আমি নষ্টা নই, আমি মা রহিমা আক্তার part 1
‘মায়ের মতো আপন কেউ নাই গো’, ‘মা গো মা ও গো মা আমারে বানাইলা তুমি দিওয়ানা’, ‘মায়ের একদার দুধের দাম কাটিয়া গায়েও চাম পাপোস বানাইলে ঋণের শোধ হবে না’-এ রকম শত শত গানের মাঝে লুকিয়ে আছে আমাদের মা, আমাদের গর্ভধারিণী। কবি সাহিত্যিক গীতিকার সুরকার প্রযোজক থেকে শুরু করে সবাই সব মাধ্যমেমাকে নিয়ে গল্প কবিতা গাননাটক চলচ্চিত্র করেছেন। পৃথিবীতে এই একটি শব্দ, মাত্র একটি বর্ণের শব্দ, যার অর্থ কাউকে অভিধানে খুঁজতে হয় না। এটা এমন একশব্দ, এমন এক বন্ধন যার কোনো প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। সভ্যতার আধুনিক যুগেও হয়তো প্রশ্ন আসে, এই সন্তানের বাবা কে? কিন্তু মায়ের ক্ষেত্রে এর প্রমাণ নিষ্প্রয়োজন। যার গর্ভে বড় হওয়া সেই মা। যে ৯ মাস ১০ দিন তার উদরে বড় করে সেই মা। মা ছাড়া সন্তানের জীবন মূল্যহীন। সন্তানের মা থাকবে এটাই নিয়ম। হয়তো প্রশ্ন আসবে যে বাবাও তো থাকবে, হ্যাঁ থাকবে। একটাসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত তার মাকে বেঁচে থাকতে হবেই। মা তুমি আমাদের জীবনের সব। পৃথিবীর সব মাকে সালাম জানাই। ১৯৯০ সালে বিবাহিত জীবনের দুই বছর অতিবাহিত। নিজের জীবনের একাকিত্বকে দূর করতে মা হওয়ার ভাবনায় পড়া। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাস আমার সন্তান আমার গর্ভে। ডাক্তার আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে বলেন। সাথে আছে খালা। পরীক্ষার পর খালা ডাক্তারকে বলছে ‘বেবি কী, ছেলে না মেয়ে’। ডাক্তার বলে, ‘এটা কি প্রথম বাচ্চা?’ আমি ‘হ্যাঁ’ বলাতে ডাক্তার বলে ঠিক আছে কোনো অসুবিধা নেই। বাচ্চা ভালো আছে। ছোটবেলা থেকে মেয়ে বাচ্চা খুব পছন্দ। সন্তান পেটে আসার পর থেকেই ভাবনা, আমার যদি কন্যাসন্তান হয় খুব ভালো হবে। অনেক ার চুপে চুপে সৃষ্টিকর্তাকে কন্যাসন্তানের কথাও বলেছি। ডাক্তার মার্চ মাসের প্রথম ১০ দিনের কথাবলে। প্রতিদিন কতবার যে ক্যালেন্ডার দেখেছি, দিন আর শেষ হয় না। সন্তান পেটে নড়ছে, ঘুমাচ্ছে, খাচ্ছে সব অনুভূতির মাঝে টের পাচ্ছি। আমার অস্তিত্বজুড়ে শুধুই সন্তানের ভাবনা। মার্চের৬ তারিখ। আমি থাকতাম ঢাকাথেকে কিছুটা দূরে। ৬ তারিখ চলে আসি ঢাকায়। ক্যান্টনমেন্টে এক মামা ও খালা থাকতেন।মামা আর্মির ডাক্তার। বাচ্চা হওয়ার পর খালার বাসায় থাকব বলে আগে মামারবাসায় থাকি। নিয়মিত ডাক্তারি পরীক্ষা চলছে। শাশুড়ি হেলথে চাকরি করেন। ডেলিভারি নিজেও করাতে পারেন, তার মাঝে ঘরে ডাক্তার আছে। এরই মাঝে আর্মির জেনারেল হাসপাতালে একটা সিটের কথাও বলা আছে। ৮ তারিখ থেকে শরীর একটু একটু অসুস্থ। দেশের রাজনৈতিক অবস্থাও ভালো না।
৯ তারিখথেকে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক পড়ে। ঢাকা শহরেও গাড়ি চলাচল বন্ধ। ৯তারিখ সন্ধ্যায় হঠাৎ পেটে ব্যথা অনুভব করি। সম্ভব হলে বাসায়ও বাচ্চা হতে পারে, সেই হিসেবে প্রাথমিকভাবে যা কিছু প্রয়োজন সব রেডি করা। একটু একটু করে ব্যথা বাড়ছে। সবার দৃষ্টি আমার দিকে। আমায় এক গ্লাস গরম দুধ খেতে দেয়। দুইটা ডিম খেতে দেয়। আবার বারান্দায় গ্রিল ধরে হাঁটতে বলে। সবার অপেক্ষা কখন দেখাব সেই মুখখানা, শাশুড়ি নিজেই চেকআপ করবেন, বলেছেন সব ঠিক আছে। ব্যথা ক্রমে বাড়ছে কিন্তু ডেলিভারি হচ্ছে না। মামিকে বলি, আমায় কিছু ওষুধ দিন, তাহলে ব্যথা আরো বাড়বে আরসোনামণিকে দেখতে পাব। বাসার নিচে গাড়ি ঠিক করা।রাত একটা, আর অপেক্ষা না করে সবাই আমায় নিয়ে যায় হাসপাতালে। ডাক্তার দেখছেন, তারা নরমাল ডেলিভারির চেষ্টা করছেন।রাত শেষ হয়ে সকাল পার হচ্ছে, ক্রমে বাবুর নড়চড়াবন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ঘড়ি ধরেডাক্তার দেখছেন বাচ্চা খুব ধীরগতিতে নড়ছে। চিন্তিত ডাক্তার, আর অপেক্ষা করা যাবে না। সিজারের প্রস্তুতি নিতে হবে। ডাক্তার আপা বলছেন, বাচ্চার হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সবার মাঝে টেনশন। সিজারের কথা শুনে কোনো ভয় পাচ্ছি না, যা কিছু করার করুক, আমি আমারসন্তানের মুখ দেখতে চাই। এখনকার মতো তখন সব ছিল না। দুপুর থেকে খাওয়া বন্ধ করে দিল, সিজারের জন্য রেডি করা হচ্ছে।
সন্ধ্যায় এক এক করে ডাক্তার দেখছেন বাচ্চা একেবারেই নড়ছে না, আমাকে অন্য রুমে নিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হলো। আধা ঘণ্টা পর আমি বাচ্চার নড়া অনুভব করলাম। গাড়ি চলছে না, তারপর ইউনিভার্সিটি হল থেকে অনেক কষ্টে আপা আসে (বড় বোন)। আমার চারপাশে অনেক লোকজন, সবার অপেক্ষানতুন অতিথি দেখার। ব্যথার কষ্টে চিৎকার দিতেও লজ্জা পাচ্ছি। ডাক্তার আপার হাজবেন্ডও ডাক্তার। ওটিতে নিয়ে গেল। আমার শরীর অর্ধেক অবশ করা হলো। বোধশক্তি নাথাকলেও জ্ঞান আছে। একজন ডাক্তার মাথার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আস্তে আস্তে কথা বলছে,ওটিতে ৬-৭ জন ছিল। ঘড়ির সময় দেখছি। হঠাৎ একটু বমিভাব হয়, ডাক্তার একটু চিন্তিত হয়। প্রায় আধা ঘণ্টা পর আপা বলছে, তোমারএকটা সুস্থ সন্তান হয়েছে। এই বলে নরম কাপড়ে জড়ানো এক নবজাতকের মুখ আমাকে দেখায়। আমি ওর মুখ দেখে আনন্দে আত্মহারা। ওর মুখ দেখে মনে হলো শীতের শেষ রাতে জোছনার আলো এসে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর পড়ছে। জোছনার আলোতে যেমন পৃথিবী আলোকিত, তেমনি ওর আলোয় আলোকিত হয়েছে পুরো হাসপাতাল।
পড়তে থাকুন part 2
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
কোন মন্তব্য নেই :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন