স্ত্রীরোগে ল্যাপারোস্কপির ভূমিকা ডা. সামসাদ জাহান শেলী

কোন মন্তব্য নেই
নারীর ভূমিকা এখন আর জননী, জায়া ও কন্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে আর্থসামাজিক এবং জাতীয় রাজনীতিতে আমাদের দেশের নারীর রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা শুধু নারীর প্রাপ্য অধিকারকেই নিশ্চিত করবে না বরং বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পরিবার, সমাজ ও দেশের সমৃদ্ধি তাতে ত্বরান্বিত হবে।
সৃষ্টিকর্তা নারীদের সন্তান ধারণের মহান ও পবিত্র সমমান অর্পণ করেছেন। এ জন্য নারীকে মাতৃত্বের স্বর্গীয় অনুভূতি লাভের পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রভূত সক্ষমতা অর্জন করতে হয়। কখনো কখনো এর ব্যত্যয় নারীজীবনে চরম দুর্দশা নিয়ে আসে। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ সত্য আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
নানা শারীরিক সমস্যা একজন নারীর গর্ভাবস্থায়, তার আগে ও পরে দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে সঠিক ও সর্বোত্তম চিকিৎসা নারীরজন্য অত্যাবশ্যকীয়।
কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণে আমাদের নারীরা এখনো পুরোপুরি সচেতন নয়।
স্ত্রীরোগগুলোর বেশ কিছুযেমন শুধু জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন এনে এবং কিছু ওষুধ চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সেরে যায়। আর কিছু রোগ আছে সেগুলোতে অপারেশন বা শল্য চিকিৎসা একান্তই অপরিহার্য। আর এদিকটায় রয়েছে অনেকের প্রবল ভীতি।
অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা, অপারেশন মানেই হলো কাটাছেঁড়া, বিশাল ক্ষত, অনেক রক্তপাত আর ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত দিয়ে তা পূরণ, অপারেশনের পর জ্ঞাননা ফেরা, অনেক দিন হাসপাতালে কষ্টকর অবস্থান, সৌন্দর্যহানি, অনেক টাকার বিশাল বিলের বোঝা ইত্যাদি। আসলেই কি সব সময় এমনটি ঘটে? না, এ ধারণা আজকাল আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। আমাদের মাঝে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে ল্যাপারোস্কপিক পদ্ধতি। শল্য চিকিৎসায় ল্যাপারোস্কপির ব্যবহার অস্ত্রোপচারকালীন সফলতা যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি কমিয়েছে অপারেশনের সময়েরজটিলতা এবং অপারেশনের পরের সময়ের দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফেরার নিশ্চয়তা। এখন দেখা যাক স্ত্রীরোগে ল্যাপারোস্কপির ব্যবহার। এর ব্যবহার মূলত দুভাবে করা হতে পারে-
*. রোগ নির্ণয়ে
*. রোগ নিরাময়ে বা চিকিৎসায় যেমন লক্ষণ একজন নারীকে ল্যাপারোস্কপির শরণাপন্ন করতে পারে
*. মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ অথবা মাসিকের সময়কাল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিহওয়া
*. মাসিকের সময় তীব্র ব্যথা অনুভূত হওয়া
*. অনিয়মিত মাসিক
*. তলপেটে ভারবোধ হওয়া অথবা কোনো চাকার অস্তিত্ব অনুভব করা
*. বন্ধ্যাত্ব
এসব লক্ষণের সাথে যেসব রোগ সাধারণত দায়ী তা হলো-
*. জরায়ুর টিউমার উদাহরণস্বরূপ ফাইব্রয়েড, এডিনোমিওসিস
*. এন্ডোমেট্রিওসিস
*. ওভারি বা ডিম্বাশয়ের বিভিন্ন ধরনের টিউমার
*. এডেহেসিওলাইসিস বা বিভিন্ন অঙ্গের জট ফুটানো
*. এস্টোপিক প্রেগন্যান্সি বা জরায়ুর সঠিক স্থানের ভ্রূণের বিকাশ
*. বন্ধ্যাত্ব ইত্যাদি
এ পদ্ধতির সুবিধা হলো-
*. পেট না কেটে শুধু ৩-৪টাফুটার মধ্য দিয়ে পুরো অপারেশন শেষ করা
*. অপারেশনের জায়গা এবং আশপাশের গঠন ভালোভাবে দেখতে পাওয়া
*. অপারেশনকালীন ন্যূনতম রক্তক্ষরণ
*. তুলনামূলক ব্যথানাশক ওচেতনানাশকের কম ব্যবহার
*. অপারেশন-পরবর্তী ব্যথাকম অনুভূত হওয়া ও দ্রুতসেরে ওঠা
*. অপারেশনকালীন ও পরবর্তীতে জীবাণু সংক্রমণের হার কম থাকা
*. নারী প্রজনন স্বাস্থ্যন্যূনতম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া
*. দ্রুত স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্রে ফেরত যাওয়া
*. হাসপাতালে অবস্থানকালীন সময় বিবেচনা করলে তুলনামূলক কম খরচ।
আর অসুবিধা খুব একটা নেই বললেই চলে। যন্ত্রপাতির উচ্চমূল্য আর দক্ষ জনশক্তির ঘাটতিই আমাদের দেশে এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা।
কিছু ভ্রান্ত ধারণা
অনেকে সংশয়ে থাকেন ছোট ফুটোর মধ্য দিয়ে কী করে বড় টিউমার বের করে আনা সম্ভব। আসলে এজন্য অনেক ধরনের কৌশল অবলম্বন করা যায়। উদাহরণস্বরূপ জরায়ুর টিউমার অপারেশন করার পর মাসিকের রাস্তাদিয়ে বের করে আনা সম্ভব। অনেকের মাঝেই একটা ধারণা কাজ করে ল্যাপারোটসি বা পেট কেটে অপারেশন করলে বোধ হয় অপারেশন এরিয়া ও তার আশপাশটা ভালো দেখা যায়। আসলে ক্যামেরার সাহায্যে করলে ভালোভাবে দেখা সম্ভব।
ল্যাপারোস্কপি আমাদের দেশে প্রচলিত হয়েছে ৯০-এর দশকে। যদিও উন্নত বিশ্বে ৭০ দশক থেকেই এর চল বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হয়েছে। আর স্ত্রীরোগ চিকিৎসায় এর ব্যাপক প্রচলন সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে শুরু হলেও দ্রুত এর প্রসার ঘটছে এবংদক্ষ পেশাজীবী গড়ে উঠছে। আমাদের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞগণ দেশ-বিদেশে নানা প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রতিনিয়ত নিজের উৎকর্ষতা বাড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেশের নারীরা এ উন্নত প্রযুক্তির সর্বোত্তম সেবা পাক-এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগ,বারডেম হাসপাতাল


♥♥♥♥সমাপ্ত♥♥♥♥
প্রকাশক : সৈয়দ রুবেল উদ্দিন
www.facebook.com/sayed.rubel3

কোন মন্তব্য নেই :