রক্ত পরিসঞ্চালন সতর্কতা ও করণীয়

undefined
হাত, পা অথবা চোখ ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব হলেও, রক্ত ছাড়া বাঁচার কথা কল্পনাও করা যায় না। মানবদেহে রক্ত তাই অপরিহার্য। দেহের কোষে কোষে অক্সিজেন এবং পুষ্টি উপাদান পৌঁছে দেয়া, কার্বন-ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য বর্জ্য ফিরিয়ে আনা, হরমোন, লবণ ও ভিটামিন পরিবহন, রোগ প্রতিরোধ, দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ সবকিছুতেই রক্তের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই কারও দেহে রক্তের অভাব ঘটলে তা প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে অন্যের রক্ত শিরার মাধ্যমে রোগীর দেহে প্রবেশ করানো তথা রক্ত পরিসঞ্চালন হয়ে ওঠে অন্যতম উপায়।
যে কারণে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন পড়ে
রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে প্রয়োজনভেদে রোগীর শরীরে সম্পূর্ণ রক্ত বা রক্তের কোনো উপাদান যেমন লোহিত কণিকা, অণুচক্রিকা বা রক্তরস দেয়া হয়।
  • যে কোনো কারণে অল্প সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে সাধারণত সম্পূর্ণ রক্ত (যিড়ষব নষড়ড়ফ) দেয়া হয়। যেমন দুর্ঘটনা, রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে রক্তপাত, প্রসবকালীন রক্ত ক্ষরণ ইত্যাদি।
  • জটিল বা বড় ধরনের শল্য চিকিৎসার সময়ও সম্পূর্ণ রক্তের প্রয়োজন হয়।
  • বিভিন্ন রকমের অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতায় সাধারণত লোহিত কণিকা (চধপশবফ জইঈ) দেয়া হয় যেমন-থ্যালাসেমিয়াসহ অন্যান্য হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া, আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা, হুকওয়ার্মের কারণে অ্যানিমিয়া ইত্যাদি। অবশ্য আমাদের দেশে খরচের কথা বিবেচনা করে এসব রোগীকেও সম্পূর্ণ রক্ত দেয়া হয়।
  • এছড়া হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বর, ওঞচ ইত্যাদি রোগে প্লেটলেট বা অণুচক্রিকা দেয়া হয়।
  • রক্তরস দেয়া হয় হিমোফিলিয়া ও অন্যান্য কোয়াগুলেশন ডিজঅর্ডারে এবং আগুনে পোড়া রোগীকে।
রক্ত পরিসঞ্চালন করলে কী জটিলতা হয়
জীবন রক্ষার অন্যতম উপায় এই রক্ত পরিসঞ্চালন আবার কখনো কখনো তৈরি করতে পারে জটিলতা।
  • রক্তবাহিত রোগের সংক্রমণ আমাদের দেশে এখনো একটি প্রধান সমস্যা। হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইডসসহ বিভিন্ন প্রাণঘাতী জীবাণু সহজেই রক্তের মাধ্যমে রক্তগ্রহীতার দেহে প্রবেশ করতে পারে। এ পরিস্থিতির মূল কারণ রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে রক্তটি জীবাণুমুক্ত কি না তা যথাযথভাবে পরীক্ষা না করা। অনুমোদনবিহীন ব্লাডব্যাংকগুলোতেই এসব রক্ত বিক্রি করা হয়। আর তা আসে মূলত নেশাসক্ত পেশাদার রক্ত দানকারীদের থেকে। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ রক্ত বা ভেজাল রক্ত এসব ব্লাডব্যাংক থেকেই আসে।
  • ভুলক্রমে এক গ্রুপের রক্ত অন্য গ্রুপের রোগীকে দিলে রক্ত হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী। এ ধরনের ঘটনা কম হলেও একেবারেই হয় না তা নয়। এসব ক্ষেত্রে রক্ত সংগ্রহকারী ও পরীক্ষাকারী ব্লাডব্যাংক, চিকিৎসক অথবা নার্স যে কারও ভুল বা অসতর্কতাই দায়ী। রোগী সাধারণত বুকে-পিঠে ব্যথা ও শ্বাসকষ্টের অভিযোগ করে থাকে। চিকিৎসক দ্রুত ব্যবস্থা নিলে পরবর্তী জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়।
  • এছাড়া যে কোনো পরিসঞ্চালনেই কাঁপুনি ও জ্বর আসা এবং অ্যালার্জি জাতীয় ছোটখাটো সমস্যা হতে পারে।
  • যাদের কিছুদিন পরপর রক্ত নিতে হয় তাদের দেহে লৌহের আধিক্যসহ অন্যান্য সমস্যা হতে পারে।
  • অনেক সময় অধিক রক্ত দ্রুত প্রবেশ করলে বৃদ্ধ অথবা হৃদরোগীর হার্ট ফেইলিউর জাতীয় সমস্যা হতে পারে।
  • অবশ্য রোগী বা তার আত্মীয়স্বজন সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েন রক্ত পরিসঞ্চালনের আগেই, যখন দেয়ার জন্য রক্ত খুঁজতে থাকেন। পাড়ায় পাড়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো অবৈধ ব্লাডব্যাংক গড়ে উঠলেও নিরাপদ রক্ত এখনো দুর্লভ। বিশেষ করে জরুরি মুহূর্তে রক্ত প্রয়োজন হলে তা হয়ে ওঠে সোনার হরিণ। এছাড়া যাদের ঘন ঘন রক্ত নিতে হয় তাদের বেশির ভাগ সময় যায় রক্তের খোঁজে। দুর্লভ গ্রুপের রক্ত হলে তো কথাই নেই।
রক্ত যে কারোরই যে কোনো সময় প্রয়োজন হতে পারে, এ কথা মনে রেখে আমরা যদি এখনই প্রস্তুতি নিয়ে রাখি তবে রক্ত পরিসঞ্চালনের সমস্যা থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। আমাদের যেসব উদ্যোগ নিতে হবে তা হলো-
  • নিজের এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের রক্তের গ্রুপ জেনে রাখা।
  • নিকটস্থ ব্লাডব্যাংকের ঠিকানা ও ফোন নম্বর জেনে রাখা।
  • শুধু নিবন্ধনকৃত ব্লাডব্যাংকে রক্ত দান ও গ্রহণ করা।
  • পেশাদার রক্তদাতার রক্ত ক্রয় না করা।
  • নিজে নিয়মিত রক্ত দান করা ও সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা।
  • রক্তবাহিত রোগে সংক্রমিত হলে রক্ত দান না করা।
রক্ত নেয়ার আগে সতর্কতা
  • রক্ত নেয়ার আগে প্রয়োজন রক্তের গ্রুপ ঠিক আছে কি না দেখে নেয়া।
  • অপরিচিত পেশাদার রক্তদাতার রক্ত না নেয়া। পেশাদার রক্তদাতারা অনেকেই মাদকাসক্ত, দেহে বহন করে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি ও এইডসসহ বিভিন্ন প্রাণঘাতী জীবাণু ও সংক্রামক ব্যাধির জীবাণু।
  • সবচেয়ে ভালো নিজস্ব আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিত সুস্থ-সবল লোকের রক্ত নেয়া।
  • স্ক্রিনিং টেস্টের মাধ্যামে রক্তদাতার ঐনংঅম, ঐঈঠ, ঐওঠ ইত্যাদি পরীক্ষা করতে হবে।
  • মনে রাখা প্রয়োজন, রক্তের অভাব এবং অনিরাপদ রক্ত দুটোই জীবনের জন্য সমান হুমকি। তাই রক্তের বিকল্প শুধু রক্ত নয় বরং ‘নিরাপদ রক্ত’।
জেনে রাখুন
  • যে কোনো সুস্থ সাবালক ব্যক্তি রক্ত দান করতে পারেন। তবে ওজন হতে হবে কমপক্ষে ৫০ কেজি বা ১১০ পাউন্ড।
  • একবার সম্পূর্ণ রক্তদানের দুই মাস পর আবার রক্ত দান করা সম্ভব।
  • উচ্চরক্তচাপ থাকলে অথবা কোনো ওষুধ সেবনকালীন রক্ত দান করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
  • গর্ভাবস্থায় রক্ত দান করা যাবে না।
  • যথাযথ নিয়ম মেনে জীবাণুমুক্ত উপায়ে রক্তদান করলে রক্তদাতার কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই।
  • রক্তদানের পর ১০ মিনিট বিশ্রাম নিতে হবে এবং পরবর্তী ৪ ঘণ্টা পর প্রচুর পানীয় গ্রহণ করতে হবে। কমপক্ষে ৩০ মিনিট ধূমপান থেকে বিরত থাকা উচিত।
  • রক্তদানের পরপরই শ্রমসাধ্য বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
  • সম্পূর্ণ রক্ত অথবা লোহিত কণিকা (চধপশবফ জইঈ) সাধারণত ১ থেকে ৬ ডিগ্রি সে তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। ব্যবহৃত অ্যান্টি কোয়াগুল্যান্ট ও প্রিজারভেটিভের ওপর নির্ভর করে তা ২১ থেকে ৪২ দিন ভালো থাকে।
  • সাধারণত ৪ ইউনিট রক্ত থেকে ১ ইউনিট প্লেটলেট পাওয়া যায়। যথাযথ প্রক্রিয়ায় রাখলে তা ৫ দিন ভালো থাকে।
  • ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা-১৮ ডি. সে. তাপমাত্রায় ১ বছর ভালো থাকে।
  • সম্পূর্ণ রক্ত দিতে সাধারণত ২ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয়। প্লেটলেট দিতে কম সময় লাগে।
  • রক্ত গ্রহণ অবস্থায় খাওয়া-দাওয়া করতে কোনো সমস্যা নেই। এমনকি নার্সের সহায়তা নিয়ে বাথরুমেও যাওয়া যাবে।
  • রক্ত দেয়া অবস্থায় সামান্য জ্বর বা অ্যালার্জি দেখা দিলে ভয়ের কিছু নেই। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে অ্যান্টিহিস্টামিন বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দিলেই চলবে।
  • রক্ত দেয়ার আগে এবং রক্ত চলাকালীন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে রক্তের গ্রুপ, ব্যাগের নম্বর, রোগীর নম্বর, নাম ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
  • উপসংহারে বলা যায়, রক্ত পরিসঞ্চালন অবশ্যই নিরাপদ হতে হবে। তা না হলে মানুষের জীবন রক্ষার পরিবর্তে অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালনে জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এর জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা কার্যকর করা অত্যন্ত জরুরি। এর মাধ্যমে রক্তবাহিত রোগগুলো প্রতিরোধ ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব।
-সংকলিত