এইডস, বাস্তবতা এবং প্রতিরোধ বিভ্রান্তি মোহামমদ সাইফ উদ্দিন ১

কোন মন্তব্য নেই
যে রোগটি বর্তমান বিশ্বেসবচেয়ে আলোচিত এবং যা পুরো মানবজাতিকে রীতিমতোআতঙ্কিত করে রেখেছে তার নাম এইডস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এককভাবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব এবং বরাদ্দ দিয়েছে এ রোগ প্রতিরোধের জন্য। এ রোগের প্রকৃত রূপনির্ণয় আমাদের মতো দেশে অনেক সময় সম্ভব হয় না।
অন্যান্য রোগের সঙ্গে এইডসের একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। এইডসের জন্য দায়ী এইচআইভি নিজে কোনো রোগ সৃষ্টি করে না বরং মানুষের রোগ প্রতিরোধের জন্য যে কোষগুলো আছে ( যেমন CD4+, T Cells ) তাদের ধ্বংস করে দেয়। ফলেমানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। তখন অন্য যে কোনো সাধারণ রোগের জীবাণুও মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। এইডসের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করার অর্থ নির্ঘাত এবং ধীরলয়ে মৃত্যু। এ ভয়াবহ রোগ বর্তমানে পৃথিবীতে কিরূপ বিস্তৃত তা বোঝার জন্য আসুন কিছু উপাত্ত দেখা যাক।
২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী
বিশ্বে সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪ কোটি ৩ লাখ এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ২ কোটি ৫ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক নারী ১ কোটি ৭৫ লাখ এবং শিশু ২৩ লাখ
শুধু ২০০৫ সালেই আক্রান্তের সংখ্যা ৪৯ লাখ এর মধ্যে শিশু ৭ লাখ
UNAIDS -এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৬ সালের শেষ নাগাদ মোট আক্রান্তের সংখ্যা হবে ৬ কোটি ৫০ লাখ(ন্যূনতম)।
১৯৮১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এইডসে সর্বমোট মৃতের সংখ্যা ২ কোটি ৫০ লাখ এবং ২০৩০ সাল নাগাদ আরো প্রায় ১১ কোটি ৭০ লাখমানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।
এবার আমাদের নিজেদের দিকে চোখ ফেরানো যাক। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশভারত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমাদের যে কোনো বিষয় ভারতকে হিসাবের মধ্যে আনতে হয়। কারণ সেই দেশের যে কোনো প্রাকৃতিক,সামাজিক এবং স্বাস্থ্যগতসমস্যার কারণে বাংলাদেশের মানুষকেও ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়।
উদাহরণস্বরূপ পোলিওর কথাবলা যায়। বিগত প্রায় ৫ বছর বাংলাদেশ পোলিওমুক্তথাকলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়নি শুধু ভারতে এরোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে এবং দুঃখজনক হলো ২০০৬ সালের মার্চ মাসে সীমান্তবর্তী একটি জেলায়পোলিও রোগে আক্রান্ত একটি শিশুকে পাওয়া গেছে যাকে পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন এ জীবাণু সীমান্তের ওপার তথা ভারত থেকে আগত। অর্থাৎ পোলিওমুক্ত হওয়া থেকে বাংলাদেশ ন্যূনতম আরো চার বছর পিছিয়ে গেল।
যাই হোক, এইডসের ক্ষেত্রেও ভারতের বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। এ উপমহাদেশে এইডসের ক্ষেত্রে ভারত বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং আশপাশের দেশগুলোকেও ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে।
১৯৮৬ সালে তামিলনাডু রাজ্যের কিছু পতিতার শরীরে প্রথম এইডসের জীবাণু ধরা পড়ে। এরপর ১৯৯০ সালে ভারতে এইডস আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় কয়েক হাজার এবং সেখান থেকে ২০০৩ সালে এর সংখ্যা এক লাফে দাঁড়ায় প্রায় ৫১ লাখে! বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতে ৫৭ লক্ষাধিক মানুষ শরীরে এইচআইভি/এইডস নিয়ে বেঁচেআছে।
জাতিসংঘের হিসাবে ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিশ বছরে ভারত ২৭ লাখ মানুষ এইডসের কারণে মৃত্যুবরণ করেছে। শুধু ২০০৫ সালেই যার সংখ্যা চার লাখের বেশি, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ধারণা করা হচ্ছে, ২০০০-২০১৫ সালের মধ্যে এ মৃত্যুর সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
এখানে মনে রাখতে হবে, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোয় প্রাপ্ত তথ্য এবং প্রকৃত অবস্থার মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। এসব দেশে অধিকাংশ মানুষের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্ভবহয় না, ফলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণও জানা যায় না।
বাংলাদেশের অবস্থা ভারতের মতো দ্রুত অবনতিশীল না হলেও অসচেতনতা এবং যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে এ দেশ যে কোনো সময় মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে প্রথম এইডস শনাক্ত করা হয় ১৯৯৮ সালে। এরপর সরকারিভাবে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ১৩,০০০ এইডস আক্রান্তের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে এটা নিশ্চিত, প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।
কারণ
এইডস হওয়ার জন্য পরসপরসম্পর্কিত দুই ধরনের কারণ বিদ্যমান। (১)উপাদানগত এবং (২) আচরণগত।উপাদানগত কারণ পুরো বিশ্বে একই। যেমন-রক্ত, বীর্য, মায়ের বুকের দুধ (যদি মা সেই জীবাণু বহন করে) ইত্যাদির মাধ্যমে এইচআইভি একজনের শরীর থেকে অন্যের শরীরে সংক্রমিত হয়। কিন্তু যেসব আচরণকে এইডস আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ হিসেবে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে-দেখা যায়, এর ক্রমিক প্রাধান্যের ক্ষেত্রে উন্নত ও অনুন্নত/উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান।
২০০৪ সালের জরিপ অনুযায়ী উন্নত বিশ্বে, বিশেষত আমেরিকায় এইডসের যেসব উপাদান বা আচরণকে ক্রমানুসারে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে সেগুলো হলো-
পুরুষের ক্ষেত্রে
১. সমকামিতা-৫৮%
২. সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ-২১%
৩. বহুগামিতা (প্রধানত পতিতাসম্পর্কিত)-১১%
৪. বেপরোয়া যৌন আচরণ-৮%
৫. অন্যান্য-২%
অর্থাৎ অবৈধ যৌন আচরণের কারণে আক্রান্ত-৭৭%
মহিলাদের ক্ষেত্রে
১. বহুগামিতা-৬৪%
২. সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ-৩৪%
বাংলাদেশ এবং ভারতসহ অনুন্নত/উন্নয়নশীল দেশগুলোয় যেসব উপাদান বা আচরণকে ক্রমানুসারে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে সেগুলো হলো-
১. পতিতালয়
২. সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ
৩. সমকামিতা
৪. পেশাদার রক্তবিক্রেতা
৫. অন্যান্য
দেখা যাচ্ছে, প্রাধান্যের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলেও মূল কারণ দুটি, অবৈধ যৌন আচরণএবং মাদকদ্রব্য। অন্যান্য কারণগুলো এ দুটি কারণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেসম্পর্কিত।

আরো
পড়তে থাকুন

কোন মন্তব্য নেই :