জন্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা প্রাচীন গ্রিসে প্রেম ও যৌনজীবনঃ

কোন মন্তব্য নেই
জনসংখ্যার আধিক্য’ জনিত সমস্যা বলতে বর্তমানে যা বোঝায় তা প্রাচীন গ্রিসে না থাকলেও অধিকাংশ পরিবার অধিকসংখ্যক সন্তান আকাঙ্ক্ষা করত না। কারণ পরিবারের সম্পত্তির বহু অংশে বিভাজন তারা পছন্দ করত না। তাছাড়া পরিবারে ছেলের চেয়ে মেয়ের জন্ম কমকাঙ্ক্ষিত ছিল। কারণ একদিকে মেয়েরা সকল কাজ করতে পারত না, অন্যদিকে বিয়ের সময় তাদের জন্য যে যৌতুক দিতে হতো তাতে পরিবারের সম্পত্তির পরিমাণ হ্রাস পেত।
প্লেটো তার আইনে দুটি সন্তানকেই সন্তোষজনক সংখ্যা বলে উল্লেখ করেছেন-একটি ছেলে ও একটি মেয়ে।
গ্রিক সমাজে আকস্মিক গর্ভধারণের ঘটনা শুধু বিবাহিত মহিলাদের জন্যই অবাঞ্ছিত ছিল না বরং বারাঙ্গনা ও বেশ্যাদের কাছেও অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।এই সমস্যা মোকাবেলার উদ্দেশ্যে গ্রিকরা যৌনকর্মের সময় নিরোধ পদ্ধতি গ্রহণ করত এবং অবাঞ্ছিত গর্ভসঞ্চারের ক্ষেত্রে গর্ভপাতও ঘটাত।কিন্তু এসব প্রক্রিয়া ব্যর্থ প্রমাণিত হলে শিশুহত্যা ও শিশু পরিত্যাগ করার ঘটনাও ঘটত। হিপোক্রেটিস, যিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিসেবে বিবেচিত তিনি মহিলাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না হলে গর্ভপাতের বিরোধিতা করেছেন এবং এ পরামর্শও দিয়েছেন যে, গর্ভসঞ্চার এড়াতে হলে মহিলাদের মাসিক ঋতুচক্রের নিরাপদ দিনগুলোতে যৌনকর্ম করতে হবে। আরেকটি পদ্ধতি ছিল ঋতুস্রাবের সময় যৌনকর্ম করা। লক্ষণীয় ব্যাপার যে,গ্রিকরা রজস্বলা রমণীর সাথে যৌনমিলনকে অপবিত্র বিবেচনা করত না। যৌনমিলনের পর তাদের পরিচ্ছন্ন হতে হতো।
পুরুষের শুক্রাণু বিনষ্টকরার প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ ও বিষ অথবা জন্ম নিরোধকমূলক (যেমন সালফিউরাস আয়রন, কার্বনিক লিড ইত্যাদি) উপাদান প্রয়োগ করে প্রাচীন গ্রিকরা অলৌকিক ফল পেতে চাইত। ডায়োসকরিডেসের মতে, কোনো গর্ভবতী মহিলা যদি সিঁড়ি বেয়ে উঁচু স্থানে আরোহণ করে তাহলে তার গর্ভপাত ঘটবে। তিনি আরো বলেছেন, যদি কোনো মহিলা অ্যাসপারাগাসের শিকড় বাহুতে তাবিজের মতো ধারণ করে তাহলে তার গর্ভসঞ্চার হবে না। প্লিনি (Plimy) নামে আরেক বিজ্ঞ ব্যক্তি জানিয়েছেন, কোনো গর্ভবতী মহিলা যদি কাকের ডিম ভক্ষণ করে তাহলে তার গর্ভপাত ঘটে।
তখনকার দিনের আরেকটি ব্যাপক আলোচিত গর্ভনিরোধপদ্ধতি ছিল যৌনকর্মে বাধার সৃষ্টি অর্থাৎ স্ত্রীর যোনির বাইরে বীর্যপাত।
গ্রিক সমাজে পুরুষদের বিবাহবহির্ভূত নারী সংসর্গ পরিতৃপ্তি লাভ ও তাদের যৌনবাসনা চরিতার্থকরার জন্য যথেষ্ট ছিল বলেই হয়তো স্ত্রীদের সাথে তাদের যৌনমিলন খুব বেশি হতো না। অবশ্য দুর্ঘটনাবশত কোনো মহিলারযদি গর্ভসঞ্চার হতো তাহলে তাকে স্বেচ্ছায় গর্ভস্খলন (ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে অথবা কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করে) এবং গর্ভপাতের মধ্যে যে কোনো একটি বেছে নিতে হতো। অবাঞ্ছিত গর্ভের ক্ষেত্রে যদিও গর্ভবতী মহিলার সিদ্ধান্ত ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু স্ত্রী হলে তার স্বামী অথবা ক্রীতদাসী হলে মনিবের সমমতির প্রয়োজনও ছিল অপরিহার্য।
গর্ভপাতের বিরুদ্ধে কোনোআইন ছিল না এবং সংশ্লিষ্টমহিলার মনিবের অধিকার রক্ষার প্রশ্নেই শুধু নগররাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করত যে, মহিলাটি স্বাধীন না কি ক্রীতদাসী। কিন্তু যেহেতু ব্যাপারটি কার্যকর করা অত্যন্ত কঠিন ছিল, সেজন্য এখনকার মতো তখনো গর্ভপাতের ঘটনা ঘটত।
গর্ভপাতের নৈতিক দিক সম্পর্কে গ্রিক দার্শনিকরা তাদের নিজস্ববক্তব্য দিয়েছেন। প্লেটোতার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’-এ উল্লেখ করেছেন যে, ভ্রূণ কোনো মানুষ নয়। জন্মের পরই কেবল ভ্রূণ মানুষে পরিণত হয়। অতএব গর্ভপাতকে তিনি গ্রহণযোগ্য ও বৈধ বলে রায়দিয়েছেন। অন্যদিকে অ্যারিস্টটল পরামর্শ দিয়েছেন ভ্রূণের প্রাণ সঞ্চারিত হওয়া ও অনুভব করার আগেই অর্থাৎ ভ্রূণ প্রথম নড়াচড়া শুরু করার আগেই গর্ভপাত ঘটানোর।
কোনো অবাঞ্ছিত শিশুর জন্ম হওয়ার মুহূর্তেই সে শিশু অবৈধ হোক অথবা ইতিমধ্যেই পরিবারে যথেষ্ট সংখ্যক শিশুসন্তান রয়েছে এবং আরো একটি শিশু পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে-এই চিন্তা থেকে শিশুটির হাত থেকে নিষকৃতি পেতে সংশ্লিষ্ট দম্পতি দুটি উপায়ের একটি গ্রহণ করত-শিশুটিকে হত্যা করে অথবা পরিত্যাগ করে। আইনে যদিও শিশুহত্যা নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল কিন্তু শিশু পরিত্যাগ রহিত করার কোনো আইন ছিল না। তাছাড়া শিশুহত্যাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হলেও শিশুহত্যার ঘটনা গ্রিক সমাজে নিয়মিত ঘটত। সপার্টায় অবাঞ্ছিত শিশুদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের। এর কারণও ছিল বিভিন্ন। নবজাত শিশুদের উপস্থাপন করা হতো সিনেটরদের কমিটিতে। তারা শিশুদের পরীক্ষা করত। দুর্বল ও বিকলাঙ্গ শিশুদের টেগেটাস (Taygetus) পর্বতের কাছে অ্যাপোথেটাই (Apothetai) নামে একটি গভীর গুহায় নিক্ষেপ করা হতো, যেখানে সপার্টানরা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদেরও নিক্ষেপ করত। সপার্টান সুপ্রজনন মানসিকতার আরেকটি প্রকাশ ছিল এটি।
অবাঞ্ছিত শিশুদের পরিত্যাগ করার পদ্ধতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষুধা ও অযত্নে পরিত্যক্ত শিশুগুলোর মৃত্যু ডেকে আনত। যা-ই হোক না কেন, এ সিদ্ধান্ত নিতে হতো শিশুর জন্মের পরপরই এবং ১০ দিনের বেশি বিলম্বিত হতে পারত না। কারণ শিশু জন্মের দশম দিবসের পর এথেন্সে শিশুর নাম দেয়া হতো এবং সেই মুহূর্ত থেকে শিশুটির অস্তিত্ব সরকারিভাবে স্বীকৃত হতো।
শিশুহত্যা অথবা পরিত্যাগ, দুটি ক্ষেত্রেই এর শিকার হতো অবৈধ সন্তান অথবা মেয়েশিশু। পরিত্যাগ করারপর যদি কোনো শিশু ঘটনাচক্রে বেঁচে থাকত তাহলে স্বাভাবিকভাবে পরিণত হতো দাসে এবং মেয়েদের পরিণতি ছিল বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়োজিত হওয়া। অবশ্য পরিত্যক্ত শিশুদের মধ্যে কিছু ভাগ্যবান যে ছিল না, তা নয়। যারা তাদের পেত তারা তাদের লালন-পালন করে বড় করত এবং কোনো না কোনো কারণে পরিবারে রেখে দিত। হারানো শিশুরা প্রাচীন গ্রিসের হাস্যরসাত্মক নাটক ও সাহিত্যের খোরাক ছিল এবং এসবের মাঝে তখনকার বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন ঘটত। প্রাপ্ত সকল বিবরণ হতে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে, প্রাচীন গ্রিসে অবাঞ্ছিত শিশুদের পরিত্যাগ করা ব্যাপকভাবেপ্রচলিত একটি সামাজিক পদ্ধতি ছিল।
অনুবাদঃ আনোয়ার হোসেইন মঞ্জ
মনোজগত

কোন মন্তব্য নেই :