কিডনি রোগে ডায়াবেটিসের প্রভাব

কোন মন্তব্য নেই
ডা. মোঃ শহীদুল ইসলাম (সেলিম)
সহযোগী অধ্যাপক, নেফ্রোলজি বিভাগ
বি এস এম এম ইউ, ঢাকা

কিডনি সম্পূর্ণভাবে বিকল বা অকেজো হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে উন্নত দেশে ডায়াবেটিসকে প্রধান এবং আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এটাকে দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস রোগীদের বেলায় এই রোগের হার শতকরা ৪০-৫০ ভাগ এবং যারা ইনসুলিন নির্ভরশীল নন তাদের বেলায় শতকরা ১৫-২০ ভাগ। কাদের বেলায় ডায়াবেটিসজনিত নেফ্রোপ্যাথি হবে এবং কোন ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসজনিত নেফ্রোপ্যাথি হবে না তা এখনও পরীক্ষাধীন রয়েছে। এসব রোগীর নিয়মিত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ছাড়াও জেনেটিক্সের  প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করে কোন ডায়াবেটিক রোগীদের নেফ্রোপ্যাথি হবে। সাধারণত ইনসুলিন নির্ভরশীল ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে এই রোগের কারণে কিডনিতে প্রাথমিক বিপর্যয় শুরু হয় ৭-১০ বছরের মধ্যে, যখন কোনো উপসর্গই থাকে না শুধু প্রস্রাবে প্রোটিনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় এবং ১০-১৫ বছরের মধ্যে প্রস্রাবে প্রোটিনের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায় তখন তাকে বলা হয় নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম এবং এ সময় রোগীর শরীরে পানি আসা শুরু হয় আর ১৫-২০ বছরের মধ্যে কিডনির কার্যক্রম হ্রাস পেতে থাকে। তখন একে ধীরগতিতে কিডনি ফেইলিওর বলা হয়।
উপসর্গসমূহ
প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথির কোনো উপসর্গ থাকে না। উপসর্গ যখন দেখা যায় ততোদিনে কিডনির অনেকটা ক্ষতি হয়ে থাকে। প্রধান প্রধান উপসর্গগুলো হচ্ছে পায়ে পানি আসা এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়া। এদেরকে পরীক্ষা করে চোখের ও স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতার উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত ডায়াবেটিস হওয়ার ৫ থেকে ১৫ বছর পর এ ধরনের জটিলতা দেখা যায়। এই পর্যায়ে চিকিৎসায় খুব ভালো ফল লাভ করা সম্ভব। এজন্যই প্রতিদিন এসব রোগীকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পরপরই প্রস্রাবে অ্যালবুমিন আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। আমরা যে পদ্ধতিতে প্রস্রাবে অ্যালবুমিন পরীক্ষা করে থাকি তাতে ২৪ ঘন্টায় এ্যালবুমিন ৩০০ মি. গ্রা-এর উপরে গেলেই ধরতে পারি। কিন্তু ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথির প্রাথমিক পর্যায়ে ২৪ ঘন্টার প্রস্তাবে অ্যালবুমিনের পরিমাণ ৩০ মিঃ গ্রাঃ গেলেই বলা হয়ে থাকে Microalbuminuria বা Incipient Nephropathy  বলা হয়ে থাকে।
পরীক্ষা পদ্ধতি
প্রাথমিক পর্যায়ে শারীরিক পরীক্ষা করে উল্লেখযোগ্য কিছুই ধরা পড়ে না। তবে সময়ের তারতম্য হিসেবে ডায়াবেটিস রোগের জটিলতা, চোখের রেটিনোপ্যাথি, বিভিন্ন প্রকার চর্ম ও স্নায়ু রোগের অবস্থান পরীক্ষা করে ধরা পড়ে।
প্রতিটি ডায়াবেটিস রোগীর সকালের প্রস্রাব পরীক্ষা করে প্রস্রাবে অ্যালবুমিন বা আমিষ, সুগার বা শর্করা আছে কিনা তা দেখা উচিত। অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে প্রস্রাবে লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা ও কাস্ট দেখা হয়। যদি প্রস্রাবে শ্বেত কণিকা পাওয়া যায়, প্রস্রাব কালচারের মাধ্যমে জীবাণুজনিত ইনফেকশন আছে কিনা তা নির্ণয় করা হয়ে থাকে।
২৪ ঘন্টার প্রস্রাব পরীক্ষা করে কত পরিমাণ অ্যালবুমিন যাচ্ছে তা নির্ণয় করা হয়। ২৪ ঘন্টায় অ্যালবুমিন ৩০০ মিঃ গ্রাঃ-এর উপরে গেলেই ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি ভাবা হয়। উন্নত বিশ্বে ৩০০ মিঃ গ্রাম-এর নিচে এবং ৩০ মিঃ গ্রাঃ-এর উপরে অ্যালবুমিন গেলেও ধরতে পারা যায় যাকে Microalbuminuria বলে।
প্রতিটি রোগীর রক্তের ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড, বাইকার্বোনেট পরীক্ষা করে দেখা হয়।
প্রস্রাবে যদি ৩০০ মিঃ গ্রাঃ-এর উপর অ্যালবুমিন যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে রক্তে ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে তখন কিডনি অকেজো হওয়ার প্রাথমিক পর্যায় ধরা হয়। ২৪ ঘন্টার প্রস্রাবে যদি অ্যালবুমিন ৩ গ্রামের উপরে যায় তাহলে রোগীর শরীরে  পানি জমতে শুরু করে তখন তাকে Nephrotic Syndrome বলা হয়। প্রতিটি রোগীর রক্তের কোলেস্টোরেল এবং প্রোটিন একই সঙ্গে দেখে নেয়া উচিত। রক্তের প্রোটিনের পরিমাণ ও অ্যালবুমিন  দেখা প্রয়োজন এবং কোনো কারণে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস শরীরে আছে কিনা তাও জেনে নেয়া প্রয়োজন। কিডনির সনোগ্রাম করে তার শারীরিক অবস্থান প্রস্রাবের রাস্তা ও থলির অবস্থা জেনে নেয়া উচিত। প্রয়োজনবোধে কিডনির বায়োপসি পর্যন্ত করা যেতে পারে। ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি ছাড়াও ডায়াবেটিক রোগী প্রস্রাবে জীবাণুজনিত ইনফেকশন এবং স্নায়ুতন্ত্রের বৈকল্য রোগে ভুগতে থাকে। অনেকের নেফ্রাইটিস জাতীয় রোগও একই সঙ্গে থাকতে পারে। তাই এই সমস্ত রোগীর সঠিক রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত।
চিকিৎসা ব্যবস্থা
ডায়াবেটিস নেফ্রোপ্যাথির চিকিৎসা নির্ভর করে ডায়াবেটিস দ্বারা কিডনি কতখানি আক্রান্ত হয়েছে তার ওপর। প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়াবেটিক রোগীর নেফ্রোপ্যাথি ধরার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার লক্ষণও দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে রোগীর ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণের ভেতরে আনা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে খাবারের তালিকা সঠিক আছে কিনা তা বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা হয়। প্রস্রাবে যদি অ্যালবুমিন নির্গত হয় তাহলে ACE inhibitor  জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়। ACE inhibitor  জাতীয় ওষুধ কিডনির ছাকনির ওপর কাজ করে অ্যালবুমিন নির্গত হওয়ার পরিমাণকে কমিয়ে দেয়। রোগীর যদি এ পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপ থাকে তাহলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করা হয় এবং তা ACE inhibitor দ্বারা করাই শ্রেয়। এই ওষুধ দ্বারা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের এবং প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নির্গত হওয়ার পরিমাণ কমানোর ব্যবস্থা করলে নেফ্রোপ্যাথি হওয়ার পরেও কিডনি অকেজো হওয়ার প্রবণতা অনেকাংশে কমে যায়। রোগী যখন Diabetic Nephropathy-এর সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ এবং রক্তে ইউরিয়া/ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে কিডনি ফেইলিউর এর লক্ষণ নিয়ে আসে তখন এদের চিকিৎসায় জটিলতা হয়। এসব ক্ষেত্রে প্রস্রাবে আমিষ নির্গত হওয়া কমানোর জন্য ACE inhibitor জাতীয় ওষুধ দেয়ার আগে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কেননা কিডনির কাজ বেশি লোপ পেয়ে গেলে ACE inhibitor  জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এতে রক্তে পটাশিয়ামের পরিমাণ বাড়ায় যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এই পর্যায়ে রোগীর খাবারে আমিষের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হয় অর্থাৎ রক্তের ক্রিয়েটিনিনের ওপর নির্ভর করে আমিষের পরিমাণ ০.৫ থেকে ০.৭৫ গ্রাম প্রতি কেজি শরীরের ওজনের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। অনেক রোগীর ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি হওয়ার পর পা ও পেটে পানি আসে। এসব ক্ষেত্রে খাওয়ার পানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয় যা ২৪ ঘন্টায় ১ লিটারের মধ্যে রাখা প্রয়োজন।
পানি শরীর থেকে বের করে দেয়ার জন্য লুপ ডাইয়ুরেটিক্স জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়ে থাকে এবং কিডনির কার্যকারিতা ও শরীরে পানির পরিমাণ অনুযায়ী ওষুধের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
  বিষয়ঃ মাসিক মনোজগত 
মনোজগত : এপ্রিল, ২০০৪
 ফেসবুকে  ব্লগারের সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ করুণ 

আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুণ। 

 এই ব্লগে পড়তে কি সমস্যা হয়?আপনার কি টাকা বেশি খরচ হয়ে যায়?

কোন মন্তব্য নেই :