আল্লাহর দাসত্বেই রয়েছে বান্দার প্রকৃত মযার্দা

কোন মন্তব্য নেই
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
লিখেছেনঃ আব্দুর রাকীব (মাদানী)। ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃমাহমুদ - ই - গাফফার

আল্ হামদুলিল্লাহ্ ওয়াস্ সালাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিল্লাহ, আম্মা বাদ:
আমরা আল্লাহর বান্দা। এটি সবার জানা। কিন্তু বান্দা শব্দটির সম্পর্কে কি আমরা কখনো চিন্তা-ভাবনা করেছি, যে এই শব্দটির মর্মার্থ কি? এর দ্বারা কি বুঝায়? বান্দা ফারসী শব্দ যার আরবী হচ্ছে ‘আব্দ’ অর্থাৎ দাস। তাই আমরা সকলে ইবাদুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর বান্দা সকল। বান্দা বা দাসের কাজ হচ্ছে তার মালিকের দাসত্ব করা, গোলামী করা। মালিকের নিকট সেই দাসই সর্ব্বোৎকৃষ্ট, যেতার মালিকের সত্যিকারার্থে দাসত্ব করে, গোলামী করে। কিন্তু তাঁর অনেক বান্দা এমনও আছে যারা আল্লাহর দাসত্ব করে না, করতেও চায়না । দাসত্ব করা যে বান্দাদের কর্তব্য তা বিশ্বাস করেনা। অথচ পৃথিবীতে সে লোকটি যখন কোন অর্থশালীমানুষের নিকট কিংবা কোনকম্পানীতে কাজ করে, তখন সে তাকে মালিক মনে করে, তাকে বিশ্বাস করে, তার আদেশ-নিষেধ শোনে ও মানে । এর কারণ স্বরূপ সে বলেবা মনে করে যে, তার এই মলিক তাকে কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক দেয়, তাই সে তার কাজ করে।

মনে রাখা দরকার, এই মালিক তখন বিনিময় দেয়যখন সে তার কাজ করে দেয়কিন্তু মহান আল্লাহ তো তার সকল বান্দাদের অনেককিছু এমনিই দিয়ে থাকেন। সারা দিন সূর্যের আলো কে দেয়? বাতাস কে দেয়? অক্সিজেন কে দেয়? রুযীকে দেন? এ সবের কি তিনি কোন বিনিময় নেন ? কোন শর্তও কি আরোপ করেন? তা সত্যেও যদি কোন বান্দা মহান আল্লাহর দাসত্ব নাকরে, তাহলে সে অবশ্যই একজন অহংকারী এবং অত্যাচারী বান্দা।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম নিজেকে আল্লাহর দাস বলাকে মর্যাদার বিষয় মনে করতেন:
জগতের শ্রেষ্ঠ আব্দ বা বান্দা হলেন শেষ নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তিনি আল্লাহর দাসত্ব স্বীকারে কতখানি খাঁটি ছিলেন এবং নিজেকে আল্লাহর দাস বলতে তাঁকেকত পছন্দ করতেন তাঁর স্বীকারোক্তি নিম্নে দেখা যেতে পারে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
” لا تُطْروني كما أطرتِ النصارى ابنَ مريمَ ، فإنما أنا عبدهُفقولوا : عبد الله و رسوله “
“তোমরা আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না যেমনখৃষ্টানেরা মারিয়াম পুত্রের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে। আমি তো কেবল তাঁর আব্দ (দাস)তাই তোমরা আমাকে বল: আল্লাহর দাস এবং তাঁর রাসূল।” [ বুখারী, অধ্যায়, আম্বিয়া, অনুচ্ছেদ নং ৪৮, হাদীস নং ৩৪৪৫]

অনুরূপ অনেক দুয়া’তে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেকে আল্লাহর বান্দা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন অযুর দুয়া’য় উল্লেখ হয়েছে:
” أشْهَدُ أنْ لا إله إلا الله وحدَه لا شريك له و أشْهَدُ أنَّ محمداً عبدُهُ وَ رسولهُ “
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোন মাবূদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বান্দা ও রাসূল।” [ মুসলিম, অধ্যায়, পবিত্রতা অর্জন, অনুচ্ছেদ, ওযু শেষে মুস্তাহাব যিকর।]

প্রতি নামাযের তাশাহহুদেও তাই বলা হয়েছে,
“আশহাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান্ আবদুহু ওয়া রাসূলুহু”।
অর্থ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়াকোন সত্য উপাস্য নেই এবং এও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। [বুখারী, নং৮৩১]

বর্ণিত হাদীস সমূহে যেমন নবী (সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেকে আল্লাহর দাস হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন, তেমন সেই বিশ্বাসেরও অপনোদন হয়েছে যারা মনে করে যে,নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর শানে আল্লাহর দাস বলা বেআদবী কিংবা যারা মনে করে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর দাস তো নয়ই বরং তিনি ছিলেন আল্লাহর নূর দ্বারা সৃষ্টি।

আল্লাহর দাসত্বের স্বাদ:
অন্য দিকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর দাসত্ব তথা বন্দেগী কত নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন এবং তা পালন করতে তাঁকে কত মজা লাগতো, তা নিম্নের হাদীস দ্বারা উপলব্ধি করা যেতে পারে।
عن عائشة رضي الله عنها ” أنَّ نبي اللهِ صلى الله عليه و سلم كان يقوم من الليل حتى تتفطر قدماه ، فقالت عائشة: لِمَ تصنع هذا يارسول الله و قد غفر اللهلك ما تقدم من ذنبك و ما تأخر ؟ قال: أفلا أحبُّ أنْ أكونَ عبداً شكوراً
আয়েশা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতে কিয়াম করতেন (দীর্ঘক্ষণ ধরে নামায পড়তেন) যার কারণে তাঁর দুই পা ফুলে যেত। আয়েশা (রাযিঃ) নবীজীকেবললেন: আল্লাহর রাসূল, আপনি কেন এরূপ কেন করছেন? আল্লাহ তো আপনারআগের ও পরের গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তরে বললেন: “আমি তাঁর কৃতজ্ঞ প্রকাশকারীবান্দা হতে পছন্দ করবো না কি?” [বুখারী, অধ্যায়, তফসীর, নং ৪৮৩৭]

আল্লাহর ইবাদত বা দাসত্ব করা বিরাট মর্যাদার বিষয়:
মহান আল্লাহ সারা জগতেরসৃষ্টিকর্তা। সৃষ্টিকুলের মধ্যে ফেরেশতাগণ তাঁর সম্মানীত সৃষ্টি। তিনি তাদেরকে নূর বা জ্যোতি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের ‘আব্দ’ বা দাস বলেছেন। আল্লাহ বলেন:
( তারা তো তাঁর সম্মানিতবান্দা, তারা আল্লাহর আগে বেড়ে কথা বলে না; তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে।) [আম্বিয়া/২৬-২৭]

মহান আল্লাহ যাদের স্বয়ং প্রশংসা করেন, যাদের সম্মানিত বান্দা বলেন, যারা সরাসরি আল্লাহর আদেশ পান, আর তাদের যদি আল্লাহ তাআ’লা বান্দা বলে সম্বোধন করেন, তাহলে মানবকুলের জন্য সেই সম্বোধন বা সেই উপাধি সম্মানের পাত্র নয় কি?
আল্লাহর ‘আব্দ’ আখ্যা পাওয়া যে কত মর্যাদার বিষয় আমরা তা তাঁর শ্রেষ্ঠ ও শেষ নবীর সেই ঘটনার মাধ্যমে অবগত হতেপারি। যেই ঘটনাটি ছিল নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্য বিরাট সম্মানেরঘটনা। যেখানে আল্লাহ স্বয়ং তাঁর প্রিয় নবীকে নিজের কাছে ডেকে নেন। জান্নাত ও জাহান্নাম দেখান। পাঁচ ওয়াক্ত নামায প্রদান করেন ইত্যাদি। সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আল্লাহ তাআ’লা তাঁকে আব্দ বা বান্দা বলে সম্বোধন করেন। আল্লাহ তাআ’লা বলেন:
(سُبْحانَ الذيْ أسْرَىبِعَبْدِهِ لَيْلاً مِنَ المَسْجِدِ الحَرامِ إلى المَسْجِدِ الأقْصَا الذي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ أيَاتِنَا إنه هو السميعُ البَصِيْر )
“পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে [রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে] রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায়, (বায়তুল মাকদিস) যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্যে;তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।” [ ইসরা/১]

ইসরা এবং মিরাজ’ নামে প্রসিদ্ধ এই মর্যাদাপূর্ণ ঘটনাতেই উল্লেখ হয়েছে, যখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সপ্ত আকাশ পেরিয়ে ‘সিদরাতুল্ মুনতাহায়’ পৌঁছালেন, তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর খুবই কাছাকাছি হলেন এবংতাকে অহী করা হল। সেই সৌভাগ্য পূর্ণ মুহূর্তেও আল্লাহ তাআ’লা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে ‘আব্দ’ বলে সম্বোধন করেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআ’লার বাণী এইরূপ:
( ثُمَّ دَنَا فَتَدلّى ، فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أوْ أدْنَى ، فَأوْحَى إلى عَبْدِهِ مَآ أوْحَى )
“অতঃপর সে তার (রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]) এর নিকটবর্তী হল, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইলো অথবা ওরও কম। তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা অহী করার তা অহী করলেন।” [ নাজম/ ৮-১০]

অন্যস্থানে মহান আল্লাহসমস্ত নবীগণকেই আব্দ বলে সম্বোধন করেন। যেমনতিনি বলেন:
( وَ لقدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا المرْسَلِيْنَ ، إنهم لَهُمُ المَنْصورُونَ )
“আমার প্রেরিত বান্দাদের সম্পর্কে আমার এই বাক্য পূর্বেই স্থির হয়েছে যে, অবশ্যই তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে।” [সাফ্ফাত/১৭১-১৭২]

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন;
” أحبُّ أسمائكم إلى اللهِ عبد الله و عبد الرحمان ” رواه مسلم
“আল্লাহর নিকট তোমাদের নাম সমূহের মধ্যে অধিকতর পছন্দনীয় নাম হচ্ছে, আব্দুল্লাহ এবং আব্দুর রাহমান”।
(মুসলিম ২১৩২)

এই নাম দুটি আল্লাহ তায়ালা নিকট বেশি পছন্দ হওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় ইসলামি পণ্ডিতগণ বলেছেন: এই নামদ্বয়ে আল্লাহর দিকেবান্দার দাসত্বের সম্বন্ধ রয়েছে এবং বান্দার মানানসই বিশেষণের স্বীকৃতি রয়েছে। [ফাত্হুল বারী ১০/৬৯৯]

আসলে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক হচ্ছে,খাঁটি দাসত্বের সম্পর্ক। আর মহান আল্লাহর সম্পর্ক বান্দাদের সাথে হচ্ছে, পূর্ণ আশিস ও অনুগ্রহেরসম্পর্ক। কারণ বান্দা তাঁর দয়ায় অস্তিত্ব লাভ করেছে, তাঁর অনুকম্পায় ধরাধামে জীবনযাপন করছে এবং তাঁররহমতেই আখেরাতে নাজাত পাবে।

একটি সংশয়ের নিরসন:
এর পরেও অনেকের মনে হয়ত একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, দাসত্ব কিভাবে মর্যাদার বিষয় হতে পারে? এর উত্তরে আশা করি একটি জাগতিক উদাহরণপেশ করা সঙ্গত হবে। পৃথিবীতে যদি মানুষ কোনরাজা বা উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিত্বের সেবা করা অসম্মান মনে না করে; বরংসম্মান ও গর্ব মনে করে, তাহলে পূর্ণ রাজত্বের অধিকারী রাজাধিরাজ, মহাশক্তিশালী, মহা প্রতাপশালী, সৃষ্টিকুলের পর্যবেক্ষক ও রক্ষক, অতি দয়ালু ও দয়াবান মহান আল্লাহর দাসত্ব করা, সম্মানীয় হবে না কেন? গৌরবের বিষয় হবে না কেন?

পরিশেষে মহান রাব্বুল্ আলামীনের নিকটপ্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের তাঁর সৎ বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করেন, খাঁটি ভাবে তাঁর দাসত্ব করার তাওফীক দেন। কারণ তিনি এই মহা উদ্দেশ্যেই আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তাই তো তিনি স্পষ্ট ভাষায় ইরশাদ করেন:
“আমি জিন ও ইনসানকে কেবল এই উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি যে, তারা সকলে কেবল আমার ইবাদত করবে। আমি তাদের নিকট হতে জীবিকা চাই না এবং এও চাই না যে তারা আমার আহার্য যোগাবে।” [যারিয়াত/৫৬-৫৭]
দাঈ, দাওয়াহ সেন্টার, আলখাফজী, সৌদী আরব


শেয়ার করে আপনিও হন ইসলামের প্রচারক ।
আমরা সবাই একাজটি করলে জানার পাশাপাশি সওয়াব হবে ।
যে ব্যাক্তি ইসলামের একটি কথা শিখবে তাকে আল্লাহ দশটি নেকী দেবেন ।
যে শিখাবে তাকেও দশটি নেকী দেওয়া হবে ।
তাই আসুন আমরা নিজেও জানি, অন্যদেরকেও জানাই ।

কোন মন্তব্য নেই :