বড়ি এক সাথে খেতে হবে। ক্যানডিডা এলবিকাসনের ক্ষেত্রে ক্লোট্রিমাজল ১% ভ্যাজিনাল ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে। ক্লোট্রিমাজল ভ্যাজিনাল ট্যাবলেট রোজ ২ বার ৬ দিনপর্যন্ত ব্যবহার করলেও খুব ভালো ফল পাওয়া যায়।
রিপোর্ট
মনোজগত

কোন মন্তব্য নেই :