বাংলাদেশের বিশিষ্ট মনোশিক্ষাবিদ, মনোবিজ্ঞানী ও মনোচিকিৎসক
অধ্যাপক ডা. এ এইচ মোহাম্মদ ফিরোজ
মানসিক রোগ শিক্ষা, গবেষণা, চিকিৎসা ও জনসচেতনতায় পথিকৃৎ
বাঙালির জীবনে মাথাব্যথা প্রবল সমস্যা। ১৫ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে প্রতিদিন ন্যূনতম ১০% লোক মাথাব্যথায় আক্রান্ত হন। অন্যান্য দেশে একই হার। মাথাব্যথা আমাদের জীবনে এত বেশি ‘কমন’ যে এর মধ্যে যারা যারা মাথাব্যথায় ভোগেন তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হন না। নিজেরাই নিজের চিকিৎসা করেন। প্যারাসিটামলের কথা সবাই জানি। ঙঞঈ  জাতীয় ওষুধের মধ্যে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট, যা পৃথিবীর যে কোনো আনাচে-কানাচে ব্যাপকভাবে বিক্রি হয়। আরেকটি ঙঞঈ যা প্রেসক্রিপশন ছাড়া পাওয়া যায়, এমন ওষুধ ডায়াজিপাম। জন্মকাল থেকে প্রতিটি নারী-পুরুষ সিডাক্সেন ট্যাবলেটের সাথে পরিচিত। যে কোনো বাড়িতে ন্যূনতম ২টি ওষুধ যদি থাকে তার একটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ও সিডাক্সেন ট্যাবলেট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যারা এ ওষুধ ব্যবহার করেন তারা মাথাব্যথার জন্যই ব্যবহার করেন। ঘুমের জন্য নয়, মাথাব্যথা কমানোর জন্য।
ডায়াজিপাম ওষুধের ব্যাপারে ১৯৮৯ সালে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের প্রায় ৫ লক্ষ মহিলা, গৃহিণী প্রতিরাতে ঘুমের ওষুধ খান। স্বভাবত আগামীতে এই পরিমাণ আরো বেশিই হবে।
সাধারণভাবে কর্মজীবী গৃহিণী ও পড়ুয়া মেয়েদের মধ্যে এই জাতীয় প্যারাসিটামল, সিডাক্সেন জাতীয় ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা উল্লেখ করা যায়। আমরা এ দেশের জনগণ, হরহামেশা একজনের অসুখের কথা শুনলে চট করে ওষুধের কথা বলি এবং প্রায় প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের কথা বলি। সমকালীন সাহিত্যে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক এই প্যারাসিটামল বা সিডাক্সেন ট্যাবলেট তাদের বইতে প্রেসক্রাইব করে থাকেন।
১. মাথাব্যথা কী?
ঘাড়ের উপরের অংশ মাথা। ঘাড়ের অংশ বাদ দিলে গোলাকার বস্তুটি মাথা। মাথায় আমরা ধরি দুটি চোখ, দুটি কান, নাক, মুখ ও দুপাটি দাঁত। এছাড়া অ্যানাটমিতে মাথায় পাওয়া যায় মাংসপেশি, হাড়, মেনিনজেস এবং শেষে মগজ। মেনিনজেস আবার ৩ ভাগে বিভক্ত : একটি ডুরা, আরেকটি অ্যারাকনয়েড ও পায়া ম্যাটার। ডুরা ম্যাটার হাড়ের ভেতরের অংশে লেগে থাকে। অ্যারাকনয়েড ম্যাটার ডুরা এবং পায়া ম্যাটারের মধ্যে থাকে। ডুরা এবং অ্যারাকনয়েড ম্যাটারের মধ্যে ফাঁকা জায়গা আছে। অ্যারাকনয়েড এবং পায়া ম্যাটারের মধ্যেও ফাঁকা জায়গা আছে। ফাঁকা জায়গাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের তরল পদার্থ আছে-যাতে করে ভেতরে মগজের অংশে নড়াচড়ায় কোনোরূপ ব্যাঘাত না হয় বা বাইরের চাপে মূল অংশের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। মগজকে আবার সেরিব্রাল হেমিস্কেয়ার বা সেরিব্রাল করটেক্স ও সেরিবেলাম নামে ভাগ করা হয়েছে। কর্টেক্সে বিভিন্ন রকম মেডিকেল ভাগ আছে। কর্টেক্স থেকে স্নায়ুতন্ত্র উৎপত্তি হয়। সেখান থেকে নিউরোনের ফাইবার ধরে অনেক কোটি কোটি স্নায়ুতন্ত্র মিলে হয় স্পাইনাল কর্ড। কর্ডের কাজ হচ্ছে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে সংবেদনশীল অনুভূতি মাথায় পৌঁছে দেয়া আর মাথায় বা মগজে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা বিভিন্ন অঙ্গে পৌঁছে দেয়া। একে বলে রিফ্লেক্স। মাথা কাজ করে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মতো।
তাই মাথাব্যথা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বুঝতে হবে। মাথাব্যথা বলতে মাথার বিভিন্ন অংশ থেকে যে ব্যথা হয় তাকে মাথাব্যথা বলে। আমরা বেশির ভাগ মাথার পেশির ব্যথার কথা বলি।
২. মাথাব্যথা কত রকমের?
অনেক ধরনের মাথাব্যথার কথা আমরা জানি। তার মধ্যে টেনশন টাইপ ও মাইগ্রেন টাইপের ব্যথা সবচেয়ে বেশি। এদের চিকিৎসাও ভিন্নতর।
টেনশন টাইপ ব্যথা
উপসর্গঃ ভারী ভারী একটানা এক ধরনের ব্যথা মাথার দুদিকে থাকে। মৃদু থেকে বেশি মাত্রায় হয়। মাথা দু হাত দিয়ে চেপে ধরেছে মনে হয়। মাথার চারদিকে একটি ব্যান্ড বেঁধে দিয়েছে বলে অনুভূত হয়। ব্যথা ঘাড় কিংবা কাঁধে চলে যায়।
সময়ঃ ১-২ ঘণ্টা থাকে। বেশিও থাকে। বিকেলের দিকে বা সন্ধ্যায় বেশি হয়। সারাদিনের পরিশ্রম ও মানসিক চাপের পরে যারা দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক টেনশন হেডেকে ভোগেন তাদের মাথাব্যথা প্রত্যেক দিন হয়।
কারণঃ আবেগজনিত চাপ বড় কারণ। তবে কিছু কিছু শারীরিক রোগেও হয়ে থাকে যেমন- আর্থ্রাইটিস।
চিকিৎসাঃ ওটিসি ড্রাগ দ্বারা বা টোটকা চিকিৎসা করা হয়। বিশ্রাম, মাথায় বরফ বা মানসিক চাপ মোকাবেলা ক্ষমতা বাড়ানোর মধ্যে টেনশন হেডেক সারানো যায়। যদি এই ব্যথা প্রতিদিন হয় তাহলে চিকিৎসক দেখাবেন।
মাইগ্রেন টাইপ ব্যথা
মাথাব্যথা মাঝারি থেকে বেশি মাত্রায় হয়। মাথাব্যথার ধরন-যেন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। মাথার একদিকে ব্যথা হয়। বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, কেমন কেমন লাগা, আলো বা শব্দে বিরক্তি উপসর্গ থাকতে পারে। ১৫% রোগী পূর্বেই বুঝতে পারেন মাথাব্যথা হবে।
বোঝার উপসর্গঃ চোখে আলো ঝলমলভাব পাওয়া যায়। মোট রোগীদের মধ্যে ৭০% মহিলা।
সময়ঃ ৩ ঘণ্টা থেকে ৩ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে।
পূর্বাভাসঃ প্রায় ১-২ ঘণ্টা পূর্বে হয়।
মাঝে মাঝে হয়। সপ্তাহের প্রতিদিনও হয়। গড়ে ১-৩ বার প্রতিমাসে হয়।
কারণঃ নানা বিশেষজ্ঞ নানা কারণ বলেন। জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়াই আসল কারণ। বংশানুক্রমিকও হয়। ৯০% ক্ষেত্রে বংশে মাথাব্যথার ইতিহাস থাকে।
কী কী জিনিসে হয়ঃ খাদ্যবস্তু, মদ বা পানীয়, মাসিক হওয়া, ক্যাফিন জাতীয় পদার্থ, আবহাওয়ার পরিবর্তন, ঘুমের অসুবিধা, মানসিক চাপ, ধূমপান, গরম, শব্দ ইত্যাদি কারণ হতে পারে। জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি, হরমোন এই ব্যথা বাড়াতে পারে।
চিকিৎসাঃ যেসব কারণে হয় তা থেকে সরে থাকা, মানসিক চাপ মোকাবিলা প্রধান চিকিৎসা, বিশ্রাম, বরফ ইত্যাদি সাহায্যকারী। অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ অনেক দিন খেতে হয়।
মাথাব্যথার অন্যান্য ধরন
ক্লাস্টার হেডেক সাধারণভাবে কম পাওয়া যায়। অত্যন্ত ব্যথা হয়, মনে হয় চাকু দিয়ে একটা চোখ কেটে ফেলছে। অনেক দিন থাকে না। ২০-৩০ বছর বয়সে বেশি হয়। যাদের হয় তাদের মধ্যে ৯০% পুরুষ।
৩.    কিছুক্ষণ একনাগাড়ে পড়লে মাথাব্যথা করে, কী করব?
চোখের কাজের চাপ থাকলে তাতে মাথাব্যথা করতে পারে। তবে কম আলোতে লেখাপড়া করলে বা অনেক সময় ধরে একটানা পড়লে মাথাব্যথা হতে পারে। আসলে চোখে তো ব্যথা হয় না, ব্যথা হয় চোখের পাশের ছোট ছোট মাংসপেশিগুলোতে। ওই মাংসপেশিগুলো আমাদের চোখ নড়াচড়ায় সাহায্য করে। চোখের মণি ছোট-বড় করতে সাহায্য করে। চোখের চাপ কমানোর জন্য উপযুক্ত আলোতে পড়াশোনা করুন। প্রতি ঘণ্টায় পড়ায় ৫ মিনিট বিশ্রাম নিন। মাঝে মাঝে রুমে এদিক-ওদিক তাকান। কাছে তাকান, দূরে তাকান। চোখের চাপে মাথাব্যথা শুরু হলে রুমের আলো ডিম করে দিন বা কম আলোকিত ঘরে যান, দুচোখের উপর দুহাত দিয়ে ঢাকুন। ঢাকা অবস্থায় চোখ খুলুন-এ রকম ৩০ সেকেন্ড রাখুন। চোখ বন্ধ করুন, হাত দুটো নামান, এবার আস্তে আস্তে চোখ খুলুন। এভাবে কয়েকবার করলে চোখজনিত মাথাব্যথা কমে যাবে।
৪.    মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমার মন
    অস্থির লাগে। আমার কী ইনসমনিয়া হয়েছে?
হতে পারে। ইনসমনিয়া, ঘুম আসতে কষ্ট হওয়া ও ঘুম ভেঙে যাওয়া বা ভেঙে গিয়ে আর ঘুম না আসা বা ভেঙে ভেঙে ঘুম হওয়াকে বোঝায়। যারা স্বাভাবিক ঘুমান তাদের ঘুম রাতে ৫-১৫ বার ভেঙে যায়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আবার তারা ঘুমান, কিন্তু ঘুম ভাঙার কথা তারা মনে করতে পারেন না। শতকরা ৫০ ভাগ অনিদ্রারোগ বিবাহজনিত মানসিক চাপ, চাকরির চাপ, দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশন রোগে হয়ে থাকে। আপনার মনে কোনো না কোনো বিষয়ে দুশ্চিন্তা খেলা করছে। আপনি ওইগুলো নির্ণয় করার চেষ্টা করুন ও সমাধানের চেষ্টা করুন। আপনার ঘুমের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
৫.    ঘূর্ণিঝড় বা ঝড়-বাদলের আভাস পেলে
    আমার মাথাব্যথা করে, কেন তা হয়?
হ্যাঁ তা হতে পারে। আবহাওয়ার পরিবর্তন, সাধারণভাবে ভালো থেকে খারাপ আবহাওয়ায় গেলে মাথাব্যথা হতে পারে। ওই মাথাব্যথা মাইগ্রেন বা অন্য কোনো ধরনের মাথাব্যথা হতে পারে। ঝড়ে বাতাসের যে চাপের পরিবর্তন হয় তাতে মাইগ্রেন বা অন্য কোনো মাথাব্যথা শুরু হতে পারে।
৬.    মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়া কী?
    ওই চাপ সাহায্যকারী না খারাপ?
শরীর ও মন যখন খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তখনই অবচেতনভাবে চাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এটা সাহায্যকারী হতে পারে বা খারাপ হতে পারে। উদাহরণ-চাপের একটি প্রতিক্রিয়ায় মাংসপেশিগুলো শক্ত হয়ে যাওয়া। ধরুন এক জায়গায় হাড় ভেঙে গেল, শরীর ওই ভাঙা জায়গার মাংসপেশিগুলো অবচেতনভাবেই শক্ত করে ফেলে, যাতে করে আর না ভাঙে। কিছু আবেগজনিত প্রক্রিয়ায় টেনশনের সময়, অনেক ব্যক্তি দাঁতে দাঁত লাগিয়ে থাকেন। ওই কারণে মাথাব্যথা শুরু হতে পারে। এর পর যখন আপনি টেনশনে পড়বেন তখন আপনার ছবি দেখুন। যদি দেখেন ঘাড়ের পেশি শক্ত হয়ে গেছে, দাঁতে দাঁতে লেগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে বা দেখতে রাগী রাগী লাগছে তাহলে বুঝতে হবে আপনার মাথাব্যথা হয় ক্রোধ ও রাগের জন্য।
৭.    যে সমস্যায় আমার বন্ধুরা টেনশনে ভোগেন না, অথচ আমি টেনশনে পড়ি ও মাথাব্যথা শুরু হয়। কেন?
কিছু কিছু ব্যক্তি আছেন-যাদের রাগ ও টেনশনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। আপনি যাতে মানসিক চাপ বেশি সহ্য করতে পারেন তার কতগুলো পদ্ধতি আছে। আপনি সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন। হালকা ব্যায়াম করুন, পরিমিত ঘুমান এবং আপনার ওজন সীমাবদ্ধ রাখুন। সিগারেট ও মদ খাবার মতো বাজে অভ্যাসগুলো ত্যাগ করুন। আপনার আবেগগুলো প্রকাশ করার জন্য মনের কথা কাউকে খুলে বলুন। দিনের কিছু সময় নীরব জায়গায় কাটানোর চেষ্টা করুন। দেখবেন পরিস্থিতি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে।
৮.    আমি রাতে ৫-৬ ঘণ্টা ঘুমাই এবং ভালো আছি। আমি শুনি ৮ ঘণ্টা ঘুম নাকি শরীরের জন্য প্রয়োজন?
রাতে কতক্ষণ ঘুমাবেন তা এক ব্যক্তি থেকে আর ব্যক্তিতে কমবেশি হয়। সুখনিদ্রা ৩ ঘণ্টা থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। নির্ভর করে আপনার শরীর কী চায়। কেউ কেউ ৩-৪ ঘণ্টা ঘুমিয়ে ভালো থাকেন। কতটুকু ঘুমানোর প্রয়োজন তা বের করতে বন্ধের সময় পরপর তিন দিনের পর্যাপ্ত ঘুমকে গড় করে বের করুন। তাই হবে নির্দিষ্ট মাত্রা।
৯.    আমার স্বামী ধূমপান করেন আর মাথাব্যথায় ভোগেন। দুটিতে কোনো সম্পর্ক আছে কি?
হ্যাঁ, সম্পর্ক আছে। সিগারেট ও মাথাব্যথার মধ্যে সম্পর্ক আজ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। সিগারেটে নিকোটিনের পরিমাণ যত বেশি হয় মাথাব্যথার মাত্রা তত বেশি হবে। আপনার স্বামীর মাথাব্যথার কারণ ধূমপান। ধূমপান ছেড়ে দিলে মাথাব্যথা কমে যাবে। তবুও সাইকোলজিক্যাল কোনো কারণ আছে কি না তা নির্ণয় করার জন্য মনোচিকিৎসকের সাহায্য নেবেন।
১০. আমার ১২ বছরের ছেলেটি মাথাব্যথায় ভোগে। ওদের মানসিক চাপের জন্য মাথাব্যথা হয় কি?
সাধারণভাবে শতকরা ৭০ জন মেয়ে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে মাথাব্যথায় ভোগে। মানসিক চাপ এদের প্রধান কারণ। কৈশোরকালে বন্ধু-বান্ধবের সাথে মানসিক চাপ, শরীর পরিবর্তনের মানসিক চাপ, পিতা-মাতার সাথে মানসিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি মাথাব্যথা শুরু হতে সাহায্য করে। কৈশোর বয়সে খাবারের অভ্যাসের ঠিক না থাকা, ঘুমের অভ্যাসের ঠিক না থাকা মাথাব্যথা বাড়িয়ে দেয়। মেয়েদের মধ্যে মাসিক শুরু হওয়ার সময়টিতে মাথাব্যথা হতে পারে। বাচ্চাদের এ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ওদের খেলাধুলায় উৎসাহ দিন, শ্লথন প্রক্রিয়া শিখিয়ে দিন, আদর দিন।
১১.    কিছু কিছু লোকের টেনশন কেটে গেলে মাথাব্যথা হয় কেন?
জীবনের প্রতি মুহূর্তে আমরা টেনশনের মুখোমুখি হই। চাকরি, বয়স, ফ্যামিলি, অর্থ, সেক্স, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইত্যাদি কারণে স্ট্রেস হতে পারে। মানসিক চাপ চলে গেলে রিলাক্সড লাগে। কিন্তু কিছু কিছু ব্যক্তির ওই রিলাক্সড সময়ে মাথাব্যথা হয়। তাদের মাথাব্যথা কিন্তু সাইকোলজিক্যাল কারণে হয় না। হয় শারীরিক কারণে। কারণ যখন তিনি টেনশনে থাকেন তখন তার রক্তনালিগুলো চাপা থাকে। টেনশন চলে গেলে রক্তনালিগুলো ঢিলা হয়ে যায়। তখন মাথাব্যথা হয়। এ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য দরকার স্ট্রেসের পরিমাণ কমানো এবং বিশ্রাম সময়ে কাজে ব্যস্ত থাকা।
১২. ক্যাফিন খেলে কি মাথাব্যথা কমে যায়?
হ্যাঁ, ক্যাফিন বিভিন্ন ওষুধের সমন্বয়ে মাথাব্যথা নিরাময়ে ভালো ওষুধ হিসেবে কাজ করে। তবে ক্যাফিনের সবচেয়ে বড় অসুবিধা যে এটি নির্ভরশীলতা বা মাদকাসক্তির সৃষ্টি করে। আমাদের যুবসমাজ আজ ফেনসিডিল নামক কফ সিরাপে মাদকাসক্ত। উল্লেখ্য যে, ওই ফেনসিডিলে ক্যাফিন নামক পদার্থটি আছে এবং ওই পদার্থের জন্যই তাদের মাদকাসক্তি ঘটে থাকে।
১৩.    মাথাব্যথা হলে কখন
    ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন?
প্রতিবার মাথাব্যথায় ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। শতকরা ৯০ ভাগ মাথাব্যথা মারাত্মক কোনো ব্যাপার নয়। সাধারণ ওটিসি ওষুধ প্যারাসিটাল খেলেই তা চলে যায়। যদি তাতেও না কমে একটু বিশ্রাম, ঠান্ডা বরফ, শিথিলায়ন প্রক্রিয়ায় তা কমে যাবে। কিন্তু কিছু কিছু উপসর্গ আছে যখন মাথাব্যথা সিরিয়াস রোগ মনে হবে তখনই ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার।
যখন মাথাব্যথা আপনার জীবনের গুণগত মানকে কমিয়ে দেবে বা ফ্যামিলির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে বাধা দেবে, আপনার কাজের ক্ষমতা বা পড়ার ক্ষমতা কমিয়ে দেবে বা জীবনকে অনুভব করতে বাধা দেবে। সাধারণভাবে মাথাব্যথার ওষুধ, কিছু রিলাক্সেশন প্রক্রিয়া মাথাব্যথার মাত্রা কমিয়ে দেবে। কিন্তু একেবারে সারিয়ে তুলবে না, তখনই ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন।
নিচের যে কোনো একটি উপসর্গ থাকলে মাথাব্যথার জন্য ডাক্তারের সাথে দেখা করুন
  • যদি মাথাব্যথা সপ্তাহে তিনবারের বেশি হয়।
  • ব্যথা যদি হঠাৎ করে ওঠে, বেশি মাত্রায় উঠে, বিশেষ করে ব্যথা হওয়ার আগে আপনি যখন স্বাভাবিক ছিলেন।
  • যদি সবচেয়ে খারাপ মাথাব্যথা মনে হয়।
  • ঘাড় বা মাথায় আঘাতের পর মাথাব্যথা হলে।
  • পঞ্চাশ বছর বয়সের পরে মাথাব্যথা হলে।
  • মাথাব্যথার পাশাপাশি চোখে ঝাপসা দেখা, কথা জড়িয়ে যাওয়া, অসাড়তা, শরীরের যে কোনো জায়গায় বা হাত-পায়ে দুর্বলতা অনুভব করলে।
  • মাথাব্যথার সাথে ‘ঘোর লাগা’ বা ঘুম ঘুম লাগলে।
  • মাথাব্যথার সাথে যদি জ্বর, বমি বমি ভাব, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, বমি অথবা নাক-কান-গলা, চোখে নানা প্রকার উপসর্গ দেখা দিলে।
  • মাথাব্যথা যদি ব্যায়াম, কাশি, হাঁচি বা শরীর বাঁকা করলে হয়।
১৪.    টোটকা ওষুধে কোনো উন্নতি না হলে
    ডাক্তার দেখাব কি?
যখন সাধারণ টোটকা ওষুধে কোনো উন্নতি হচ্ছে না তখন ডাক্তার দেখানোই ভালো। তবে-
(ক)    সাধারণ মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত ওষুধ খেয়ে মাথাব্যথা দমানো গেলে ডাক্তার দেখাতে হবে।
(খ)    আপনার মাইগ্রেন মাথাব্যথা থাকতে পারে। সাধারণ ওষুধের পাশাপাশি ডাক্তারের ওষুধ নেয়ার প্রয়োজন পড়বে তখন। তা ছাড়া শক্ত ধরনের মাথাব্যথায় বিভিন্ন শারীরিক বড় অসুখ থাকতে পারে।
(গ)    আবেগজনিত সমস্যা, রাগ, ক্রোধ এসব কারণেও মাথাব্যথা হতে পারে, তার জন্য দরকার মনোচিকিৎসা।
১৫.    মাথাব্যথায় কাজের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়?
    পূর্বে এর চিকিৎসা ছিল কি?
প্রতি ৭ জনে ১ জন ব্যক্তির মাথাব্যথার কারণে প্রতিদিনকার কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে। এ তো গেল বাংলাদেশের কথা। ১৫ কোটি লোকের এদেশে কাজের ক্ষতির পরিমাণ সহজেই বের করা যায়। তবে আমাদের মহিলা সমাজ যে ধরনের কাজ করেন পুরুষশাসিত এ সমাজে তার কোনো হিসাব ধরা হয় না।
একটা সময় ছিল যখন ধারণা করা হতো মাথাব্যথা একটি দুষ্টশক্তি বা মাথায় খারাপ তরল পদার্থ জমলে হয়, এ জন্য মাথায় ফুটো করে পূর্বে মাথাব্যথার চিকিৎসা করা হতো। পরবর্তী ১০ হাজার বছরে চিকিৎসার অনেক উন্নতি হয়েছে।
১৬.    মাথাব্যথার জন্য কী কী জিনিস
    জানা জরুরি?
মাথাব্যথার জন্য কতগুলো জিনিস নোটবুকে টুকে রাখুন। যেমন-
  • কী ধরনের মাথাব্যথা হয়।
  • কী কী কারণে মাথাব্যথা হয়।
  • ব্যথা কম হওয়া বা বন্ধ করার জন্য আপনি কী কী পদক্ষেপ নেন।
  • সাধারণ ওষুধে কতটা মাথাব্যথা কমে।
  • মাথাব্যথার জন্য একটি ডাইরি বুক রাখবেন।
১৭. মাইগ্রেন মাথাব্যথা কাকে বলে?
এটি এক ধরনের মাথাব্যথা। ১০% লোক এই রোগে ভোগেন। সাধারণ বয়স ২৫-৫৫ বছর। মেয়েদের বেলায় দুই গুণ বেশি হয়। অকারণে এই ব্যথা হয়। বারবার এই ব্যথা হয়, ৪-৭২ ঘণ্টা স্থায়ী থাকে। মাথার এক দিকে ব্যথা হয়। মনে হয় রগগুলো দাপাচ্ছে। মধ্য মাত্রা থেকে বেশি মাত্রায় এ ব্যথা হয়। স্বাভাবিক কাজকর্ম করার জন্য এই ব্যথা হতে পারে। ব্যথা হওয়ার সাথে বমি বমি ভাব হয়, উজ্জ্বল আলো সহ্য হয় না, শব্দ অসহ্য লাগে। চোখের সামনে ঝাপসা আলো দেখা যায় বা রঙিন দৃশ্য দেখা যায়।
১৮. টেনশন মাথাব্যথা কাকে বলে?
মাঝে মাঝে হয় বা দীর্ঘমেয়াদিভাবে থাকতে পারে। শতকরা ৭৪ জন লোকের এই মাথাব্যথা থাকতে পারে। মাসে কমপক্ষে ১ বার এ ব্যথা হয়। মেয়েদের পুরুষের চেয়ে ১-৫ গুণ বেশি হয়।
বারবার মাথাব্যথা কয়েক মিনিট থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। মাথায় চাপ চাপ লাগে বা চাপ দিয়ে রাখছে বলে মনে হয়। মাথায় দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে মনে হয়। মৃদু মাত্রা থেকে মাঝারি মাত্রায় ব্যথা হয়। বমি বমি কোনো ভাব থাকে না বা বমি হয় না। চোখে আলোর ঝলকানি থাকে না।
১৯.    মানসিক চাপ ও মাথাব্যথার একটি সম্পর্ক আছে। কী করে মানসিক চাপ কমাবেন?
মানসিক চাপ সাধারণত কয়েকটি কারণে হয়। যেমন-অর্থনৈতিক কারণ, চাকরি বা কর্মজনিত কারণ এবং পারিপার্শ্বিক কারণ। আমরা এখানে অর্থনৈতিক মানসিক চাপ ও চাকরিজনিত মানসিক চাপের কথা আলোচনা করছি।
একশ লোককে জিজ্ঞেস করুন তাদের মানসিক চাপের কারণ। এক বাক্যে সবাই অর্থনৈতিক চাপের কথা বলবেন। আশ্চর্যের কিছুই না। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, চাকরির অনিশ্চয়তা বাড়ছে, জীবনযাত্রার মান ও খরচ বেড়ে যাচ্ছে ইত্যাদি অর্থনৈতিক মানসিক চাপের কারণ। অর্থনৈতিক মানসিক চাপের কিছু সত্য তুলে ধরা হলো-আপনার ভালো লাগবে।
  • যে কোনো ইনকাম-গ্রুপের লোকদের এটি হয়। ইনকাম-গ্রুপ মানে কম, মাঝারি, বেশি মাসিক আয়ের উপরে নির্ধারণ করা হয়।
  • অর্থনৈতিক মানসিক চাপ-সবার জন্য একরকম নয়।
  • পরিবারের মধ্যে অর্থ-মানসিক চাপের কারণ আপনার যা আছে তা কীভাবে খরচ করবেন তার উপরে হয়। আপনার কত কম আছে বা কত বেশি আছে তার উপরে নয়।
  • স্থায়ী একটা আয়-আর্থসামাজিক চাপ কমায়।
  • চাকরির অনিশ্চয়তা আপনার ফিন্যান্সিয়াল স্ট্রেস বাড়ায়।
  • অনেকে বলেন টাকা-পয়সা না থাকলেই কোনো টেনশন থাকবে না। কথাটা ঠিক নয়। টেনশন আপনা-আপনি চলে যাবে তা কিন্তু নয়। ধরা যাক আপনি দ্বিতীয় একটা কাজ নিলেন ইনকাম বাড়ানোর জন্য, তাতেও পরিবারের সদস্যদের জীবনের মান বেড়ে যাবে-আপনার স্বাস্থ্যের যত অকল্যাণ হোক না কেন।
  • জাতিগতভাবে আমরা মনে করি যার বেশি আছে সেই ভালো। কিন্তু এ কারণে অর্থ-মানসিক থেকে সৃষ্টি হয় মাথাব্যথার।
২০.    আর্থসামাজিক চাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী?
  • আপনার যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করুন। ভবিষ্যতের কথা ভেবে কিছু সঞ্চয় করুন। রিস্ক কাজ নেয়া বা ইনভেস্টমেন্ট থেকে দূরে থাকুন। মোটামুটি রক্ষণশীল জীবনযাত্রায় সন্তুষ্ট থাকুন।
  • অর্থ-মানসিক চাপ মোকাবিলার দুটো পথ আছে। একটি হয় আপনার নির্দিষ্ট ইনকামের মধ্যে আপনার জীবনযাত্রা নিয়ে আসুন। অথবা আপনার ইনকাম বাড়ান। যেটাই গ্রহণ করুন না কেন এ ব্যাপারে পারস্পরিক যোগাযোগ বা পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলুন। বোঝার চেষ্টা করুন অতিরিক্ত আর যথেষ্ট এর মাঝের ফারাক।
  • সমঝোতার যে কথা বলা হচ্ছে তার মানে এই নয় যে, আপনি যেমন আছেন তেমন থাকুন। আসলে ততটাই ইনকামের চেষ্টা করুন যাতে করে আপনি আরামে থাকতে পারেন। আবার সব ইনকাম টাকা-পয়সায় বিচার করবেন না। এছাড়া সন্তানদের ভালোভাবে মানুষ করাও এক ধরনের ইনকাম। টাকাই ইনকাম, এই অনুভূতি বদলান।
২১. কাজ ও মাথাব্যথার সম্পর্ক কী?
কাজের জায়গায় বিভিন্ন কারণে আমাদের মানসিক চাপ হয়- এই মানসিক চাপ মাথাব্যথার সৃষ্টি করে।
মানসিক চাপ-শুধু মাথাব্যথার কারণেই নয়-অনেক মানসিক অসুখের কারণও বটে। প্রতি ১০ জন লোকের মধ্যে ৯ জন কাজজনিত স্ট্রেস তথা মাথাব্যথায় ভোগেন।
২২. ব্যায়ামজনিত মাথাব্যথা কী?
কিছু কিছু শক্ত ধরনের ব্যায়াম থেকে মাথাব্যথা হতে পারে। যেমন ওয়েটলিফটিং, জগিং আরো বিভিন্ন রকম ব্যায়াম-এমনকি সঙ্গম করা পর্যন্ত। হাঁচি, কাশি, দম বন্ধ করে চাপ দেয়া, পায়খানায় বসে চাপ দেয়া, বাঁকা হওয়া এসব থেকেও মাথাব্যথা হতে পারে। এসবে আমাদের শরীরের রক্তনালিগুলো ঢিলা হয়ে যায় বিধায় প্রেসার বেড়ে গেলে মাথাব্যথা হয়। মাথা, মাথার উপরে, ঘাড়ে, গলায় ইত্যাদি জায়গায় চাপ বেড়ে গেলে ব্যথা বাড়ে। সাধারণত কয়েক মিনিট থেকে ১-২ ঘণ্টায় ব্যথা চলে যায়। একটু বরফ দিলে বা একটু বিশ্রাম নিলে মাথাব্যথা কমে যাবে। যদি দেখা যায়-যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্রাম নেয়ার পরে মাথাব্যথা কমছে বা প্রতিবার ব্যায়ামেই তা হচ্ছে তাহলে শারীরিক চেকআপ করতে হবে। মনে রাখতে হবে ব্যায়ামজনিত মাথাব্যথার ১০% কারণ শারীরিক-যেমন ব্রেন টিউমার, অ্যানিউরিসম ইত্যাদি।
২৩. ওষুধ ছাড়া কী করে মাথাব্যথা সারাবেন?
কিছু সাজেশন দেয়া হলো যাতে ওষুধ ছাড়াও মাথাব্যথা কমানো যাবে।
  • শিথিলায়ন বা দীর্ঘ শ্বাস নেয়ার টেকনিক, সুস্থ শিথিল জিনিস চোখে দৃশ্য হিসেবে আনা, কগনিটিভ থেরাপি, আকুপাংচার, মানসিক চাপ কমানোর বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন ও ম্যাসাজ।
  • বরফ ঢেলা চিকিৎসা। বরফ একটি কাপড়ের পুঁটুলি বানিয়ে মাথায় চাপ দেয়া। মাথাব্যথার যত প্রথম ভাগে এই কাজ করা তত কম মাথাব্যথা হবে। সাধারণত ব্যথার জায়গাগুলোতে চেপে ধরুন। তাছাড়া ঘাড়ের পেছনে, কপালে, চোয়ালে, মাথার দুই পাশে দিতে হবে।
  • গরম ভাব অনেক সময় শিথিলায়ন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। গরম পানিতে গোসল করলে শরীরের বিভিন্ন অংশ রিলাক্স হয় ও মাথাব্যথা তাতে কমে যায়। অন্ধকার ঘরে বিশ্রাম নিন। পারলে ১৫-২০ মিনিট সময় ঘুমিয়ে নিন। আপনার মাথাব্যথা কমতে তা সাহায্য করবে।
  • বায়োফিডব্যাক চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
  • আকুপাংচার প্রক্রিয়ায় ব্যথার বিরুদ্ধে শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাড়াতে সাহায্য করবে।
  • কগনিটিভ থেরাপির মাধ্যমে ব্যথার বিরুদ্ধে মনের শক্তি বাড়ানো যায়।
২৪. শিশুদের মাথাব্যথা হলে করণীয়?
৬ বছরের নিচে শতকরা ৪০ জন শিশু ও ১৫ বছরের নিচে শতকরা ৭০ জন মাথাব্যথার কথা বলে। বাচ্চার মাথাব্যথায় সংসারে অশান্তির সৃষ্টি করে। আক্রান্ত শিশুর অন্যান্য ভাই-বোন, শিশুটিকে যত্ন বেশি নেয়া হচ্ছে ভেবে হিংসায় ভোগে। সব মিলে একটা বিরাট ব্যাপার হয়, যার বেশির ভাগ যায় বাবা-মায়ের ওপর দিয়ে। শিশুদের মাথাব্যথায় কতকগুলো সাধারণ তথ্য আমাদের জানা প্রয়োজন-
  • শতকরা ৯৫ ভাগ মাথাব্যথা সামান্য ধরনের।
  • টেনশনে মাথাব্যথা বেশি হয়।
  • যদি বংশে মাইগ্রেন মাথাব্যথা থাকে তাহলে বাচ্চার তাই হয়েছে বলে মনে হয়।
অধিকাংশের মাথাব্যথা বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমে যায়। তবে ৩৩% শিশুর মাথাব্যথা পরবর্তীকালে হতে পারে। তাদের বেশির ভাগই মাইগ্রেন মাথাব্যথার শিকার। টেনশন মাথাব্যথা ছোটদের-বড়দের এক রকম হয়। মাথার সামনে, পেছনে ও ঘাড়ে ব্যথা করে। বিশ্রাম, সহানুভূতি, সামান্য টোটকা ওষুধে ব্যথা নিরাময় হয়। যেসব বাচ্চা বেশি মানসিক চাপের মধ্যে থাকে তাদের মাথাব্যথা বেশি হয়। মাইগ্রেন মাথাব্যথা শিশু ও বড়দের একটু আলাদা হয়। শিশুদের ব্যথা বমি বমি ভাব ছাড়াও পেটে ব্যথা, জ্বর, অস্থিরতা, নাক বন্ধ ভাব, দ্রুত হার্টবিট ইত্যাদি হতে পারে। বাচ্চাদের ব্যথা একটু ঘন ঘন হয়। মাত্র ৩০ মিনিট থাকে। ব্যথা হওয়ার পূর্বে কিছু কিছু বাচ্চা অত্যধিক হাই তোলে, ঘুম ঘুম ভাব হয়, অনেক সময় চিনিজাতীয় খাদ্য, চকোলেট, হটডগ, কলা ইত্যাদি খেতে পছন্দ করে।
২৫. কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন?
নিচে টিক দিন। যদি কোনো একটি টিক পড়ে তাহলে আজই ডাক্তারের সাথে দেখা করুন।
  • মাথাব্যথা দিন দিন বাড়ে।
  • সপ্তাহে তিন বার বা ততোধিক ব্যথা হয়।
  • প্রতিদিনই মাথাব্যথার ওষুধ খেতে হয়।
নিচের কোনো একটি উপসর্গ থাকলে-
  • ঘাড় শক্ত অথবা/ জ্বর
  • দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস
  • অপরিচিত উপসর্গ যা নাক, কান, ঘাড়, গলা কিংবা চোখে হয়।
  • কথা বলতে অসুবিধা, শরীরের যে কোনো অংশ বিশেষ করে হাত ও পায়ে দুর্বলতা, অবশ অবশ ভাব, মাথা খালি খালি ভাব।
  • বমি
  • যদি মাথাব্যথা মাথায় আঘাতের পরে হয়, ব্যায়ামের পরে হয়, কাঁশি, হাঁচি বা যৌনসঙ্গমের পরে হয়।
  • পঞ্চাশ বছর বয়সের পরে হয়।
যদি কোনো একটি উত্তরে টিক পড়ে তাহলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে দেখা করুন
২৬. কী তথ্য ডাক্তারের জন্য প্রয়োজন?
দেখা করার সময় নিচের তথ্যগুলো নোট করে নিয়ে যান। আপনার রোগ সন্ধানে সাহায্য করবে।
  • কী করে মাথাব্যথা শুরু হয়?
  • মাথার ঠিক কোন জায়গায় ব্যথা হয়?
  • এছাড়া আর কোনো ব্যথা আছে কি? যেমন-ঘাড়ে
  • আপনি কতদিন থেকে ভুগছেন
  • ব্যথাটা কত ঘন ঘন হয়?
  • কতক্ষণ আপনার ব্যথা থাকে?
  • ব্যথাটি কি বিশেষ কোনো ছক অনুসরণ করে (যেমন সময়, ক্লান্তি, কাজ)
  • অন্য কোনো উপসর্গ ওই একই সময়ে থাকে কি বা তার পূর্বে থাকে কি?
মাথাব্যথার কী চিকিৎসা করেছেন?
ব্যথাটি কী ধরনের হয়ে থাকে (চাকু মারার মতো, ভোঁতা, দাপানো)
ব্যথাটি ওই একই জায়গায় থাকে? না জায়গা পরিবর্তন করলে বাড়ে? মাথায় চাপ পড়লে ব্যথা কি বাড়ে? ( যেমন কাশি, হাঁচি, শরীর বাঁকা করলে বা যৌনসঙ্গম করলে) উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর নোট করে নিন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আপনাকে তা জিজ্ঞেস করবেন।
২৭.    মাথাব্যথা সম্বন্ধীয় ডাইরি বা নোটবুক কীভাবে রাখতে হয়?
  • তারিখ
  • পূর্বাভাস
  • কখন শুরু হয়
  • কখন শেষ হয়
  • কী ধরনের ব্যথা
  • ব্যথার মাত্রা কেমন
  • কোন জায়গায় হয়
  • কী ওষুধ খেয়েছেন
  • তার ফলাফল কী
  • ঘুম হয় কত ঘণ্টা
  • কী কী আজ খেলাম
  • ব্যথার পূর্বে কী কী কাজ করেছি
মন্তব্য
২৮. কী কারণে আপনার মাথাব্যথা হয়?
বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করেছেন মাথাব্যথার কারণ সন্ধানে। আজতক যে কারণে মাথাব্যথা হয় তার হিসেবে মগজে জৈব রাসায়নিক পরিবর্তন। কিন্তু সবাই একমত যে কিছু কারণ ওই পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে। ওই কারণগুলো খুঁজে পেলে মাথাব্যথা হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কারণ অনুসন্ধানের জন্য নিচে একটি লিস্ট দেয়া হলো-
  • কারণ
  • অতিরিক্ত মানসিক চাপ
  • অনেক কাজের চাপ
  • আবেগজনিত কারণ ডিপ্রেশন, টেনশন, হতাশা, এমনকি সুখকর অভিজ্ঞতা
  • শক্ত চোয়াল
  • খারাপভাবে বসে থাকা
  • খাদ্য
  • মদ/মদজাতীয় পানীয়
  • গন্ধ
  • হরমোনের কারণ (যেমন মাসিক হওয়া, আবহাওয়ার পরিবর্তন)
ওই ছকে টিক দিন এবং কারণগুলো জেনে নিন এবং যথাসম্ভব ওই কারণগুলো থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করুন।
২৯. কী কী খাদ্যে মাথাব্যথা হয়?
যে যে খাদ্যে মাথাব্যথা হয়- মদ বা মদজাতীয় পানীয়, চকোলেট, চিজ, ঝাল খাদ্য, বিভিন্ন নাটস, কলা, টক ফল, চা, কপি এবং কোলা।
৩০. কী কী মানসিক সমস্যায় মাথাব্যথা হয়?
স্নায়বিক অসুখ যেমন-টেনশন, অহেতুক ভীতি, অবসেশন ইত্যাদি, মাদকাসক্তি, ডিপ্রেশন, ম্যানিয়া, অর্গানিক ব্রেন সিনড্রোম ইত্যাদি মানসিক সমস্যায় মাথাব্যথা হতে পারে। এই সমস্ত অসুখে যে মাথাব্যথা হয় তা মূল অসুখের চিকিৎসায় আপনাআপনি কমে যায়। অবশ্যই মনোচিকিৎসক দ্বারা এর চিকিৎসা করাতে হবে।
৩১. রিবাউন্ড মাথাব্যথা কাকে বলে?
মাথাব্যথার জন্য কিছু প্রচলিত ওষুধ আছে যা খেলে মাথাব্যথা কমে কিন্তু ওই ওষুধ বেশি পরিমাণে খেলে মাথাব্যথা কমার পরিবর্তে বেড়ে যায়। একে রিবাউন্ড মাথাব্যথা বলে। মাথাব্যথার রোগীরা প্রতিদিন অ্যানালজেসিক জাতীয় ওষুধ খান। এমনও হয়, অনেক সময় দিনে ৪ বার ওষুধ সেবন করেন। ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে ওষুধ তার কার্যকারিতা হারায় বা কমতে থাকে। ফলে মাথাব্যথা কমাতে তারা বেশি পরিমাণে ওষুধ খান। কতকটা দুষ্টচক্রের মতো। অনেক ব্যক্তি সকালে মাথাব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙে, রাতেও তারা মাথাব্যথা নিয়ে ঘুমাতে যান। রিবাউন্ড মাথাব্যথা-এ সাধারণত মাথাব্যথা কমার ৩-৪ ঘণ্টা পরে ফেরত আসে। সারাটা দিন থাকে। রিবাউন্ড হেডেকের সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হচ্ছে স্বাভাবিক মাথাব্যথার জন্য অতিরিক্ত অ্যানালজেসিক ওষুধ না খাওয়া। যদিও মাথাব্যথা তাতে একটু বেড়ে যাবে কিন্তু ম্যাজিকের মতো উন্নতি পাওয়া যাবে।
৩২. মাথাব্যথায় কি জেনেটিক বা বংশানুক্রমিক রীতি কাজ করে?
হ্যাঁ, যাদের বারবার মাথাব্যথা হয় তাদের ৮০% রোগীর মধ্যে পরিবারে মাথাব্যথার ইতিহাস আছে। যদিও অনেক মাথাব্যথার কারণ সাইকোলজিক্যাল কিন্তু মাইগ্রেন মাথাব্যথায়ও জৈব রাসায়নিক পরিবর্তন সাধিত হয়। বংশানুক্রমিকভাবে মাথাব্যথা থাকতে পারে।
৩৩.    ঘুম কীভাবে মাথাব্যথার ওপর ক্রিয়া করে?
অতিরিক্ত ঘুম কিংবা কম ঘুম-দুটোই মাথাব্যথা বাড়ায়। সেরোটনিন নামক জৈব রাসায়নিক পদার্থের পরিবর্তন ঘুমের মধ্যে হয়। যা কিনা মাথাব্যথা শুরু করতে বা বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। যে সময়টা সাধারণভাবে লোকে জেগে থাকে যেমন কাজের দিনে বিকেলে, সাধারণভাবে কোনো চাকরিজীবী ঘুমান না বা ঘুমানোর সময় পান না, তিনিই যদি বন্ধের দিন বিকেলে ঘুমান তাহলে কিন্তু তার মাথাব্যথা শুরু হবে। কী আশ্চর্য। আবার অনেকে আবিষ্কার করে ফেলেন সামান্য একটু ঘুম তার মাথাব্যথা তাড়াতে সাহায্য করে। কিশোর বয়সে বিকেলে একটু ঘুম মাথাব্যথা কমাতে সাহায্য করে। তেমনি যুবক বয়সে আবার বিকেলে ঘুম মাথাব্যথা বাড়াতে সাহায্য করে। আবার ঘন ঘন ন্যাপ বা অল্প ঘুম রাতে ভালো ঘুম হতে বাধা দেয় এবং ফলে সকালে মাথাব্যথা ওই জাতীয় সমস্যা। দিনে না ঘুমিয়ে ঘুমকে রাতের জন্য জমা রাখা ভালো।
সময়মতো ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠা মাথাব্যথা কমাতে বা সারাতে ভালো কাজ করে।
৩৪. ঘুমের পরীক্ষাগুলো কী কী?
ঘুমের পরীক্ষাগুলো ঘুমের সময় নানা প্রকার শারীরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মগজের কাজকর্মগুলো রেকর্ড করে। যেমন ইইজি, ইসিজি, পায়ের নড়াচড়া, চোখের নড়াচড়া ইত্যাদি। এছাড়া শারীরিক অনেক পরীক্ষা যেমন-ব্লাড কেমিস্ট্রি, এক্স-রে অব চেস্ট এবং স্টুল ইত্যাদি করা যেতে পারে।
৩৫.    মাথাব্যথার জন্য কী কী পরীক্ষা করা হয়?
সাধারণভাবে বেশির ভাগ মাথাব্যথা সৃষ্টি হয় মন-মানসিক কারণে। ১০০ জন লোকের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, শতকরা ৮০ ভাগ মাথাব্যথার কারণ সাইকোলজিক্যাল। বাকি ২০ ভাগের ১০ ভাগ শারীরিক কারণে ও বাকি ১০ ভাগ শারীরিক ও মানসিক কারণে। তাই বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিশেষ একটা প্রয়োজন নেই। তবে অন্যান্য কারণ নির্ণয় করার জন্য রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা, সিটি স্ক্যান অব ব্রেন, মাথার এক্স-রে ও অনেক সময় এমআরআই জাতীয় পরীক্ষার প্রয়োজন হয়।
৩৬.    সিগারেট খেলে মাথাব্যথা বাড়ে?
হ্যাঁ, বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সিগারেট খেলে মাথাব্যথা বাড়ে। কয়েক রকম পদ্ধতিতে তা হতে পারে-
(১)    ধূমপানে কার্বন মনোঅক্সাইডের পরিমাণ রক্তে বেড়ে যায়। ওই কার্বন মনোঅক্সাইড মগজে মাথাব্যথার সৃষ্টি করে।
(২)    মগজে অক্সিজেন কমে যায় এবং অনেক টিস্যুতে অক্সিজেন কমে যায় বলে মাথাব্যথা হয়।
(৩)    সিগারেটের প্রধান উপাদান নিকোটিন। নিকোটিনের একটি বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া আছে। বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ার জন্য মাথাব্যথা হয়। নিকোটিন আবার মাথাব্যথা কম রাখাজনিত ওষুধের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। মাথাব্যথা কমাতে হলে প্রথমে সিগারেট ছাড়ুন।
৩৭. যৌনতা বা যৌনসঙ্গমের সাথে মাথাব্যথার কোনো সম্পর্ক আছে কি?
অনেক ক্ষেত্রে, বলা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে যৌনসঙ্গমের পূর্বে ও কতক ক্ষেত্রে যৌনসঙ্গমের পরে অনেকের মাথাব্যথা হয় বলে শুনেছি। অনেক যুবক তাদের হস্তমৈথুনের পর মাথাব্যথার অভিযোগ করেন। সাধারণত এই জাতীয় মাথাব্যথা মহিলাদের মধ্যে বিশেষ করে ২০-৩০ বছর বয়সের মধ্যে বেশি পাওয়া যায়। তাৎক্ষণিক রক্তচাপ বৃদ্ধি, দ্রুত হার্টবিট, দ্রুত শ্বাসক্রিয়া এর কারণ হতে পারে। কিছু কিছু মহিলা, যারা যৌনতার ব্যাপারে শীতল বা অত্যন্ত রক্ষণশীল জীবনযাপন করেন তাদের ক্ষেত্রে যৌনসঙ্গমের পর মাথাব্যথার উপসর্গ থাকতে পারে।
৩৮.    বাচ্চাদের কত বয়সে মাইগ্রেন মাথাব্যথা হয়?
অনেক ছোট বয়সে মাইগ্রেন মাথাব্যথা বাচ্চাদের হতে পারে। এমনকি ১-২ বছর বয়সে। এমনকি তারও আগে।
পেটে ব্যথা অনেক বাচ্চার মাইগ্রেনের প্রথম উপসর্গ আকারে আসে। চলতে গেলে বমি বা অনেকের গাড়িতে চড়লে বমি হয়। একে বলে মোশন সিকনেস। এই জাতীয় মোশন সিকনেসে যে বাচ্চারা ভোগে তাদের অনেকেই মাইগ্রেন মাথাব্যথায় ভোগে।
৩৯.    ছেলে বা মেয়ে এভাবে কি মাথাব্যথার কম-বেশি হয়?
হ্যাঁ হয়। ৯-১২ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে-মেয়ে সমান সমান মাথাব্যথা হয়। ১২ বছরের পরে ২১-২৪ বছর পর্যন্ত মাথাব্যথার রোগীদের মধ্যে ৮০% মেয়ে। ইস্ট্রোজেন নামক হরমোন ওই বয়সে মেয়েদের শরীরে বেশি মাথায় আসে। ওই ইস্ট্রোজেন মাথাব্যথার প্রধান কারণ। তাছাড়া ইস্ট্রোজেন রক্তনালি, মাসিক, গর্ভাবস্থা ইত্যাদির উপরে প্রভাব বিস্তার করে। জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়িও মেয়েদের মেনোপজ মাথাব্যথার ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। সবগুলোই আবার মাথাব্যথার উপরে প্রভাব অর্থাৎ এগুলো মাথাব্যথা বাড়িয়ে দেয়।
৪০.    মাঝে মাঝে যে কিশোর বয়সে মাইগ্রেনে আক্রান্ত ছিল তার কি বড় বেলায় মাইগ্রেন হতে পারে?
হ্যাঁ পারে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যিনি একবার মাইগ্রেনে আক্রান্ত হন তার অসুখটি সারা জীবনব্যাপী চলতে পারে এবং যতই সময় যায় ততই খারাপভাবে আসতে পারে। মেয়েদের বেলায় এটি বেশি প্রযোজ্য। সাধারণত (ইস্ট্রোজেন) হরমোনের কারণে এটা হতে পারে।
৪১.    যেহেতু মাথাব্যথার সাথে ঘুমের একটা সম্পর্ক আছে-আমাদের সুন্দর স্বাস্থ্যসম্মত ঘুমের জন্য কী কী প্রয়োজন, তা বলবেন কী?
ভালো ঘুমের জন্য এগারোটি গাইড লাইনের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো-
(১)    ঘুম ততটুকুই হওয়া প্রয়োজন, যতটুকু হলে পরদিন সকালে ফ্রেস লাগে, ভালো লাগে, তার চেয়ে বেশি নয়। বিছানায় অযথা সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকলে হাল্কা হাল্কা ভাঙা ভাঙা ঘুম হয়, এটা ভালো না।
(২)    প্রতিদিন সকালে একটি বিশেষ সময়ে ওঠার নিয়ম পালন করতে হবে। তাতে শরীরের ‘ঘুম-জাগা-চক্র’টি ভালো থাকে।
(৩)    নিয়মিত একটা বিশেষ মাত্রায় ব্যায়াম সুস্থ স্বাভাবিক শরীরের জন্য উত্তম। ঘুমের জন্য তো বটেই।
(৪)    হঠাৎ উচ্চ শব্দ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, অনেকে জেগে যান কিন্তু মনে রাখতে পারেন না তা পরদিন। ভালো ঘুমের জন্য সাউন্ড প্রোটেকটেড রুম হলে ভালো হয়। বিশেষ করে যেখানে ওই ধরনের আওয়াজ পাওয়া যেতে পারে।
(৫)    অতি গরম রুম ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। তেমনি অতি ঠাণ্ডা রুমও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। এ জন্য প্রয়োজন দেশের আবহাওয়া নির্বিশেষে ‘না ঠাণ্ডা না গরম’ রুম।
(৬)    খালি পেটে ঘুমানো উচিত না, কারণ খালি পেটে ঘুম ভালো হয় না। সে রকমভাবে ভরা পেটেও ঘুম আসে না। সবচেয়ে ভালো হচ্ছে ঘুমানোর এক ঘণ্টা আগে হালকা খাবার খেয়ে নেয়া।
(৭)    দীর্ঘমেয়াদি ঘুমের সমস্যায় যারা ভোগেন, স্লিপিং পিল তাদের জন্য মাঝে মাঝে ভালো কাজ করে। কিন্তু যারা প্রায় দিনই স্লিপিং পিল খান তাদের জন্য ভালো কাজ করে না। বিকেলে কফি পান একেবারে মানা। কফি ঘুমের ডিস্টার্ব করে। অনেকে বলেন, তাদের ঘুমে কোনো ডিস্টার্ব হয় না, তাদের ক্ষেত্রেও ঘুমে অসুবিধা হয়, কিন্তু তারা বুঝতে পারেন না।
(৯)    অ্যালকোহল বা মদজাতীয় পানীয় ঘুম আনতে সাহায্য করে, কিন্তু ঘুমের প্রহর যত পার হতে থাকে অ্যালকোহল ঘুমের ততই  অসুবিধা সৃষ্টি করে। উপরন্তু সকালে উঠে মাথাব্যথা তো আছেই।
(১০)    যারা ঘুম আসছে না বলে রেগে যান বা হতাশা বোধ করেন, তারা ওই সময়টা বিছানায় শুয়ে না থেকে পাশের ঘরে গিয়ে পড়াশোনা করতে পারেন। পরে ঘুমঘুম ভাব এলে ঘুমাতে যাবেন।
(১১) ধূমপান ত্যাগ করুন। ধূমপানে ঘুমের অসুবিধা হয়।
৪২.    বাচ্চাদের মাইগ্রেনের কী ধরনের উপসর্গ থাকে-যা বড়দের থাকে না?
বাচ্চাদের মাইগ্রেনে আর বড়দের মাইগ্রেনে উপসর্গভিত্তিক কিছু তফাৎ আছে। মাথাব্যথা ছাড়াও বাচ্চারা, যারা মাইগ্রেনে ভোগে তাদের মধ্যে মাথায় হালকাভাব, পেটে ব্যথা, বেশি অল্প আলোতে বিরক্তি বিরক্তিবোধ, আবেগজনিত পরিবর্তন, জ্বর, নাক বন্ধ ভাব, অস্থিরতা ইত্যাদি থাকতেই পারে। জ্বর অনেক সময় ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। মাঝে মাঝে এই উপসর্গগুলো হয়, আবার অনেক ক্ষেত্রে মাথাব্যথা পর্যন্ত থাকে না। কিছু কিছু শিশু শেষে স্বাভাবিক মাইগ্রেনের শিকার হয়।
৪৩.    ক্লান্তি ও মাইগ্রেনের সাথে কোনো সম্পর্ক আছে কি?
ক্লান্তিবোধে অনেকে যারা ভোগেন তাদের অনেকের মন্তব্য-এর সাথে মাথাব্যথা করে। আসলে ক্লান্তির সাথে ব্রেনের পেইন সেন্টারগুলো উত্তেজিত হয়। তাতে মাথাব্যথার সৃষ্টি হয়। ক্লান্তির ব্যথা সারা শরীরে অনুভূত হয় এবং এর সাথে টেনশন, ঘুমের সমস্যা, ডিপ্রেশন ও মাথাব্যথা থাকে। মাইগ্রেন মাথাব্যথায়ও নানা প্রকার উপসর্গ এর সাথে থাকতে পারে। ক্লান্তিবোধের জন্য কিছু টোটকা ওষুধ সেবন করলে শরীর-মন চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
৪৪.    শরীরের ব্লাড সুগারের সাথে মাথাব্যথার কী সম্পর্ক?
আমাদের শরীরে নির্দিষ্ট একটা মাত্রায় ব্লাড সুগার থাকার কথা। যেমন ৮০-১২০ মিলিগ্রাম/মিলিলিটার খালি পেটে আর ভরা পেটে তা ১৮০ মিলিগ্রাম/মিলিলিটার। যদি কোনো কারণে শরীরের ব্লাড সুগারের মাত্রা কমে যায় তাহলে মাথাব্যথা বিশেষত মাইগ্রেন ধরনের মাথাব্যথার সৃষ্টি হতে পারে। যার আবার রক্তের মধ্যে সুগারের মেটাবলিক ডিসঅর্ডার আছে তাদের ক্ষেত্রে মাত্র ১ বেলার খাবার না খেলেই মাথাব্যথা শুরু হতে পারে। সুতরাং নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট মাত্রায় খাদ্য গ্রহণ করা জরুরি। লম্বা একটা ঘুম দিলে শরীরে ব্লাড সুগারের মাত্রা কমে গেলে মাথাব্যথা হতে পারে। সাধারণভাবে রাতে মাথাব্যথা হলে ব্লাড সুগারের মাত্রা কমে গেছে বলে ধারণা করা হয়। অবশ্য এর অন্যান্য কারণও থাকতে পারে।
৪৫. মাইগ্রেন মাথাব্যথার কোনো বিশেষ পরীক্ষা আছে কি?
না বিশেষ কোনো পরীক্ষা নেই, যাতে করে মাইগ্রেন রোগটি বোঝা যায়। এই রোগ বুঝতে হয় উপসর্গ মারফত। তবে বিশেষ অনেক পরীক্ষা আছে যাতে করে অন্য অসুখ আছে কি না পরীক্ষা করে নেয়া যায়। এতে করে ব্রেনের রক্তচলাচল, স্নায়ুর ও ব্রেনের অ্যানাটমি বোঝা যায়।
৪৬. আমার মাথাব্যথা সম্বন্ধীয় সব পরীক্ষা
    স্বাভাবিক। আমার মাথাব্যথার কারণ কী?
মাথাব্যথার পরিমাপ করার জন্য যে সব পরীক্ষা করা হয় বা মাথাব্যথার অন্য কোনো কারণ খুঁজে বের করতে যে সব পরীক্ষা করা হয় তার মধ্যে সিটি স্ক্যান অব ব্রেইন, এমআরআই এবং স্টাডিস অব ব্লাড কেমিস্ট্রি অন্যতম। মাইগ্রেন মাথাব্যথায় ওই সব টেস্টের ফলাফল নরমাল পাওয়া যায়। সাধারণভাবে মাইগ্রেনের জন্য বিশেষ কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা আজও আবিষকৃত হয়নি।
৪৭. ইস্ট্রোজেন জাতীয় হরমোন কি মাথাব্যথা
    বাড়ায়?
অবশ্যই বাড়ায়। ইস্ট্রোজেন হরমোন মাথায় বিশেষ এক ধরনের রিসেপ্টরের সাথে সংযুক্ত হয় এবং মাইগ্রেন বা অন্য জাতীয় মাথাব্যথা বৃদ্ধি করে।
সুতরাং ইস্ট্রোজেন হরমোনের কমবেশির জন্য মেয়েরা বেশি মাইগ্রেন রোগে ভোগে।
৪৮. মাথাব্যথার জন্য ওষুধ ছাড়া আর
    কী কী চিকিৎসা আছে?
মাথাব্যথার জন্য ওষুধই একমাত্র চিকিৎসা নয়। যারা টেনশনজনিত মাথাব্যথা ও মাঝে মাঝে মাইগ্রেনে ভোগেন তাদের আচরণমূলক চিকিৎসা বা বিহেভিয়ার পরিবর্তনমূলক চিকিৎসা ভালো কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে বিহেভিয়ার চিকিৎসার সাথে সাথে ওষুধের দ্বারা চিকিৎসা মাথাব্যথা নিয়ন্ত্রণে ভালো কাজ দেয়। বিহেভিয়ার থেরাপিগুলো হলো-বায়োফিডব্যাক, রিলাক্সেশন ট্রেনিং, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি যেমন-ব্যায়াম, ঘুম নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান ত্যাগ।
৪৯.    কী জাতীয় খাদ্য মাথাব্যথা বাড়া?
সাধারণত খাদ্যের জন্য মাথাব্যথা হয় এটি ঠিক নয়, তবে কিছু কিছু খাদ্য আছে যা মাথাব্যথার প্রকোপ বাড়িয়ে দেয় যেমন-সুগার, ক্যান্ডি, চকোলেট, কেক, চিজ, দুধ, আইসক্রিম, বিয়ার, মদ, কলা, আনারস, কমলা, অন্যান্য টকজাতীয় খাদ্য, পিঁয়াজ, বাদাম, মটরশুঁটি, গরুর গোশত, সালাদ, বিভিন্ন প্রকার ড্রিংকস, কফি, চা ইত্যাদি।
৫০.    মানসিক চাপ কীভাবে মাথাব্যথা বাড়ায়?
সোজাসুজি মানসিক চাপ বা স্ট্রেস মাথাব্যথা বাড়ায় না কিন্তু তৈরি করতে সাহায্য করে। মাথাব্যথায় যারা ভোগেন তারা সাধারণত বেশি মানসিক চাপযুক্ত জীবনযাপন করেন। স্ট্রেস আসবে। এটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, উচিতও নয়।  দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন এ ভাবধারা দুশ্চিন্তার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। মানসিক চাপের যেমন নেগেটিভ দিক আছে, তেমনি আছে ভালো দিকটা। ভালো দিক হচ্ছে এই মানসিক চাপ আপনাকে কিছু করতে বাধ্য করে এ রকমভাবে-
নিয়মিত ব্যায়াম, শিথিলায়ন, খাপ খাওয়া ইত্যাদি মানসিক চাপের খারাপ দিকগুলো সারিয়ে তোলে।
৫১.    কীভাবে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকবেন?
নিজেকে জিজ্ঞেস করুন। সবচেয়ে খারাপ ফলাফল আর কী হতে পারে? কী কী পরিবর্তন এই কাজটি না করলে হবে? আমি এই কাজের চাপ কমানোর জন্য আর কী করতে পারি? সমস্যাটা কী?
এই সমস্যার কারণ কী? সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য আমার কাছে আছে কি?

মাথাব্যথাঃ ৫১ পরামর্শ


সাধারণভাবে কোনটি সলিউশন হতে পারে? সর্বোত্তম সলিউশন কী? কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে প্রথমে সমস্যাটা লিখুন, কী কী  সমাধান হতে পারে লিখুন। ক্রমান্বয়ে নাম্বার দিন। ১, ২ ইত্যাদি। যে কোনো দুটি এক সাথে তুলনা করুন। সবচেয়ে ভালোটি টিক মার্ক দিন। যেমন ধরা যাক ১ সবচেয়ে ভালো। এবারে ১ কে ৩-এর সাথে তুলনা করুন। এভাবে সর্বোত্তম তুলনাসহ সমাধান বের করুন। বারবার একই জিনিস নিয়ে চিন্তা করবেন না।
কাজের চাপ কমানোর জন্য জরুরি, অতি জরুরি এভাবে কাজ ভাগ করুন এবং একটি কাজ একবারে করুন।
বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন সাপেক্ষে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস দূর করা বা কমানো যায়। অল্প পরিসরে এখানে ৫১টি বিষয়ে বলা হলো। সাধারণ মাথাব্যথা নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি উদ্যোগই যথেষ্ট। তবে সবচেয়ে ভালো হয় চিকিৎসকের পরামর্শমতো চললে।