দিনবদলের সাংসদ! সোহরাব হাসান | তারিখ: ০৫-০১-২০১২, ১
কোন মন্তব্য নেই
আওয়ামী লীগ দিনবদলের সনদ ঘোষণা করেছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে। আজ ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি।
আওয়ামী লীগ তার দিনবদলের সনদে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমিয়ে আনার কথা বলেছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিল। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা সমাধানের কথা বলেছিল। দারিদ্র্য মুক্তি ও বৈষম্য প্রতিরোধ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিল।
আওয়ামী লীগ গত তিন বছরে সেসব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারলেও দলের গুণধর সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদার বুধবার সুশাসন প্রতিষ্ঠার অনন্য নজির দেখিয়েছেন এক নারী সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে। ওই সাংবাদিকের অপরাধ, তিনি মিরপুরের মনিপুর স্কুলে ছাত্রভর্তির নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরির উদ্দেশে সেখানে গিয়েছিলেন। তিনি জানতেন না যে ওই স্কুল বা এলাকাটি কামাল মজুমদারেরজমিদারি। তাঁর অনুমতি ছাড়া সেখানে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।
প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, ‘ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মেরঅভিযোগের ব্যাপারে প্রতিবেদন তৈরি করতে আরটিভির সাংবাদিক অপর্ণাসিংহ, জ্যেষ্ঠ ক্যামেরাম্যান সাইদ হায়দার ও স্থানীয় প্রতিনিধি ওসমান গণি ওই স্কুলে যান। অভিযোগের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে তাঁরা স্কুলে ঢুকতে চাইলে বাধা দেওয়া হয়। প্রথমে নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে তাঁদের বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ভেতরে ঢুকলে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক হাত দিয়ে ক্যামেরা সরিয়ে দেন এবং তাঁদের ধাক্কাতে ধাক্কাতে প্রধান ফটকের বাইরে বের করে দেন।
এর কিছুক্ষণ পরই কিছু যুবকসহ প্রধান ফটকের সামনে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হন স্থানীয় সাংসদ ও স্কুলপরিচালনা পর্ষদের সভাপতিকামাল আহমেদ মজুমদার।
গাড়ি থেকে নেমেই কামাল মজুমদার ও তাঁর সঙ্গে থাকা যুবকেরা তেড়ে এসে সাংবাদিকদের উদ্দেশে গালাগাল শুরু করেন। একপর্যায়ে কামাল মজুমদারনিজেই সাংবাদিক অপর্ণার হাতে মোচড় দিয়ে বুম (শব্দধারক) কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলেন। এতে হাতে গুরুতর আঘাত পান অপর্ণা। খবর পেয়ে অপর একটি চ্যানেলের নারী সাংবাদিকসহ দুই সাংবাদিকঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তাঁদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেন সাংসদ।’ (প্রথম আলো ৪ জানুয়ারি ২০১২)।
এই হলেন দিনবদলের সাংসদ। তিনি মানুষের কল্যাণে কিছু করতে না পারলেও সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করতে খুবই পারঙ্গম। কামাল মজুমদার সাংবাদিক লাঞ্ছিত করার কথা অস্বীকার করেছেন। যুদ্ধাপরাধী বা খুনের মামলার আসামিও দায় স্বীকার করেন না। কিন্তু ছবি মিথ্যা কথা বলে না।। গতকাল প্রথম আলোর অনলাইনে পাঠক ভিডিওতে দেখেছেন কামাল মজুমদার কী মারমুখী ভঙ্গিতে সাংবাদিক অপর্ণা সিংহের হাত থেকে শব্দধারক ছিনিয়ে নিয়ে মাটিতে ছুড়ে ফেলে দেন। এ জন্য কামাল মজুমদারের বিরুদ্ধে ছিনতাই ও দস্যুতার মামলা হতে পারে। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের ছবিতে দেখা যায়, কামাল মজুমদার সাংবাদিকের হাত থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নিচ্ছেন। ছবিতে অপর্ণার মোচড়ানো হাতটি আর দেখা যায় না। নিরীহ এক নারী সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করে এই বীরপুঙ্গব পার পেলেও সমবেত বিক্ষুব্ধ মানুষেরভয়ে লেজ গুটিয়ে স্কুল ভবনের ভেতরে চলে যান। কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারের পাহারায় সেখানথেকে মাইক্রোবাসে করে চলে যান।
এ ঘটনায় বিএনপি সরকারের আমলের শনির আখড়ার কথা মনেপড়ল। সে সময় পানি ও বিদ্যুতের দাবিতে সর্বস্তরের মানুষ যখন প্রতিবাদ করছিল, পুলিশ ও বিএনপির কর্মীরা তাদের বাধা দেন। বিক্ষুব্ধ জনতা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে সেখানে উপস্থিত বিএনপির তৎকালীন সাংসদ সালাহউদ্দিন আহমেদকে ধাওয়া দেয়। এরপর তিনি এমনদৌড় দিলেন, যা অলিম্পিক প্রতিযোগিতাকেও হার মানায়। সেই থেকে তিনি হয়েগেলেন দৌড় সালাহউদ্দিন।
তাহলে মিরপুরের সাংসদ কামাল মজুমদারকে মানুষ কী নামে চিনবে? সাংবাদিক নির্যাতনকারী। আমরা এত দিন জানতাম, সাংসদের কাজ আইন প্রণয়ন করা। এখন থেকেতাঁদের আরও একটি দায়িত্ব বাড়ল। সাংবাদিক পেটানো। এ ধরনের কাজ তিনি এর আগেওকরেছেন। পুলিশ বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পেটানো, অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা তাঁর কাছে কোনো ব্যাপারই নয়। আশুলিয়ায় গাড়ি আটকানোর জন্য পুলিশ কনস্টেবলের গায়েও হাত তুলেছিলেন এই সাংসদ। সুযোগ্য এই পিতার সুযোগ্য পুত্রও হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডিতহয়ে এখন আমেরিকায় পলাতক।
কয়েক দিন আগে বাংলা একাডেমীতে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনবাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। নারীর ক্ষমতায়নে শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসা করেছেন বিদেশি বহু রাষ্ট্রনেতা ও সংস্থা। প্রশংসা করেছে জাতিসংঘও। আমাদের ধারণা, নারীর এত প্রশংসা পুরুষ কামাল মজুমদারের পছন্দ হয়নি। এ কারণেই তিনি নারীসাংবাদিককে লাঞ্ছিত করেছেন। তাঁর হাত মোচড়ে দিয়েছেন।
আমাদের সমাজে এখনো নারীকে একটু বাড়তি সমীহ করা হয়। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান রেখে কথা বলা হয়। সাধারণত পুরুষের সঙ্গে আরেকজন পুরুষ যতটা উচ্চ স্বরে কথা বলেন, নারীর সঙ্গে সেভাবে বলেন না। কামাল মজুমদার তার উল্টোটাই করেছেন।
তিনি কোনো একজন নারীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ও ক্যাডার লেলিয়ে ক্ষান্ত হননি। নিজেই ক্যাডারের ভূমিকায়নেমেছেন। আওয়ামী লীগের সব পুরুষ সাংসদই যদি কামাল মজুমদারকে অনুসরণ করেন, তাহলে ঠিকই দিনের বদল হবে। জঙ্গিবাদিরা একভাবে নারীদের ঘরে আটকে রাখতে চায়, কামাল মজুমদারেরা আরেকভাবে।
এই অসভ্য ও অভব্য আচরণের মাধ্যমে কামাল মজুমদার কেবল একজন নারী সাংবাদিককেই অপমান করেননি। অপমান করেছেন বাংলাদেশের সমগ্র নারী সমাজকে, অপমান করেছেন তাঁর নেত্রী ও দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। অপমান করেছেন জাতীয় সংসদের সব নারী সদস্যকেও। এরপর নারী সাংসদেরা সংসদে এই নারী নির্যাতক সাংসদের পাশে বসবেন কী করে? তাঁদের কি একবারও অপর্ণা সিংহের কথা মনে পড়বে না?
আমাদের মনে আছে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ওই সময়ের সাংসদ জয়নাল আবেদিন হাজারি সংসদে দাঁড়িয়ে বাঁধন নামের একটি মেয়ে সম্পর্কে অশ্রাব্য ও অশালীন ভাষায় বিষোদ্গার করেছিলেন। সে সময় তাঁকে নিবৃত্ত করা হলে হয়তো আজ কামাল মজুমদার একজন নারী সাংবাদিককে এভাবে গালিগালাজ করতে বা গায়ে হাত তুলতে সাহস পেতেন না।

আরো
পড়তে থাকুন
দিনবদলের সাংসদ! ২

কোন মন্তব্য নেই :