নিঃসন্তান দম্পতিদের আধুনিক চিকিৎসা

কোন মন্তব্য নেই
অধ্যাপক ডা. এম এ বাসেদ
ইকসি বা ইন্ট্রসাইটোপ্লাজম স্পার্ম ইনজেকশন
নিঃসস্তান দম্পতিদের সর্বশেষ আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি হলো, ইকসি অর্থাৎ ইন্ট্রসাইটোপ্লাজম স্পার্ম ইনজেকশন। এ পদ্ধতিটি প্রধানত পুরুষ বন্ধ্যত্বের কারণে প্রয়োগ হয়। যেসব পুরুষের বীর্যে শুক্রকীটের পরিমাণ কম অথবা কীটগুলোর চলাফেরার ক্ষমতা কম অথবা নেই, সে ক্ষেত্রে ইকসি পদ্ধতির ভূমিকা অত্যন্ত বেশি। দেশে প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন সন্তানহীন দম্পতি রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এর ৬০ শতাংশ দম্পতি পুরুষের কারণে সন্তান জন্ম দিতে পারছে না। আমাদের দেশে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, সন্তান জন্ম দিতে না পারার একমাত্র কারণ স্ত্রী। ধারণাটি মোটেও ঠিক নয়। ইকসি নামক চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে এ ধরনের দম্পতির সন্তান জন্ম দেয়া সম্ভব। পদ্ধতিটি অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল। বিভিন্ন প্রকার পরীক্ষার মাধ্যমে মেনে নিতে হবে যে, স্ত্রীর সন্তান ধারণের কোনো প্রকার অসুবিধা আছে কি না। স্বামীর বীর্যের দোষ কতটুকু। সবকিছু পরীক্ষার পর ভ্রূণ বিশেষজ্ঞ সিদ্ধান্ত নেবেন চিকিৎসা পদ্ধতিটি।
ইকসি হলো একটি সুন্থ সবল শুক্রকীটকে ধরে এনে স্ত্রী ডিম্বের ভেতর অর্থাৎ সাইটোপ্লাজমের ভেতর সংস্থাপন করে দেয়া। এ জন্য চাই দক্ষ চিকিৎসক এবং অতি উন্নতমানের গবেষণাগার। শুধু মহিলাদের মাসিকের একটা নির্দিষ্ট সময়েই এ পদ্ধতিটি প্রয়োগ করা যায়। যে মাসে অর্থাৎ যে ঋতুটিতে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে সেই মাসিকের প্রথম দিনেই ভ্রূণ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। স্ত্রীকে মাসিকের প্রথম অথবা দ্বিতীয় দিন থেকে চিকিৎসক ওষুধ প্রয়োগ শুরু করবেন এবং প্রতিদিন ওষুধের কার্যকারিতার পর্যালোচনা করবেন, অর্থাৎ স্ত্রীর ডিম ফুটে আসতে শুরু করেছে কি না এবং শুরু হলে কটি ডিম ফুটে আসছে ইত্যাদি। বারবার শরীরের জরায়ুর মুখের জলীয় পদার্থ, তাপমাত্রা নির্ণয় এবং আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে এগুলো দেখে নিতে হবে, কখন ও কোন দিন ডিমগুলো পূর্ণতা লাভ করবে। ওই দিনটিতে ল্যাপারোস্কপি নামক এক যন্ত্রের সাহায্যে ডিমগুলো ডিম্বকোষ থেকে বের করে এনে গবেষণাগারে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রেখে দিয়ে সাথে সাথে স্বামীর বীর্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন প্রকার ওষুধের মাধ্যমে পরিষ্কার করতে হবে। ভালোভাবে পরিষ্কার করার পর ভ্রূণ বিশেষজ্ঞ কোন শুক্রকীটটি ভালো এবং স্বাস্থ্যবান তা নির্ণয় করে অত্যন্ত সূক্ষ্ম যণ্ত্র যার নাম মাইক্রোমেনুপুলেটার; এই যন্ত্রের সাহায্যে ধরে ডিম্বের সাইটোপ্লাজমের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয় এবং সাথে সাথেই ডিমটিকে মায়ের জরায়ুর মধ্যে সংস্থাপন করা হয়। মাইক্রোমেনুপুলেটার যন্ত্রটি অত্যন্ত মূল্যবান। যে টিউবের সাহায্যে শুক্রকীটটিকে ধরে আনা হয়, তার ছিদ্র হলো একটা চুলের যে পরিমাণ ঘনত্ব তার দশ ভাগের এক ভাগ। আগেই বলা হয়েছে, সব প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত দক্ষ ও মেধা সম্পন্ন চিকিৎসকদলের প্রয়োজন।
সন্তানহীন দম্পতিদের যা করতে হবে
সন্তানহীন দম্পতি আমরা কাকে বলব? বিয়ে করার পর কোনো প্রকার পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতি ব্যবহার না করে যদি এক বছরের মধ্যে কোনো দম্পতি সন্তান লাভে ব্যর্থ হয় তবে এ দম্পতিকে সন্তানহীন দম্পতি বলা হয়। কয়েক বছর আগে এই সময়কাল দুই বছর পর্যন্ত ছিল। নানা প্রকার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য পরিবর্তনের ফলে এ সময়কালকে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। যেমন- আগে তরুণ-তরুণীদের বিবাহ হতো ১৫-২০-এর মধ্যে। সেই সময়ই সন্তান জন্ম দেয়ার উত্তম সময়। আর বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সামাজিক পরিবর্তন যেমন- যৌনরোগ, ধূমপান, মাদকদ্রব্য সেবন, রেডিয়েশন হেজার্ড ইত্যাদি কারণের জন্য সন্তান ধারণের ক্ষমতা দিন দিন লোপ পাচ্ছে। দেশে প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন সন্তানহীন দম্পতি রয়েছে। সারা পৃথিবীতে এর সংখ্যা প্রায় দুই কোটিরও বেশি। দেশে এই সমস্যাকে মোকাবেলা করার জন্য সত্যিকারভাবে কোনো পরিকল্পনা না থাকায় সমস্যাটি দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। এ ব্যাপারে সরকারি ও সামাজিকভাবে পরিকল্পনা দরকার। মনে রাখতে হবে সন্তান জন্ম  দেয়ার মালিক সৃষ্টিকর্তা। অ্যাম্ব্রোয়োলজিস্ট হিসেবে আমাকে জানতে হবে কোন কারণে সন্তান হচ্ছে না।
করণীয়
১. জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে : দেখা গেছে অজ্ঞতার কারণে রোগীরা বিভিন্ন প্রকার অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে সর্বস্বান্ত হচ্ছে এবং প্রচুর সময় নষ্ট হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এতে সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা লোভ পাচ্ছে, যা কোনো অবস্থাতেই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে এবং হতভাগ্য সন্তানহীন দম্পতিদের সঠিক নির্দেশনা দিতে পারে।
২. সন্তান হচ্ছে না কেন এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। সে কারণটি অথবা কারণগুলো স্বামী অথবা স্ত্রী অথবা উভয়ের মধ্যেই বিদ্যমান। কোনো অবস্থাতেই নিহিত কারণটি অথবা কারণগুলো বের না করে চিকিৎসা দেয়া উচিত নয়। কারণগুলোকে উপেক্ষা করে চিকিৎসা দিলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ফলে দমপতিটি চিরকালের জন্য বন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে। তা হবে দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের দেশে সন্তান জন্ম দিতে না পারার জন্য কেবল স্ত্রীকেই দায়ী করা হয়, যা মোটেই ঠিক নয়। প্রকৃত তথ্য হলো আমাদের দেশে ৬০ শতাংশের বেশি স্বামীর কারণে সন্তান হচ্ছে না। অথচ এর জন্য স্ত্রীকে দায়ী করা হয় এবং নানা প্রকার কটূক্তি সহ্য করতে হয়। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের দেশের সংবাদপত্র, রেডিও-টিভিকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। দুঃখের সাথে বলতে হয়, কর্তৃপক্ষ এ সমস্যাটির গুরুত্ব অনুভব করছে ঠিকই কিন্তু এর ভূমিকা পালনে তারা আগ্রহী আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। আমি মিডিয়া কর্তৃপক্ষকে এই সমস্যা নিরীক্ষণে সঠিক ভূমিকা পালনের জন্য অনুরোধ করছি।
চিকিৎসক হিসেবে আমাদের যে বিষয়গুলো জানতে হবে
ক) ঠিক সময়ে স্ত্রীর ডিম ফুটছে কি না।
খ) ফুটন্ত ডিমগুলো ফেলোপিয়ান টিউবের মাধ্যমে যাতায়াতের রাস্তাটা ঠিক আছে কি না।
গ) যেখানে আপনার স্ত্রীর সন্তানটি ৯ মাস ৭ দিন অবস্থান করে অর্থাৎ জরায়ুর সন্তান ধরে রাখার ক্ষমতা ঠিক আছে কি না দেখতে হবে। স্ত্রীর ক্ষেত্রে এই তিন বিষয় যে কোনভাবে আমাদের বিভিন্ন প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নিতে হবে। এতে কোনো প্রকার গরমিল থাকলে স্ত্রী সন্তান লাভ নাও করতে পারে। তাই কারণ নির্ণয় করার আগে সন্তান লাভের আশায় কোনো প্রকার মেডিসিন ব্যবহার করা ঠিক নয়। স্বামীর ক্ষেত্রেও সে সন্তান জন্ম দিতে পারবে কি না তা পরীক্ষা করে জেনে নিতে হবে।
প্রজননের ক্ষেত্রে যেসব অর্গান কাজ করে তা পরীক্ষা করে জেনে নিতে হবে। অনেক চিকিৎসক এ বিষয়ে সঠিক মনোযোগ দিতে বিরত থাকেন যা কোনোমতেই কাম্য নয়। বীর্য সঠিক পরিমাণ, জীবিত শুক্রকীট আছে কি না, এদের চলাফেরার গতিবিধি কী, শারীরিকভাবে সুস্থ অথবা বিকলাঙ্গ আছে কি না তা নিবিড় পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নিতে হবে। এখানে একটু জেনে রাখা ভালো যে স্যাম্পল গ্রহণ করার জন্য ল্যাবরেটরি অবশ্যই উন্নতমানের হতে হবে। কোনো অবস্থাতেই বাথরুম অথবা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্যাম্পল গ্রহণ করা ঠিক হবে না। আমরা জানি শুক্রকীট তৈরি হয় অণ্ডকোষ থেকে। সহবাস করার সময় এই কীটগুলোর অনেকটা পথ অতিক্রম করে আসতে হয়। এ ক্ষেত্রে ভ্রূণপথটি যদি বন্ধ থাকে অথবা কোনো কারণে হরমোনের তারতম্য থাকে অথবা যৌনরোগ থাকে তবে শুক্রকীটগুলো নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে পারবে না অর্থাৎ আদরের সন্তান জন্ম দেয়ার সুযোগ কমে গেল অথবা অক্ষম হয়ে গেল। এ ক্ষেত্রে হার্নিয়া, হাড্রোসিল, ওরকাইটিস ইত্যাদি রোগের কারণে পুরুষদের জন্মক্ষমতা কমে যেতে পারে।
এখানে মনে রাখতে হবে, পরীক্ষাগুলো যদি কোনো কারণে নির্দিষ্ট সময় করা সম্ভব না হয়, তবে তাকে পরবর্তী মাসিকের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমরা অবগত আছি যে, শুক্রকীটের প্রাণ আছে, তাই কোনো অবস্থাতেই ওষুধের মাধ্যমে শুক্রকীট তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই পুরুষদের বন্ধ্যত্ব হলে সাধারণ চিকিৎসার মাধ্যমে সন্তান লাভ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন হলে অ্যম্ব্রোয়োলজিস্ট বা নিঃসন্তান দম্পতিদের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের কাছে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। পৃথিবীতে নিঃসন্তান দম্পতিদের জন্য অনেক পদ্ধতি রয়েছে। অ্যম্ব্রোয়োলজিস্টরা ঠিক করে নেবেন কোন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলে সুফল আসবে। চিকিৎসাব্যবন্থার এত দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে যে, সোসাইটি মনে করে অদূর ভবিষ্যতে কোনো দম্পতিকে আর সন্তানহীন অবস্থায় থাকতে হবে না। যেমন- আইইউআই, আইভিএফ, ইকসি, টিউবেল হাইড্রিসন, মেসা, আইভিএম, পেশা এবং আরও অনেক।
লেখক : অ্যাম্ব্রায়োলজিস্ট
নিঃসন্তান দমপতিদের চিকিৎসা কেন্দ্র
এন-২৩, নূরজাহান রোড, মোহামমদপুর, ঢাকা-১২০৭
ফোনঃ ৮১১৫৯৩২, মোবাঃ ০১৭১৪৩০১৯২৫।


শেয়ার করে আপনার বন্ধুদেরকে জানান । তাদের কে জানতে দিন অজানা বিষয় গুলি। প্রকাশক ও সম্পাদক ব্লগার_সৈয়দ রুবেল লেখকজানার আছে অনেক কিছু

কোন মন্তব্য নেই :