প্রসব-পরবর্তী মায়ের পরিচর্যা ডা. হোসনে আরা বেবী

কোন মন্তব্য নেই
প্রসব-পরবর্তী ৬-৮ সপ্তাহ সময় একজন মায়ের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ের সঠিক পরিচর্যা একদিকে মাকে যেমন গর্ভ ও প্রসবসংক্রান্ত বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তনের পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সাহায্য করে, তেমনি মাকে এ সময়ের বিভিন্ন জটিলতা থেকে রক্ষা করে। সঠিকভাবে বাচ্চার যত্ন নিতে ও বুকের দুধ খাওয়াতে সাহায্য করে। কিন্তু অজ্ঞতা অথবা অনীহার কারণে আমাদের দেশে মায়েদের প্রসব-পরবর্তী সেবার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেবার হার অনেক কম।
প্রসব-পরবর্তী মায়ের
পরিচর্যার পদক্ষেপসমূহ
মায়ের বিশ্বাম, ঘুম ও চলাফেরা স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে প্রসবকালীন ধকল কেটে ওঠার পর মায়ের ৮-১০ ঘণ্টা সম্পূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন। এরপর থেকে মাকে স্বাভাবিক চলাফেরা শুরু করতে হবে। আজকাল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলাফেরা শুরু করতে বলেন ডাক্তারগণ। কারণ এর উপকারিতা অনেক।  যেমন-স্বাভাবিক চলাফেরা মাকে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে, প্রস্রাব-পায়খানার জটিলতা থেকে মুক্ত করে, জরায়ুর ভেতরে জমে থাকা রক্ত বের হয়ে যেতে সাহায্য করে এবং রক্ত জমাট বাঁধা রোগ হওয়া থেকে রক্ষা করে। তবে স্বাভাবিক চলাফেরা মানে এই নয় যে, মা তার দৈনন্দিন সাংসারিক অথবা চাকরিস্থলের কাজকর্ম শুরু করবে। প্রসব পরবর্তী ৬-৮ সপ্তাহ সকল পরিশ্রমের এবং ভারী কাজ থেকে মাকে বিরত থাকতে হবে। কারণ মায়ের এ সময় মানসিক এবং শারীরিক বিশ্রাম প্রয়োজন। দুপুরে খাবার পর কমপক্ষে ২ ঘণ্টা বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। প্রতিদিন বিশ্রামের সময় কিছুক্ষণ উপুড় হয়ে শোয়া ভালো, যা জরায়ুর অবস্থান স্বাভাবিক হতে সাহায্য করে। শারীরিক ও মানসিক বিশ্রামের ফলে মা নিজে সুস্থ থেকে বাচ্চাকে সঠিকভাবে যত্ন নিতে ও বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন।
মায়ের খাবার
প্রসব-পরবর্তীতে মায়ের স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ৫০০ ক্যালরি খাবার বেশি খাওয়া দরকার। এই অতিরিক্ত ক্যালরি বুকের দুধ তৈরির জন্য প্রয়োজন হয়। তাই এ সময় মাকে সঠিকমাত্রায় সুষম খাবার খেতে হবে। পাশাপাশি প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে। এ সময় মায়ের দেহে পানির প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায় ও ঘন ঘন পিপাসা পায়। মাকে সব সময় পিপাসা পেলেই প্রচুর পানি পান করতে হবে। পানি পানের উপকারিতা অনেক যেমন-এই পানি বুকের দুধের মাধ্যমে বাচ্চার পানির প্রয়োজনীয়তা মেটায়। বাচ্চাকে আলাদা করে পানি খাওয়ানোর প্রয়োজন হয় না। পানি মায়ের শরীরের বিভিন্ন পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে, প্রস্রাবের প্রদাহ, কোষ্টকাঠিন্য এবং রক্ত জমাট বাঁধা রোগ হওয়ার ঝুঁকি কমায়। সুষম খাবার ছাড়াও মাকে এ সময় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন বড়ি খেতে হবে।
প্রস্রাবের সমস্যা
ডেলিভারির পর মায়ের প্রস্রাবের বিভিন্ন রকমের সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যেমন-প্রস্রাবের সংক্রমণ, পরিপূর্ণভাবে প্রস্রাব না হওয়া, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এসব সমস্যাকে এড়ানোর জন্য প্রয়োজন প্রচুর পানি পান করা, প্রস্রাব আটকে না রেখে বারবার প্রস্রাব করা, সঠিক এবং পরিচিত স্থানে প্রস্রাব করা, স্বাভাবিক চলাফেরা করা, পেটে বা সেলাইয়ের স্থানে ব্যথা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথার ওষুধ সেবন করা।
সেলাইয়ের স্থানের যত্ন
অনেক সময় স্বাভাবিক ডেলিভারির সময় পেরিনিয়াম কাটা ও সেলাইয়ের প্রয়োজন হয়। কাটা স্থান তাড়াতাড়ি ভালো হওয়ার জন্য স্থানটি শুকনো পরিষ্কার রাখা দরকার। প্রতিবার টয়লেটে যাওয়ার পর স্থানটি ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার ও শুকনো গজ অথবা কাপড় দিয়ে শুকাতে হবে। প্রসব-পরবর্তী রক্তস্রাবের (মাসিক) জন্য ভালো স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে হবে এবং তা বার বার পরিবর্তন করতে হবে যাতে সেলাইয়ের স্থানটি বেশিক্ষণ রক্তস্রাব দিয়ে ভেজা না থাকে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে।
স্তনের যত্ন
ডেলিভারির পর মায়ের স্তনে দুধ আসার কারণে বিভিন্ন পরিবর্তন হয়, যার জন্য প্রয়োজন স্তনের সঠিক পরিচর্যা। সঠিক যত্নের অভাবে মায়েরা বিভিন্ন জটিলতায় ভুগে থাকেন। প্রতিদিন গোসলের সময় এবং বাচ্চার দুধ খাওয়ানোর আগে স্তনের বোটা পরিষ্কার করতে হবে, যাতে দুধ বের হওয়ার ছিদ্রগুলো বন্ধ না হয়ে যায়। এ সময় স্তনের আকার বড় ও ভারী হয়ে থাকে। ডেলিভারির ২-৩ দিন পর স্তনে প্রচুর দুধ আসার ফলে স্তন শক্ত হতে পারে ও ব্যথা হতে পারে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হচ্ছে বারবার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো। স্তনে হালকা গরম সেঁক দেয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে ব্যথার ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
বাচ্চার যত্ন
প্রসব-পরবর্তীতে স্বাভাবিক চলাফেরা ছাড়া মায়ের একটি অন্যতম কাজ হচ্ছে বাচ্চার যত্ন নেয়া। বাচ্চার যত্ন ও পরিচর্যার দায়িত্ব অন্যের হাতে না দিয়ে মায়ের নিজের হাতে করাই ভালো। এতে বাচ্চার বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যায়। বাচ্চার যত্নে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে-
  • ডেলিভারির পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করতে হবে
  • ৬ মাস বাচ্চাকে শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে
  • বাচ্চার নাভী পরিষ্কার, শুকনো এবং খোলা রাখতে হবে। কোনো কিছু লাগানোর প্রয়োজন নেই
  • বাচ্চা ও মা একই বিছানায় থাকবে। বাচ্চাকে সব সময় মায়ের খুব নিকট সংস্পর্শে রাখতে হবে। কোনো নিয়ম না করে বাচ্চা যখন এবং যতক্ষণ খেতে চায়, ততক্ষণ বুকের দুধ খাওয়াতে হবে
  • শুয়ে বসে মায়ের সুবিধা অনুযায়ী বাচ্চা ও মায়ের যেকোনো অবস্থানে মা তার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন, যদি এতে মা ও বাচ্চা উভয়ে সন্তষ্ট থাকে এবং বাচ্চা ঠিকমতো বুকের দুধ পেয়ে বেড়ে ওঠে। তবে যেসব মায়েরা বিশেষ করে নতুন মায়েরা যারা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে সমস্যায় পড়েন, তাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাচ্চাকে রোগ প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে।
মাকে টিকা প্রদান
প্রয়োজন অনুযায়ী ডেলিভারির পর মায়েদের বিভিন্ন টিকা দিতে হবে।
ইনজেকশন অ্যান্টি-ডি
যেসব মায়েদের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ এবং বাচ্চার গ্রুপ পজিটিভ, সেসব মায়েদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব (সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে) এই ইনজেকশন দিতে হবে।
এমএমআর ভ্যাকসিন
যেসব মায়েদের রুবেলা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি আছে, তাদের ডেলিভারির ১৪ দিনের মধ্যেই ভ্যাকসিন দেওয়া যেতে পারে।
টিটি ইনজেকশন
কোনো কোনো মায়ের এ সময় এই ইনজেকশনের একটা ডোজ দেওয়ার তারিখ থাকে। তাদের এই টিকা দিতে হবে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ
গর্ভধারণ ও ডেলিভারির ফলে মায়ের শরীরে রক্তের যে ঘাটতি হয় তা পূরণ হতে ২ বছর সময় লাগে। সে জন্য পরবর্তী গর্ভধারণ কমপক্ষে ২ বছরের আগে নেয়া উচিত নয়। কিন্তু ভুল ধারণা, অজ্ঞতা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে অনেক মায়েরা না চাওয়া সত্ত্বেও স্বল্প সময়ের মধ্যে পুনরায় গর্ভবতী হয়ে পড়েন। এমনকি কেউ কেউ পরবর্তী মাসিক হওয়ার আগেই গর্ভবতী হয়ে পড়েন। এর জন্য প্রয়োজন চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করা এবং তা শুরু করতে হবে ডেলিভারির ৪০ দিন পর থেকেই। প্রসব-পরবর্তী প্রথম ২-৩ সপ্তাহ যখন রক্তস্রাব থাকে এবং সেলাই থাকলে সেলাই-এর ব্যথা ও ক্ষত যত দিন ভালো না হয়, তত দিন সহবাস থেকে বিরত থাকতে হয়। তবে আমাদের দেশের মায়েরা সাধারণত ডেলিভারির পর ৪০ দিন পর্যন্ত সহবাস করা থেকে বিরত থাকেন। তাই ডেলিভারির ৪০ দিন পর থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ব্যবহার করা শুরু করতে হয়। ডেলিভারির পর বুকের দুখ খাওয়ানোর জন্য অনেক মায়েদের মাসিক বন্ধ থাকে। মায়েদের ভুল ধারণা আছে যে, মাসিক বন্ধ থাকলে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেবার দরকার নেই। তবে ডেলিভারির পর প্রথম ৬ মাস যখন মায়েরা বাচ্চাদের শুধু বুকের দুধ খাওয়ান তখন মাসিক বন্ধ থাকলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা খুবই কম। তাই এ সময় কনডম অথবা প্রজেসটিন পিল (মিনিকন) ব্যবহার করলেই হবে। কিন্তু ৬ মাস পর থেকে বা প্রথম ৬ মাসের মধ্যেই যদি মায়ের মাসিক শুরু হয়ে যায় অথবা মা যদি বাচ্চাকে বুকের দুধ ছাড়াও অন্য কিছু খাওয়ান, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভালো ও কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রসব-পরবর্তী ব্যায়াম
স্বাভাবিক প্রসবের পর মায়ের কিছু কিছু হালকা ব্যায়াম করা প্রয়োজন। যা একদিকে মায়ের ঢিলে হয়ে যাওয়া মাংসপেশি সংকুচিত হয়ে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে সাহায্য করে, অন্যদিকে মা কিছু কিছু রোগ হওয়া থেকে রক্ষা পান। যেমন-রক্ত জমাট বাঁধার রোগ, কোমরব্যথা, জরায়ু নেমে আসা ইত্যাদি। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক নিয়মে ব্যায়াম করতে হবে।
প্রসব-পরবর্তী চেকআপ
ডেলিভারির ৬-৮ সপ্তাহ পর মাকে অবশ্যই একবার চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত, সম্পর্ণ চেক-আপের জন্য। আমাদের দেশের মায়েদের এই সেবা গ্রহণের হার খুবই কম। এ সময় চিকিৎসক মাকে সম্পূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন চিকিৎসা ও উপদেশ দিয়ে থাকেন। এই চেক-আপের সুবিধাসমূহ হচ্ছে-
  • গর্ভধারণের সময় মায়ের শরীরে যে পরিবর্তন হয়েছিল তা পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে কিনা চিকিৎসক তা নির্ণয় করে থাকেন
  • মায়ের কোনো রোগ থাকলে তা নির্ণয় করতে এবং তার চিকিৎসা দিতে পারেন
  • মাকে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিতে উদ্বুদ্ধ এবং সাহায্য করতে পারেন
  • বাচ্চার যত্ন, বুকের দুধ খাওয়ানো এবং টিকা দেয়ার বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিতে পারেন
  • মায়ের কোনো সমস্যা থাকলে তা সমাধানে সাহায্য করতে ও উপদেশ দিতে পারেন
সুতরাং মনে রাখতে হবে, মা ও বাচ্চার সুস্থতার জন্য সকল মায়ের প্রয়োজন প্রসব-পরবর্তী সেবা। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উচিত মাকে এই সেবা নেয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা।
লেখকঃ সিনিয়র কনসালটেন্ট
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা

facebook  Syed Rubel
শেয়ার করে আপনার বন্ধুদেরকে জানান । তাদের কে জানতে দিন অজানা বিষয় গুলি। প্রকাশক ও সম্পাদক ব্লগার_সৈয়দ রুবেল লেখকজানার আছে অনেক কিছু

কোন মন্তব্য নেই :