মহিলাদের স্তন ক্যান্সার (ডা. শিমুল আখতার)

কোন মন্তব্য নেই

 

ক্যান্সারে আক্রান্ত মহিলাদের মধ্যে শতকরা প্রায় ১৭ ভাগ স্তন ক্যান্সারে ভুগছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৬০ হাজার মহিলা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত। অথচ একটু সচেতন হলেই প্রায় এক তৃতীয়াংশ স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ ও নিরাময় করা সম্ভব। ক্যান্সারের এই পরিসংখ্যান প্রকৃত অর্থে আরো ভয়াবহ। কারণ এই পরিসংখ্যানে জেলা পর্যায়ে নির্ণীত ক্যান্সার রোগী, যারা পরবর্তী চিকিৎসা গ্রহণের জন্য ঢাকায় আসেন না, কিংবা ক্যান্সার ধরা পড়ার পর রেডিও থেরাপি চিকিৎসার জন্য অন্যত্র যান এবং গ্রামপর্যায়ে অনেক লোক আছেন, যারা ক্যান্সারে ভুগছেন এদের কাউকে এই হিসেবে ধরা হয়নি।
ক্যান্সার কি, কেন হয়?
ক্যান্সার একটিমাত্র রোগ নয়। শরীরের বিভিন্ন প্রকৃতিতে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রকার উপসর্গ একইরকম রোগধারা ও মারাত্মক পরিণতি নিয়ে উপস্থিত হলে সৃষ্ট অবস্থাকে সমষ্ঠিগতভাবে ক্যান্সার নামে অভিহিত করা হয়।
ক্যান্সার সংক্রামক ব্যাধি নয়। এ রোগের পেছনে কোনো জীবাণুও দায়ী নয়। মানবদেহ অসংখ্য ক্ষুদ্র কোষ দ্বারা গঠিত। সুস্থ দেহে এ কোষগুলো নিয়মিত ও সুনিয়ন্ত্রিত কোষবিভাজন পদ্ধতির মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের বৃদ্ধি সাধন ও ক্ষয় করে।
হঠাৎ করে কোনো একটি কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন শুরু হয়ে তা বিরামহীনভাবে চলতে থাকলেই সে কোষের ক্যান্সার হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। সম্ভবত সেই একটিমাত্র কোষ থেকেই ক্যান্সারের উৎপত্তি। কোষের এই অনিয়ন্ত্রিত বিরামহীন বিভাজন থেকে অচিরেই সেখানে একটি পিন্ডের বা টিউমারের সৃষ্টি হয়। কিছু কিছু টিউমার আছে যেগুলো কোনো ক্ষতি করে না। এগুলোকে বলা হয় বেনাইন টিউমার। বেনাইন টিউমার কোনো ক্যান্সার নয়।
ক্ষতিকারক টিউমার আশপাশের লসিকা এবং রক্তপ্রবাহের পথ ধরে শরীরের দরবর্তী বিভিন্ন স্থানে নতুন বসতি স্থাপন করে। যথাসময়ে এর বিস্তৃতিতে বাধা না দিলে ক্যান্সারের পরিণাম হয় মৃত্যু।
ক্যান্সার সৃষ্টির এই প্রক্রিয়াটি যদিও অজ্ঞাত, কিন্তু্তু ক্যান্সারের কারণ হিসেবে স্বীকৃত প্রসঙ্গগুলো হচ্ছে-
১. ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান, বায়ু ও পানি দষণ, অত্যধিক চর্বিযুক্ত খাদ্য।
২. হরমোন। প্রজনন ও বিকৃত যৌন আচরণ।
৩. তেজস্তিক্রয়তা। সার্বক্ষণিক ঘর্ষণ, আঘাত
৪. পেশাগত ব্যাপার। অভ্যাস (ধমপান, মদ্যপান ইত্যাদি)
৫. বিভিন্ন বর্ণগত জীবনযাপন পদ্ধতি। ভৌগোলিক পরিবেশের প্রভাব।
৬. প্যারাসাইট ও ভাইরাস
স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কাদের বেশি?
১. যেসব মহিলার বয়স পঁয়ত্রিশ-এর ঊর্ধ্বে।
২. যারা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান না।
৩. ত্রিশ বছর পর প্রথম সন্তান লাভ কিংবা সিঃসন্তান হলে।
৪. কম বয়সে ঋতুবর্তী হলে অথবা দেরিতে ঋতুস্রাব বন্ধ হলে।
৫. স্তন ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে।
৬. অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করলে।
স্তন ক্যান্সার
ক্যান্সারের সেই অনিয়ন্ত্রিত ভয়াবহ কোষ বিভাজন পদ্ধতি স্তনের ভেতর দেখা দিলেই স্তন ক্যান্সারের সূত্রপাত ঘটে। স্তনের ক্যান্সার সাধারণত স্তনের নালীর ভেতর থেকে শুরু হয় এবং তা স্তনের মেয়াদযুক্ত অংশে ছড়িয়ে যায়। ক্যান্সারের কোষ লসিকা ও রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে শরীরের অন্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে এবং নতুন করে আরো ক্যান্সার সৃষ্টি করে। এভাবে তার সমস্ত শরীরকে ক্যান্সার আক্রান্ত করে তোলে।
স্তন ক্যান্সার যেভাবে শুরু হয়
স্তন ক্যান্সার প্রথমে স্তনে একটি চাকা বা পিন্ড নিয়ে আবির্ভত হয়। স্তনের এই চাকা অন্য কারণেও হয়ে থাকে। স্তনে ‘ফাইব্রোএডিনেমা’ নামে এক ধরনের টিউমার হলেও স্তনে চাকা বা পিন্ড দেখা যায়। এসব টিউমার ক্ষতিকারক নয়। এক সময়ে সেগুলো এমনিতেই চলে যায়। তবে ক্যান্সারের চাকা বা পিন্ডটি দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করে এবং তা ক্রমশ বড়ো হতে থাকে। এ সময়ে আক্রান্ত স্তনটি ভারী ভারী বোধ হবে। স্তনে ব্যথাও থাকতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় স্তনে এর বেশি কোনো কিছু বোঝা যায় না। ধীরে ধীরে ক্যান্সার স্তনের ত্বকে আক্রমণ শুরু করে। এ সময় স্তনের ত্বকে পরিবর্তন সচিত হয়। স্তনের ত্বকে কমলালেবুর মতো ছোট ছোট ফোঁটার মতো দাগ দেখা দেয়।
স্তনের বোঁটা ভেতরের দিকে ঢুকে যেতে থাকে। এ সময় বগলের নিচে ছোট ছোট বিচির মতো ফুলে ওঠে। সেই সঙ্গে ক্যান্সারের সাধারণ কিছু উপসর্গও দেখা দেয়।
এ সময় ক্যান্সার শরীরের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্ষুধামন্দা, শরীর শুকিয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্টসহ নানা শারীরিক অসুবিধা পরিলক্ষিত হতে থাকে। এরপর শেষ পর্যায়ে স্তন ফেটে ভয়ঙ্কর ঘা বা আলসার দেখা দেয়।
স্তন ক্যান্সারের সতর্কতা
অধিকাংশ স্তনের চাকা বা পিন্ড সাধারণত নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষাকালীন ধরা পড়ে। প্রতি মাসে মাসিক বন্ধ হওয়ার একদিন পর এবং ঋতু বন্ধ হওয়া মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রতি মাসে নির্ধারিত কোনো তারিখে নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করা উচিত।
গোসলের সময় আয়নার সামনে স্তন চেপে পরীক্ষা করতে হবে। দেখতে হবে কোথাও কোনো চাকা আছে কিনা, স্তনের আকৃতিতে পরিবর্তন, স্ফিতি কিংবা ত্বকে টোল পড়েছে কিনা।
স্তনবৃন্ত চেপে ধরে দেখতে হবে কোনো কিছুর ক্ষরণ বা স্রাব বের হয় কিনা। স্তনে কোনো চাকা কিংবা পরিবর্তন লক্ষ্য করলে অনতিবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, অধিকাংশ স্তনের চাকাই ক্যান্সার নয়, তবে চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
মেমোগ্রাফি ও স্তন ক্যান্সার শনাক্তকরণ
স্তনের মেমোগ্রাফি করে স্তনের ক্যান্সার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। মেমোগ্রাফি একটি সহজ স্তন ক্যান্সার শনাক্তকরণ পদ্ধতি। বাংলাদেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মেমোগ্রাফি করার ব্যবস্থা রয়েছে। স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ে ক্যান্সার কোষকে বায়োপসি করলে ক্যান্সারের চরিত্রগুলো ধরা পড়ে এবং ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়।
স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা
শল্য চিকিৎসা
প্রাথমিক অবস্থায় স্তনে সৃষ্ট চাকা কিংবা স্তন কেটে ফেলে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রত্যেক জেলা সদর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই ব্যবস্থা চালু আছে।
রেডিও থেরাপি
বিশেষ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিকিরণ রশ্মি, যা ক্যান্সার কোষ মেরে ফেলে। এই সুবিধা ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চালু থাকার কথা।
কেমোথেরাপি
ক্যান্সার বিধ্বংসী ওষুধ ব্যবহার। বেশ কয়েকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকরা নিজ উদ্যোগে এই ব্যবস্থা চালু রেখেছেন। রোগ ও রোগীর অবস্থাভেদে শল্যচিকিৎসা, রেডিও থেরাপি, কেমোথেরাপি এককভাবে অথবা একসঙ্গে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার ধরা পড়লে ক্যান্সার নিরাময়ের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল।
বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসা
বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসার যথেষ্ট অগ্রগতি হচ্ছে। ক্যান্সার নির্ণয় এখন আর এ দেশে কোনো ঘটনাই নয়। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য সরকারিজভাবে ঢাকার মহাখালীতে স্থাপিত হয়েছে ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও রিসার্চ হাসপাতাল। এই হাসপাতালে ক্যান্সারের শল্যচিকিৎসা ও কেমোথেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে। এ বছরের শেষ নাগাদ রেডিও থেরাপি চালু হওয়ার কথা। রেডিও থেরাপি চালু হলে ক্যান্সার চিকিৎসায় এটি একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হিসেবে গড়ে উঠবে। কেমোথেরাপির চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে অনেকেই এ চিকিৎসা গ্রহণে ব্যর্থ হন।
ক্যান্সারেও আশার আলো
ক্যান্সার মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। তারপরও ক্যান্সার নিরাময়ে আশার বাণী উচ্চারণ করছেন চিকিৎসকরা।
প্রাথমিক পর্যায়ে এক-তৃতীয়াংশ ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব, এক-তৃতীয়াংশ ক্যান্সার নিরাময় করা সম্ভব এবং অধিকাংশ অনিরাময়যোগ্য ক্যান্সারের ব্যথা উপশম করা সম্ভব।
ফেসবুকে আমি

 

next post @ সুস্বাস্থ্যের জন্য ঘুম

শেয়ার করে আপনার বন্ধুদেরকে জানান ।তাদের কে জানতে দিন অজানা বিষয় গুলি।প্রকাশক ও সম্পাদক ব্লগার_সৈয়দ রুবেললেখকজানার আছে অনেক কিছু

কোন মন্তব্য নেই :