গর্ভবতী মায়ের খিঁচুনি রোগের পরিচর্যা মোঃ আবদুর রহমান পাতা ১

কোন মন্তব্য নেই
গর্ভাবস্থায় মায়েদের যতো জটিলতা দেখা যায় তার মধ্যে খিঁচুনি সবচেয়ে মারাত্মক। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, এই সমস্যাকে একলাম্পসিয়া বলা হয়। একলাম্পসিয়া একটা গ্রিক শব্দ। যার শাব্দিক অর্থ আলোর ঝলকানি।গর্ভাবস্থায় ২৮ সপ্তাহ থেকে সন্তান প্রসবের ৪৮ ঘন্টা পর পর্যন্ত যে কোনো সময় হঠাৎ করে গর্ভবতী মায়েরা বিদ্যুৎ চমকের মতো আলোর ঝলকানি প্রত্যক্ষকরেন। এর ফলে পরক্ষণেই খিঁচুনি দিয়ে ফিট হয়েপড়েন। এ অবস্থাকেই একলাম্পসিয়াবা গর্ভকালীন খিঁচুনি বলে। এ সময় খিঁচুনি বা ফিট হওয়া ছাড়াও গর্ভবতী মায়ের শারীরিক ওজন অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পায়। তাপ্রায় পূর্ববর্তী ওজনের চেয়ে ১২ কেজি বেশি হতে পারে। প্রেসার বা রক্তের চাপ বেড়ে যায় এবং প্রসবের এলবুমিনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। আমাদেরদেশে এ রোগ সম্বন্ধে বাবা-মা কিংবা পরিবার প্রধানদের বিশেষ অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অবহেলার কারণে নিয়মিতভাবে প্রসব পূর্বকালীন বা এন্টিনেটাল পরীক্ষা না করানো এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণে শুধুমাত্র এ রোগেইগর্ভবর্তী মায়েদের মৃত্যুর হার১৬ শতাংশ। কাজেই গর্ভবতী মায়েরখিঁচুনি বা একলাম্পসিয়া রোগ প্রতিকারের জন্য সচেতন থাকতে হবে। প্রথম গর্ভধারণকারী মহিলাদের এরোগ বেশি হয়। একলাম্পসিয়া বা গর্ভকালীন খিঁচুনি রোগীর প্রায়৭৫ জনই প্রথম গর্ভধারণকারী মহিলা। তবে একলাম্পসিয়া একবার হলে পরবর্তী গর্ভধারণের সময় এরসম্ভাবনা বেড়ে যায়। গর্ভধারণেরপূর্ব থেকেই যাদের উচ্চ রক্তচাপ, বহুমত্র ও কিডনি সমস্যা থাকে সেসব গর্ভধারণকারীর এ রোগের প্রকোপ বেশি থাকে। এছাড়া গর্ভাবস্থায় জরায়ুতে অত্যধিক পানি জমা এবং যমজ গর্ভধারণ হলেও এ সমস্যা হওযার সম্ভাবনা বেশি থাকে। একলাম্পসিয়ার লক্ষণগুলো শরীরে পানি জমঃ দেখা যায় শতকরা ৫০ ভাগ মহিলার স্বাভাবিক গর্ভাবস্থায় শরীরে বিশেষ করে পায়ের দিকে কমবেশি পানি জমে। একলাম্পসিয়া রোগীদের সমস্ত শরীরেই অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে পানি জমে যায়। অত্যধিক ওজন বৃদ্ধি একজন গর্ভবতী মায়ের সাধারণত সর্বমোট ১০-১২ কেজি ওজন বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। গর্ভাবস্থার শেষদিকে গড়ে প্রতি সপ্তাহে ১/২ কেজি করে ওজন বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি এ রোগের একটি লক্ষণ। উচ্চ রক্তচাপ গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ বৃদ্ধি এ রোগের একটা প্রধান লক্ষণ। সমস্যা হলো আমাদের অধিকাংশ মা-ই সন্তান ধারণের পূর্বে রক্তচাপ পরীক্ষা করেন না, তাই গর্ভাবস্থায় পরীক্ষা করে রক্তচাপ কতোটুকু বাড়লো তা নির্ণয় করা অনেক বেশি মুশকিল হয়।প্রস্রাবে এলবুমিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং প্রস্রাব কমে যায়। কখনো কখনো রক্তহীনতা দেখাদেয়। গর্ভবতী মায়ের কাছে আলো অসহ্য লাগে, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে এবং বিদ্যুৎ চমকের মতো আলোর ঝলকানি দেখা দেয়। খিঁচুনি উল্লেখিত লক্ষণগুলো থাকলে তাকেপ্রি-একলাম্পসিয়া বা খিঁচুনির পূর্বকালীন অবস্থা বলা হয় এবং সঙ্গে যখন খিঁচুনি শুরু হয় তখন তাকে একলাম্পসিয়া বলা হয়। অনেকসময় উল্লেখিত লক্ষণগুলো খুবই ক্ষণস্থায়ী হয় এবং হঠাৎ করেই রোগীর খিঁচুনি শুরু হয়ে যায়। খিঁচুনির পূর্ব মুহর্তে মাথাব্যথা হয়, বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে, চোখ অন্ধকার হয়ে যায়। খিঁচুনি শুরু হলে মুখ বাঁকা হয়ে যায়, দাঁতের কামড়ে জিহ্বা কেটে রক্ত বের হতে পারে এবং সমস্ত শরীরে ঝাঁকুনি হতে হতে রোগী অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকে। একলাম্পসিয়া প্রতিরোধ এ রোগ প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো রোগীকে নিয়মিত এন্টিনেটাল চেকআপ। গর্ভাবস্থায় নিয়মিতভাবে চেকআপ করলে এ রোগ না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে গর্ভের ১২ সপ্তাহ বয়স থেকে ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতিমাসে একবার, ২৮ সপ্তাহ থেকে ৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত মাসে দুইবার এবং ৩৬ সপ্তাহ থেকে সন্তান প্রসবের আগ পর্যন্ত সময়ে সপ্তাহে একবার করে এন্টিনেটাল চেকআপ করা উচিত। এতে গর্ভধারিণীর রক্তের চাপ, রক্তের সুগার, বাচ্চা ও জরায়ুর অবস্থা ও অন্যান্য অনাকাক্ষিত কোনো জটিল উপসর্গ সহজেই এড়ানো যায় এবং একলাম্পসিয়াও প্রতিরোধকরা যায়। তবে যদি অজ্ঞতা ও নিয়মিত এন্টিনেটাল চেকআপের অভাবে একলাম্পসিয়া দেখা দেয়, তখন রোগীকে নিকটস্থ কোনো হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে কারণএ অবস্থায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা একমাত্র হাসপাতালেই সম্ভব। একলাম্পসিয়া বা খিঁচুনি রোগীর পরিচর্যা একলাম্পসিয়া রোগীর পরিচর্যার ক্ষেত্রে রোগীকে স্বল্প আলোযুক্ত নির্জন (আধো আলো, আধো অন্ধকার এমন) ঘরে শুকনো নরম বিছানায় শায়িত রাখতে হবে, খেয়ালরাখতে হবে গায়ে যেন ঘাম বসে না যায়। তাহলে শেস্নষ্মার চাপ দিতে পারে। রোগীর গায়ের সাধারণপোশাক খুলে ফেলে তাকে অবশ্যই পাতলা কোনো কাপড় পরাতে হবে এবং গায়ে অল্প অল্প বাতাস করতে হবে। রক্তচাপ বেড়ে গেলে রোগীর মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালতে হবে এবং প্রয়োজনে বরফও দেয়া যেতে পারে। খিঁচুনির সময় রোগীর হাত-পায়ে যেন শক্ত কোনোকিছুর আঘাত না লাগে। রোগী যখন রোগ যন্ত্রণায় লাফ-ঝাঁফ করতে থাকে তখন তাকে অতি সাবধানে ধরে রাখতে হবে। খিঁচুনিতে হাত, পা, ঘাড় ইত্যাদি বেঁকে যেতে থাকলে সাবধানে আস্তে আস্তে সেসব অঙ্গসোজা করে দিতে হবে।রোগীর জিহ্বায় যাতে দাঁতের কামড় না লাগে সেজন্য দুই সারি দাঁতের মধ্যে নরম কাপড় বা স্পঞ্জ দিয়ে রাখতে হবে। মুখ দিয়ে বেশি পরিমাণ লালা বা ফেনা নির্গত হতে থাকলে তা সাবধানে পরিষ্কারকরে দিতে হবে। যেন কোনোক্রমেই মুখে বেশি পরিমানে থুথু, লালা বা ফেনা জমে না থাকে। রোগীর জিহ্বা যাতে শুকিয়ে না যায় সেজন্য মাঝেমধ্যে, অল্প পরিমাণে ঈষদুষ্ণ গরম পানি পান করাতে হবে। রোগীর প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেলে বা প্রস্রাবের থলিতে প্রস্রাব বেশি পরিমাণে জমে গেলে তা ক্যাথেটার দিয়ে বের করে দিতে হবে। কখনো কখনো প্রয়োজনে রোগীকে ডাকাডাকি করা যাবে না। তার পাশে গিয়ে আবেগ আপস্নুত হয়ে উচ্চস্বরে ডাকা যাবে না। প্রয়োজনে রোগীকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেরাখতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই :