বিয়ের জন্য কেমন প্রস্তুতি চাই-মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব
বিয়ের প্রস্তুতি বলতে সাধারণত আমরা বুঝি টাকা-পয়সা জোগাড় করা বা বিয়ের
প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম কেনাকাটা ইত্যাদি। বাস্তবে বিয়ের প্রস্তুতি হলো
বিয়ে-পরবর্তী বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ
করা। বিয়ে করার পর অনেককেই প্রতিকূল পরিস্থিতি ও বিভিন্ন পেরেশানিতে পড়তে
হয়। পারিবারিক দ্বন্দ্ব এর অন্যতম। বিয়ে করার সাথে সাথেই অনেকের বাবা-মা,
ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনের সাথে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
মায়ের অভিযোগ হলো, ছেলে বিয়ে করার পর বউ ছাড়া কিছুই বোঝে না। ভাইবোনদের
অনুযোগ হলো, ভাই বিয়ে করার পর আমাদের খোঁজখবর রাখে না। এভাবে একেক
আত্মীয়ের একেক অভিযোগ। এ ধরনের হাজারও অভিযোগ ও অনুযোগে ‘বেচারা’ বিয়ে করেই
চরম হতাশায় পড়ে যায়। তাই বিয়ের আগেই উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয়
পদক্ষেপ নেয়া ও মানসিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করার
নামই হচ্ছে বিয়ের প্রস্তুতি। একটি যুবক ছেলে এত দিন যে জীবন পার করে আসছিল,
বিয়ের মাধ্যমে সে সেই জীবন পরিত্যাগ করে দায়িত্বশীল একটি জীবনে পদার্পণ
করে। এ জীবনে তার কিছু দায়িত্ব আছে, কিছু পেরেশানি আছে। তাই বিয়ে এক দিকে
যেমন আনন্দের, অন্য দিকে তা দায়িত্বের। আজকের যুবক, বিয়ে করার সাথে সাথে
হয়ে যাবে দায়িত্ববান স্বামী। তার থাকবে স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব, বাবা-মায়ের
প্রতি দায়িত্ব, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়িত্ব। মোট কথা, বিয়ে মানেই
দায়িত্ববান একজন মানুষে পরিণত হওয়া। স্বামী-স্ত্রীকে মনে রাখতে হবে,
প্রাকৃতিক নিয়মে স্বামী-স্ত্রী হয়ে যাওয়া সহজ; তবে আদর্শ স্বামী-স্ত্রী
হওয়ার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ দিনের শিক্ষা ও দীক্ষা। দাম্পত্যজীবনে যারা
বেশখানিকটা পথ পাড়ি দিয়েছেন বা যারা দাম্পত্যের পড়ন্ত বিকেল পার করার
প্রতীক্ষায় আছেন, তাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। আফসোসের বিষয় হলো,
আমাদের সমাজের বেশির ভাগ স্বামী-স্ত্রী এ দিকটির প্রতি চরম অনাগ্রহী। ক’জন
স্বামী-স্ত্রী আদর্শ স্বামী-স্ত্রী হতে প্রস্তুত? স্বামী-স্ত্রী হওয়ার অল্প
কিছু দিনের মধ্যেই আসে বাবা-মায়ের অধ্যায়। সেটা আরো জটিল ও কঠিন অধ্যায়।
বাবা-মা তার সন্তানের সাথে কেমন আচরণ করবে, কিভাবে তার নবাগত সন্তানকে
শিক্ষাদীক্ষায় বড় করে গড়ে তুলবে, বাবা-মাকে তার সব কিছুই শিখতে হয়।
বিয়ের পর একজন নবাগত নারী স্বামীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে আগমন
করেন। যিনি তার বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন, শৈশব স্মৃতি সব কিছু ফেলে
এমন একজন পুরুষের হাত ধরে চলে আসে, যার সাথে তার না ছিল কোনো পরিচয়, না ছিল
কোনো আত্মীয়তা। শুধু একটি পবিত্র বন্ধনের ফলে তারা একত্র জীবনযাপনে
প্রস্তুত হয়ে যায়। জীবনসঙ্গিনী হিসেবে যে নারী আসে সে যেমন স্বামীর দুঃখেরও
সঙ্গী হয়, সুখেরও সঙ্গী। সারা জীবন একসাথে কাটে একজন পুরুষ ও একজন নারীর
জীবন। তাই স্বভাবতই স্বামীর কাছ থেকে নারীর অনেক কিছু চাওয়া-পাওয়ার থাকে।
চাওয়ার থাকে স্বামীর আদর-সোহাগ, প্রেম-ভালোবাসা।
অপর দিকে বেশির ভাগ পরিবারে ছেলেরা বিয়ে করলে মায়ের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে
যায়। কারণ, মা দেখেন তার ছেলে এত দিন তার ছেলে থাকলেও ছেলের বউ রূপে তার
ঘরে যে মেয়েটির অনুপ্রবেশ ঘটেছে সে তার ছেলেকে এখন তার থেকে দূরে সরিয়ে
রাখতে চাইছে। ছেলে এখন মায়ের নেই; নবাগত বউয়ের। এত দিন যে ছেলের ওপর মায়ের
ছিল অখণ্ড অধিকার, এখন তার ওপর প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে স্ত্রী-পরিচয়ে এক নারীর
অধিকার। আর মায়ের অধিকার খণ্ডিত হতে চলেছে। এই বাস্তবতা মা না পারেন মেনে
নিতে, না পারেন অস্বীকার করতে। এই সময় মায়েরা এক অন্তর্জ্বালায় ভোগেন, যা
তিনি কাউকে বোঝাতে পারেন না; এমনকি নিজের ছেলেকেও না। তাই সামান্য থেকে
সামান্য কারণে তিনি খুব সংবেদনশীল হয়ে পড়েন, তার অনুভূতি চরমভাবে আহত হয়। এ
সময় যদি ছেলে বা ছেলের বউয়ের কাছ থেকে কোনো অমার্জিত ও অশোভন আচরণ পান,
তখনই মায়ের মনে পড়ে যায় প্রসববেদনা থেকে নিজের জীবনকে তিলে তিলে ক্ষয় করে
সন্তানকে গড়ে তোলার সব কষ্ট। মায়ের মনে কষ্টের আর শেষ থাকে না। সুতরাং
বিয়ের সবচেয়ে বড় প্রস্তুতি হলো, মা ও স্ত্রীর অনুযোগ ও অভিযোগগুলোকে সামাল
দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়া। হেকমতের সাথে তাদেরকে বোঝানো।
স্ত্রীকে বোঝাতে হবে যে, তুমি আমার জীবনসঙ্গিনী। তোমার সুখ-দুঃখে আমি পাশে
আছি। আমার সুখ-দুঃখে তুমি পাশে থাকবে। তুমি আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ,
আমি তোমার জীবনের অপরিহার্য অধ্যায়। সুতরাং আমাদের মাঝে ভালোবাসা, যা মূলত
ঐশী নেয়ামত তা চির অটুট থাকবে। অপর দিকে মাকে বোঝাতে হবে, মা! আমি তোমার
ছিলাম, তোমার আছি, তোমারই থাকব। এত দিন তোমার সেবায় আমি একা নিয়োজিত ছিলাম।
এখন তোমার সেবা করার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা আমার সহযোগী দান করেছেন। তাই
তুমি আমাদেরকে যখন যা লাগবে, বলবে। তোমার সেবাযত্নে আমাদের সহযোগিতা করবে
পরামর্শ দিয়ে, শাসন দিয়ে। আরেকটি কথা মা! আমি তোমার সন্তান, তোমাকে আমি মা
বলে ডাকি। এই ডাকটি পাওয়ার জন্য তুমি কত কষ্ট করেছ! দশ মাস দশ দিন গর্ভে
ধারণ করেছ। আমার সব আবর্জনা তুমি পরিষ্কার করেছ। শীতের রাতে
প্রস্রাব-পায়খানা করে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি, তুমি এসব কষ্ট হাসিমুখে বরণ
করেছ। এখন আমি তোমাকে মা বলে ডাকি। আর তোমার ঘরের নবাগত যে মেহমান এসেছে,
তার জন্য তুমি কিছুই করনি। অন্যের ঘরে লালিতপালিত একটি মেয়ে। তার পরও সে
তোমাকে মা বলে ডাকে। এর চেয়ে তুমি আর কী চাও? সুতরাং তুমি মনে রেখো মা!
আমার কাছ থেকে তুমি যতটুকু আশা করতে পারো, তার কাছ থেকে ততটুকু আশা করতে
পারো না। সে তোমাকে ততটুকু দেবে না, যতটুকু আমি দেবো। সেটা মেনে নিয়েই জীবন
চালাতে হবে মা! এভাবে মাকে বোঝাতে হবে। এভাবে বোঝাতে পারলে সাংসারিক
জীবনের অনেক ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতে পারব, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : খতিব
আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুণ।
আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুণ।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
কোন মন্তব্য নেই :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন