বিবাহ ১

কোন মন্তব্য নেই
নিকোলাওস এ ভ্রিসিমটজিস আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেইবিবাহকে সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর বলে বিবেচনা করা হয়েছে। বংশ রক্ষার জন্য বিবাহের মাধ্যমে সৃষ্ট পরিবারকে অন্যতম মৌলিক একটি দিক এবং অত্যাবশ্যক শর্ত হিসেবে দেখা হয়েছে। যে কারণে হোমারের কাব্যে বিবাহ ও পরিবারের মূল্যবোধ ও গুরুত্ব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে এবং জিউস ও হেরা, হেক্টর ও অ্যানড্রোম্যাচে, ইউলিসেস ও পেনিলোপের মতো দম্পতি দৃষ্টান্ত স্থাপনকরেছেন, অন্যদিকে অ্যাচিলেস, টেলিম্যাচাস, নউসিকার মতো একক বীরেরা অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করেছেন যে কবে যুদ্ধ বা তাদের ব্যক্তিগত অভিযান শেষ হলে তারা বিয়ে করবেন।
সেই সুদূর অতীতে বিবাহের কোনো আইনানুগ বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছিল না। শুধু অলিখিত কিছু বিধি বর্তমান রীতিপ্রথারমধ্যে প্রতিফলিত আছে। তবুও সবকিছুর বিবেচনায় মনে হয় যে, বিবাহকে আইনানুগ বা বৈধ রূপ দিতে হলে কমপক্ষে দুটি শর্ত পরিপূরণ করার প্রয়োজন পড়ত। প্রথমত বিয়ের উপহারসামগ্রী পাঠাতে হতোমেয়ের বাড়িতে এবং এরপরই সেই মেয়ে বা বধূ স্বামীর বাড়িতে আসত আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রা সহকারে। পরবর্তীতে, ক্লাসিক্যাল যুগে বিয়ের উপহার হিসেবে মেয়ের পিতাকে এক ধরনের বাগদান বা বিয়ের চুক্তির অনুরূপ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সামগ্রী দিতে হতো স্বামীর পক্ষ থেকে। এসবের মধ্যে থাকত পশু, মূল্যবান অলঙ্কার, বস্ত্রাদি এবং ব্যক্তিগতব্যবহারের সামগ্রী। উপহারের মধ্যে অর্থ থাকত না কারণ তখন পর্যন্ত অর্থবা মুদ্রা আবিষকৃত হয়নি। বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে প্রদত্ত উপহারগুলো স্বামীকে ফেরত দিতে হতো। কিন্তু বিচ্ছেদের জন্য যদি স্বামী দায়ী বলে প্রমাণিত হতো তাহলে প্রদত্ত উপহারসামগ্রী স্ত্রীর পরিবারেই থাকত। এতে অন্তত একটি বিষয় সপষ্ট হয় যে, বিবাহ বিচ্ছেদকে সামগ্রিকভাবে নিরুৎসাহিতই করা হতো। কারণ সেক্ষেত্রে উপহারসামগ্রী হারানো বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির ব্যাপার ছিল।
বিয়ের দ্বিতীয় আনুষ্ঠানিকতা ছিল বিয়ে করা কনেটিকে স্বামীর পরিবারের সদস্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। স্বামীর পরিবারের যারা কনের পিতৃগৃহে বিয়ের ভোজে অংশ নিত তাদের সাথে পরিচিতির অংশটুকু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভোজপর্ব শেষে এবং উপহার স্থির করা নিয়ে কথাবার্তা শেষ হলে কনে তার নতুন বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করত সুসজ্জিত শকটে আরোহণ করে। সুরশিল্পীরা বাদ্যযন্ত্র বাজাত এবং বরের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুরা মশাল হাতে নিয়ে বিয়ের গান গাইতে গাইতে শোভাযাত্রা সহকারে এগিয়েযেত শকটের সাথে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই যুগের বিয়ে সম্পর্কে আর কিছু পাওয়া যায় না। কোনো চিত্রেও এর প্রতিফলন নেই। এ সম্পর্কে আমাদের জানার একমাত্র উৎস হোমারের কবিতা।
ক্লাসিক্যাল যুগে বিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট আইনানুগ রূপ লাভ করে, যা এথেন্সে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে আইনপ্রণেতা সলোনের দ্বারা সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে দাঁড়ায়। কোনো বিয়ের বৈধতার জন্য দুটি শর্ত পূরণ করতে হতো, হবু স্বামী ও কনের পিতার মধ্যে সম্পাদিত বিয়ের চুক্তি এবং স্বামীর পরিবারের কাছে কনেকে হস্তান্তর। এই নিয়ম মেনে বিয়ে সম্পন্ন হলে সেই দম্পতির পুত্রেরা উত্তরাধিকার সূত্রে পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক ওনাগরিক অধিকার ভোগ করবে।
পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫১ সালে পেরিক্লেসের সময়ে প্রণীত এক আইনে বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুসারে শুধু উপরে উল্লিখিত শর্ত মেনে বিয়ে করলেই তা যে বৈধ বিয়ে হতো তা নয়, বরং বিয়ের শর্ত হিসেবে ছেলে ওমেয়ের এথেন্সবাসী হওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। এই আইনটি প্রণয়ন করা হয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে। এর দ্বারা একদিকে নাগরিক অধিকারের দাবিদার ও ক্ষমতায় যেতে আগ্রহীদের সংখ্যা যেমন সীমিত রাখার উদ্যোগ কাজ করেছে, অন্যদিকে নগর রাষ্ট্রটি বিদেশীদের হাতে যাতে না পড়ে সেই লক্ষ্যও ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
এথেন্স যেহেতু এথেনিয়ান লীগের Athenian League (এজিয়ান সাগরে অবস্থিত বহু সংখ্যক গ্রিক দ্বীপ ও উপকূলীয় নগর এবং এথেন্সের মধ্যেকার সামরিক মৈত্রী, যা স্থাপিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৮ সালে। প্রথমে এর কেন্দ্র ছিল ডেলোসে যা পরবর্তীতে এথেন্সে স্থানান্তরিত হয়) নেতৃত্বে ছিল সে কারণে উপরোক্ত আইনের উদ্দেশ্য ছিল এথেন্সের মিত্র ভূখণ্ডগুলো থেকে আগত অভিবাসীদের নাগরিক অধিকার প্রদান থেকে বিরত থাকা। ফলে এথেন্সবাসী ও বিদেশীদের মধ্যে এর আগে বিয়ে বৈধ থাকলেও এরপর থেকে এ ধরনের সম্পর্ককে বিবেচনা করা হতে থাকে অবাধ মিলন হিসেবে এবং সে মিলনে জন্মগ্রহণকারী পুরুষ সন্তানদেরও রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার দেয়া হতো না।
এই আইনের এক শিকার স্বয়ং পেরিক্লেস। আইনটি প্রণীতহওয়ার এক বছর পর মাইলেটাসনামে বিশিষ্ট ও শিক্ষিত এক নারী আসপাসিয়ার সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটে। পেরিক্লেসের দুটি পুত্র সন্তান ছিল যারা তার বৈধ স্ত্রীর গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছিল। সেই স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে পেরিক্লেস আসপাসিয়ার সাথে সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। আসপাসিয়াযদি এথেন্সবাসী হতো, কিংবা কোনো একটি নগর রাষ্ট্রের বাসিন্দা হতো, যাদেরকে এথেন্সবাসীদের সাথে বিয়ের অধিকার দেয়া হয়েছিল, তাহলে পেরিক্লেস অবশ্যই তাকে বিয়ে করতেন। কিন্তু বিয়ে না করা সত্ত্বেও খ্রিস্টপূর্ব ৪২৯ সালে আসপাসিয়ার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেরিক্লেসের সাথে তার সম্পর্ক অটুট ছিল। তার একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করলেও সেই পুত্র নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল যতদিন পর্যন্ত পেরিক্লেস বিদ্যমান আইনের বিশেষ ব্যতিক্রম ঘটাতে সক্ষম হননি।
একজন নাগরিকের জন্য স্ত্রী গ্রহণের মূল কারণ ছিল বৈধ পুত্র লাভ, যে পরিবারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবে এবং পিতা বার্ধক্যে উপনীত হলে তার দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করবে। বিয়ের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল দুটি শক্তিশালী অথবা বিত্তবানপরিবারের এবং তাদের সম্পত্তির মধ্যে সম্পর্কস্থাপন, যাতে উভয় পরিবারের অভিন্ন স্বার্থসংরক্ষিত থাকে। অতএব, এটাঅত্যন্ত সপষ্ট যে, খ্রিস্টপূর্ব তিনশ’ শতাব্দী পর্যন্ত সকল বিয়ে ছিল সুবিধা লাভের স্বার্থে সম্পর্কিত।

কোন মন্তব্য নেই :