আপনি একজন গর্ভবতী মা, অতএব.. (ডা. শিমুল আখতার)

কোন মন্তব্য নেই
নারী জীবনে প্রথমবারের মতো যারা ‘মাতৃত্ব’ বরণ করতে যাচ্ছেন তাদের অনেক জ্ঞাতব্য ও শিক্ষণীয় বিষয় রয়ে গেছে। তাদের মনে মাতৃত্ব সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞানলাভ করার উৎসাহ জেগে ওঠে।
 
বিশেষ করে যারা প্রথমবারের মতো মা হতে চলেছেন তাদের মাঝে অহেতুক ভয় ও লজ্জাবোধ লক্ষ্য করা যায়। মনে রাখতে হবে মাতৃত্ব একটি স্বাভাবিক জীবনাবস্থা।
মুক্ত, বিশুদ্ধ বায়ু ও সুর্যালোক
প্রত্যেক গর্ভবতী মাকে দৈনিক গড়ে কমপক্ষে দু’ঘন্টা সময় ঘরের বাইরে মুক্ত, বিশুদ্ধ হাওয়া ও সুর্যালোকে কাটানো উচিত। যানবাহন ও পথচারীদের ব্যস্ত পথঘাট পরিহার করে শান্ত, নির্মল খোলামেলা পরিবেশসমৃদ্ধ বাগান অথবা পার্কে পায়চারি করতে পারেন। মা ও গর্ভস্থ শিশুর জন্যও প্রয়োজন বিশুদ্ধ তাজা বাতাস।
ব্যায়াম ও চিত্তবিনোদন
হাল্কা ব্যায়াম ও বিত্তবিনোদনমূলক কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। অধিক পরিশ্রমসমৃদ্ধ ব্যায়াম ও খেলাধুলা এ সময়ে পরিহার করে চলা উচিত। দারুণ ক্লান্তিকর কোনো কাজই করা ঠিক হবে না। প্রতিদিন কিছু সময় হাঁটতে পারেন। হাঁটলে দেহের রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থায় সাড়া জাগায় এবং সর্বোপরি সুখকর নিদ্রা ও বিশ্রামে সহায়তা করে। সংসারের ছোটখাটো সব ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকতে পারে। যেমন-ঘর ঝাঁট দেয়া, বিছানা পরিপাটি করাসহ অন্যান্য দৈনন্দিন করণীয় দায়িত্ব। গর্ভবতী অবস্থায় কখনো ভারী জিনিসপত্র ওঠানো বা নামানো অথবা বহন করা উচিত নয়। এতে করে গর্ভপাত ঘটতে পারে। উঁচু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা ঠিক নয়। অবিরাম দাঁড়িয়ে থাকার ফলে স্বাভাবিক রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। অনেক সময় পায়ের শিরাগুলো স্ফীত ও স্পষ্টতরভাবে ফুলে ওঠে ও পরিণতিতে ভেরিকোস ভেইন-এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
ভ্রমণযাত্রা
গর্ভবতী হওয়ার পর প্রথম তিন মাস ঝুঁকিপূর্ণ পথযাত্রায় গর্ভপাত ঘটার সমূহ সম্ভাবনা থাকে বিধায় এ সময়ে ভ্রমণের ব্যাপারে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থার বত্রিশ সপ্তাহের অধিক সময়ের গর্ভবতীদের ভ্রমণের ব্যাপারে আপত্তি থাকে। আটাশ সপ্তাহের অধিক সময়ে গর্ভবতীদের উড়োজাহাজে ভ্রমণের ব্যাপারে সংশিস্নষ্ট চিকিৎসকদের ভ্রমণের উপযোগী হিসেবে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেখাতে হয় বিমান পরিবহন সংস্থাকে। কাজেই গর্ভবতী অবস্থায় দীর্ঘ ক্লান্তিকর, ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ যতোটা সম্ভব পরিহার করা উচিত।
বিশ্রাম ও ঘুম
গর্ভবতী অবস্থার দ্বিতীয় অর্ধেক সময়ে মার ওজন প্রায় ১০.৮ কেজি (২৪ পাঃ) অথবা তারও বেশি বৃদ্ধি পায়। অধিক ওজনের ফলে দিন শেষে এরা সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অনেকে পায়ে অসহ্য ব্যথা অনুভব করেন। কাজের ফাঁকে মাঝে-মধ্যে একটু বিশ্রাম অথবা অল্প সময়ের জন্য (১-২ ঘন্টা) ঘুমিয়ে নিতে পারেন। ঘুম ও বিশ্রামের স্বল্পতা মা ও গর্ভস্থিত শিশু উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। রাতে গর্ভবতী মা অন্তত ৮-৯ ঘন্টা সময় ঘুমিয়ে নেবেন। আরামদায়ক উষ্ণ পানিতে গোসল সেরে নিলে সহজেই ক্লান্তি দর হবে। এক গ্লাস হাল্কা গরম দুধ পান এ সময়ে মন্দ লাগবে না। গর্ভবতী অবস্থায় জরায়ুর আকার বৃদ্ধি ঘটে এবং গর্ভস্থিত সন্তানের ওজনের ফলে অনেকে শুয়ে অস্বস্তিবোধ করে থাকেন। ছোট, নরম ও হাল্কা বালিশ রেখে বাম ফিরে শুয়ে দেখুন অস্বস্তিবোধ অনেকটা কমে যাবে।
দৈহিক ও মানসিক শিথিলতা
প্রয়োজনীয় বিশ্রাম গ্রহণ করে গর্ভবতী অবস্থায় ও প্রসবকালে দেহ ও মনে পর্যাপ্ত শিথিলতা আনতে হবে। এ সময়ে সব ধরনের দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে হবে।
পছন্দসই, আরামদায়ক পোশাক
পছন্দসই, আরামদায়ক পোশাক পরিধান করা মোটেও বিলাসিতা নয়। মেটারনিটি ড্রেস পরিধান করা স্বাস্থ্যসমমত। ঘুম ও বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটায় এমন পোশাক ব্যবহার না করাই শ্রেয়। কোনো অবস্থাতেই আঁটোসাঁটো পোশাক ব্যবহার করবেন না এ সময়ে। গর্ভবতী অবস্থায় ব্যবহার করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি পোশাক ব্যবহার করুন। একাধিক সন্তান জন্মদানকারী মায়ের পেটের মাংশপেশিগুলো শিথিল হয় বলে তলপেট সামনের দিকে কিছুটা ঝুলে পড়ে অনেকের। তারা প্রসব পরবর্তীকালে নির্ধারিত ব্যায়াম করে এ অবস্থা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। ম্যাটারনিটি বেল্ট পাওয়া যায়, সুবিধা মনে হলে তাও ব্যবহার করে দেখতে পারেন। গর্ভবতী অবস্থায় গোড়ালি উঁচু বা হাইহিল জুতো ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাছাড়া গর্ভবতী অবস্থায় দৈহিক ওজন বৃদ্ধি ঘটে বলে উঁচু গোড়ালির জুতো ব্যবহারে পায়ের অসহ্য ব্যথায় আক্রান্ত হতে পারেন।
আন্তিক পরিচর্যা
গর্ভবতী মহিলারা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন প্রায়ই। এজন্য সকালে এক গস্নাস হাল্কা গরম পানি পান করতে পারেন।
পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল খাবার ও হাল্কা পানীয় গ্রহণ করা উচিত। অরেঞ্জ জুস, দুধ, পানি ইত্যাদি পান করবেন। কড়া লিকারে চা পান করা উচিত নয়। কারণ ট্যানিন-এর প্রভাবে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসব্জি, ফলমল গ্রহণ করতে পারেন।
গর্ভবতীর মুখ ও দাঁতের যত্ন
গর্ভাবস্থায় মুখ, দাঁত ও মাড়ির বিশেষ যত্ন নেয়া উচিত। মুখ ও দাঁতের সুস্বাস্থ্য সার্বিকভাবে দৈহিক সুস্থতা রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখে।
গর্ভবতীর স্তনের যত্ন
প্রসবের পর নবজাত শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করাতে হবে। মনে রাখতে হবে মায়ের দুধের বিকল্প নেই। স্তনের অগ্রভাগে কোনো অসুবিধা থাকলে সে ব্যাপারে সময় মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সারিয়ে তুলতে হবে। শাল দুধ পানে শিশুর দেহে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা গড়ে ওঠে। এ সময়ে বিশেষভাবে তৈরি সাপোর্টিং ব্রা ব্যবহার করতে পারেন। বুকের দুধ পান করানোর সময় বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেন বুকের দুধ শিশুর নাসিকারন্ধ্রে বা চোখে গড়িয়ে না পড়ে। স্তনের চাপে অনেক সময় শিশুর শ্বাসরোধ হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। শিশুর মুখে নিপল রেখে কখনো ঘুমিয়ে যাবেন না। দেহ অথবা স্তনের চাপে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শিশুর মৃত্যু ঘটেছে এমন দুর্ঘটনাও বিরল নয়।
গোসল
ত্বকের মাধ্যমে শরীরের তরল বর্জ্য পদার্থ বের হয়ে থাকে। তাই এর যত্ন নেয়া প্রয়োজন। গর্ভবতী অবস্থায় আরামদায়ক টাবে গোসল সেরে নিতে পারেন। সাওয়ারেও গোসল সেরে নেয়া যেতে পারে। খুব বেশি গরম পানিতে গোসল করা উচিত নয়। এতে করে ক্লান্ত হয়ে অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যেতে পারেন। প্রতিদিনই গোসল করা উচিত।
ধুমপান
গর্ভবতী অবস্থায় ধমপান করা মোটেই সমীচীন নয়। নিকোটিন পস্ন্যাসেন্টা অতিক্রম করে গর্ভস্থিত শিশুর সমূহ ক্ষতিসাধন করে। শিশুর ওজন কমে ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার পথে বাধার সমমুখীন হয়।
বৈবাহিক সম্পর্ক
এ সময়ে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় হওয়া উচিত। গর্ভবতী হওয়ার পর স্বামীকে স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতিশীল থাকতে হবে। যেসব মহিলা একাধিকবার গর্ভপাতের শিকার হয়েছেন তারা প্রথম দিকের কয়েক মাস অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে মেলামেশা করবেন।
নতুন নতুন উপসর্গে উদ্বিগ্নতা
নতুন গর্ভবতী মহিলা যে কোনো উপসর্গের মুখোমুখি হলেই তা সংশিস্নষ্ট চিকিৎসককে জানাবেন। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে বড়ো ধরনের সমস্যা এড়িয়ে চলা সম্ভব। সামান্য পরিমাণ অনিয়মিত রক্তস্রাব, মুখ ও পা ফোলা, মাথাব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
পুষ্টি ও খাদ্য
জনগোষ্ঠীর পুষ্টিগত অবস্থা ভালো হলে গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব ও নবজাত শিশু মৃত্যুহার কম থাকে। গর্ভবতী অবস্থায় মার খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা বাড়ে। খাদ্যের পরিমাণগত চাহিদার চেয়ে গুণগত চাহিদা দেখা দেয় এ সময়ে। পুষ্টি-চাহিদার বৃদ্ধি ঘটে। কারণ বাড়ন্ত শিশুর চাহিদা মেটাতে হয়। মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হয়। প্রসবকালে শারীরিক শক্তির প্রয়োজন হয়। শিশুর প্রয়োজনীয় খাদ্য বুকের দুধের চাহিদা মেটাতে হয়। প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, মিনারেল ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। এ ব্যাপারে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, একজন সুস্থ মাই সুস্থ শিশু লাভ করতে পারেন এবং সুন্দর মাতৃত্বরক্ষায় সচেতনতা প্রয়োজন।


Next post @

মাথার যন্ত্রণা-মাইগ্রেন (আরিফ মাহমুদ সাহাবুল)

 

ফেসবুকে আমি
শেয়ার করে আপনার বন্ধুদেরকে জানান ।তাদের কে জানতে দিন অজানা বিষয় গুলি।প্রকাশক ও সম্পাদক ব্লগার_সৈয়দ রুবেললেখকজানার আছে অনেক কিছু

কোন মন্তব্য নেই :