যেভাবে এইড্‌স ছড়ায় ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল
কোন মন্তব্য নেই
দুনিয়া কাঁপানো শতাব্দীরভয়াবহ আতঙ্ক এইডসের অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন কিছুকাল আগেও ছিল উন্নত বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে রোগটি দাবানলেরমতো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। এমনকি এইডসের শিকার বর্তমানে আমাদের প্রিয় ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। রিপোর্ট অন দি গ্লোবাল এইচআইভি/এইডস এপিডেমিক জুন ১৯৯৮ সংখ্যায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ২১ হাজার মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ৯০০ জনের এইডসের উপসর্গ রয়েছে এবং ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১৩০০ লোক। খবরটা জেনে যে কেউ আঁতকে উঠবেন। নিচে সাম্প্রতিক জরিপে প্রাপ্ত কিছু তথ্য দেয়া হলো।
অবৈধ যৌন সম্পর্ক
অবাধ যৌনতার বিশ্বায়নে বাংলাদেশেও ব্যাপক যৌনাচার আজ এইডসের ব্যাপকতায় মুখ্য ভূমিকা রাখছে। শতকরা ৫০ ভাগ যুবকবিবাহপূর্ব যৌনতায় অভ্যস্ত। আর্থিকভাবে অসচ্ছল যুবকদের মধ্যে পতিতালয়ে গমনের সংখ্যা বেশি। শতকরা ৬০ ভাগ ট্রাকড্রাইভার বিবাহোত্তর যৌনতার শিকার হয়ে ব্রোথেল বা পতিতাপল্লীতেযান। এছাড়া স্যাটেলাইটেরবদৌলতে যৌনতা আজ সর্বব্যাপী কালো থাবা বিস্তার করে চলেছে। যার শিকার ছাত্র-ছাত্রী, ব্যবসায়ী, আমলা, রিকশাচালকসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ। এছাড়া প্রবাসীদেরমধ্যেও এ রোগের ব্যাপকতা লক্ষণীয়। প্রতি বছর প্রায় ৭৪ লাখ বাংলাদেশী দেশের বাইরে যাচ্ছে-যাদের ভিসা পাওয়ার আগে এইচআইভি নেগেটিভ কিনা দেখে নেয়া হয় অথচ যখন দেশে ফেরত আসছে দেখা যাচ্ছে তাদের অনেকেই নিজেদের অজ্ঞতার দরুন কনডম ব্যবহারের অনীহা হেতু এইডসে আক্রান্ত হচ্ছে। অন্যদিকে প্রায় এক লাখ বিদেশী প্রতি বছর বাংলাদেশে আসছে। তাদের মধ্যেও অনেকেই জীবাণু বহন করে নিয়ে আসছে।
পেশাদার রক্তদাতা
বাংলাদেশে পেশাদার রক্তদাতার অভাবজনিত কারণে রক্ত দিয়ে থাকে-যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন ধরনের অবৈধ যৌনক্রিয়ায় আক্রান্ত থাকে। এ ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত যৌনশিক্ষার অভাব দায়ী। প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার ব্যাগ রক্ত সংগৃহীত হয়।
ড্রাগ বা মাদকাসক্ত
৭১ ভাগ বাংলাদেশী মাদকাসক্ত হেরোইন বা ব্রাউন সুগারে আসক্ত। আর ২৭ ভাগ ফেনসিডিল ইত্যাদিতে আসক্ত। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা সাধারণত একই সূচ ব্যবহার করে থাকে। তাই অজানা আক্রান্ত ব্যক্তি যে সূচ ব্যবহার করে সেই একই সূচ দিয়ে যখন অন্য মাদকাসক্ত মাদক গ্রহণ করছে তখন সেও আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা পুরনো ব্যবহৃত সূচ পুনরায় বিক্রি করেও মাদকাসক্তদের মধ্যে এ রোগ ছড়াতে ভূমিকা রাখছে।
কনডম ব্যবহার
*. গ্রামাঞ্চলে যৌনমিলনকালে কনডমের ব্যবহার অত্যন্ত কম। এটি মাত্র শতকরা ৬ ভাগ।যদিও শহরাঞ্চলে কনডম ব্যবহার প্রায় শতকরা ১৭.৬ ভাগ। সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র কনডম ব্যবহারেই এইডসে আক্রান্ত হওযার প্রবণতা শতকরা ৬০ ভাগ কমিয়ে দিতে পারে। অবাধ যৌনমিলনের এই যুগে তাই কনডম ব্যবহার এইডস প্রতিরোধে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। এ জন্য সরকারিভাবে প্রচারমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন। টিভি চ্যানেলগুলোতে কনডমের যে বিজ্ঞাপনগুলো দেখানো হয় সে বিজ্ঞাপনগুলো খুবই নিচু মানের ও অরুচিকর।
*. এছাড়া যথোপযুক্ত পরীক্ষা বা স্ক্রিনিং ব্যতিরেকে রক্ত গ্রহণ বা দান কিংবা ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ব্যবহার না করা এইডস ছড়ানোর অন্যতম কারণ। যেহেতু প্রতিকার নেই মৃত্যুই একমাত্র পরিণতি, তাই প্রতিরোধই একমাত্র উপায়।
*. এছাড়া এইডস আক্রান্ত মহিলার গর্ভে যে সন্তান জন্ম নেবে সেই সন্তান গর্ভাবস্থায়, প্রসবকারে অথবা মাতৃদুগ্ধ পানের মাধ্যমে এইডসে আক্রান্ত হতে পারে।
*. অবৈধ যৌন সম্পর্ক বা বিকৃত যৌনাচার (সমকামিতা) থেকে বিরত থাকতে হবে।
*. রক্তনালিতে নেশাকারক ওষুধ গ্রহণ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। সিরিঞ্জ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ সর্বাধিক নিরাপদ।
*. কনডমবিহীন অরক্ষিত যৌনাচার থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে দৈনন্দিন সামাজিক মেলামেশা, করমর্দন করা,এক সাথে খাওয়া বা পানি, মশা-মাছি বা বাতাসের মাধ্যমে এইডস ছড়ায় না। এমনকি রোগীর ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদ বা মলমূত্র, হাঁচিকাশি বা থুথুর মাধ্যমে এইডস ছড়ায় না। সুতরাং সুস্থ নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন এইডসের হাত থেকে আপনাকে রক্ষা করতে পারে।
সেলুনে শেভ থেকে এইডসের ঝুঁকি
আমাদের দেশে সেলুনগুলোতেদাড়ি কাটার জন্য একই ক্ষুর, ব্লেড, রেজার ব্যবহৃত হয়ে আসছে। একাধিক ব্যক্তির জন্য ব্যবহৃত এসব ক্ষুর, ব্লেডবা রেজার দিয়ে দাড়ি কামানোর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। ব্যবহৃত ক্ষুর,ব্লেড ও রেজার দিয়ে দাড়ি কামানোর ফলে একজন সুস্থ ব্যক্তি এইডস রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ক্ষুর, ব্লেড বা রেজারের মাধ্যমে এইডস ভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে দাড়ি শেভের সময় তুচ্ছ ক্ষতের মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির রক্তের সংসপর্শে এসে শরীরে ঢুকে পড়তে পারে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি এইডস নামের ভয়াবহ মরণব্যাধির ছোবলে অবধারিত মৃত্যুমুখে পতিতহবে।
১৯৯৩ সালের রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার সন্দেহজনক এইডস ভাইরাস বহনকারী রয়েছে। এদের থেকে যে কোনো সময় এইডসের বিস্তার মহামারী রূপ নিতে পারে। একই ক্ষুরবা ব্লেড, রেজার দিয়ে একাধিক ব্যক্তির দাড়ি কাটার ফলে এইডস ভাইরাস বহনকারীর রক্তে এসব ক্ষুর, ব্লেড বা রেজার সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণ তাপে বা গরমপানিতে কিংবা সাধারণ জীবাণুনাশক ডেটল/স্যাভলন দ্বারা এসবক্ষুর বা ব্লেড এইডস ভাইরাসমুক্ত করা যায় না। তাই এসব ক্ষুর বা ব্লেডেরমাধ্যমে এইডসের বিস্তার ঘটতে পারে। সেলুনগুলোতে ডিসপোজেবল রেজার ও ব্লেডের ব্যবহার হচ্ছে না বললেই চলে। একজন সুস্থব্যক্তি সেলুনে দাড়ি কাটাতে এসে অন্যের দ্বারা সংক্রমিত রেজার বা ক্ষুরের মাধ্যমে এইডসে আক্রান্ত হতে পারে। হেপাটাইটিস বি নামক লিভারের মারাত্মক একটি রোগ এইডসের মতো একইভাবে মানবদেহে প্রবেশকরে। হেপাটাইটিস বি থেকে লিভার অকেজো হয়ে পড়ে, এমনকি লিভার ক্যান্সার হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। অবশ্য হেপাটাইটিস বি-এর কার্যকর টিকা আমাদের দেশে পাওয়া যাচ্ছে। ব্যয়বহুল বলে ব্যবহার সীমিত। কাজেই এইডস ও হেপাটাইটিস বি থেকে বাঁচতে হলে অন্যান্য প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সেলুনেডিসপোজেবল ব্লেড ব্যবহারকরতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই :