হার্টের উপকারী খাবার

কোন মন্তব্য নেই

খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস সহসা বদলানো যায় না। আমরা যা কিছু খাই, তা সব সময় হূৎপিণ্ডের জন্য উপকারী নয়। হূদরোগের প্রকোপ দিন দিন যেভাবে বেড়ে চলেছে, তার পেছনে আমাদের জীবনাচরণ পদ্ধতির একটি বিশাল ভূমিকা আছে। আর জীবনাচরণের একটি মুখ্য বিষয় খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস। যেসব খাবার হূৎপিণ্ডকে সুস্থ-সবল রাখতে সাহায্য করে সেগুলো অনেক সময় আমরা খাই না। এ জন্য আমাদের সবারই জানা উচিত হূৎপিণ্ডকে সুস্থ রাখার জন্য আমরা কী খাব আর কী খাব না।
সম্পৃক্ত চর্বি এবং
কোলোস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার পরিহার করতে হবে
হূৎপিণ্ডের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য এটাই সবচেয়ে গু্রুত্বপূর্ণ। যেসব খাবারে সম্পৃক্ত চর্বি, ট্রান্সফ্যাট এবং কোলোস্টেরলের পরিমাণ বেশি সেগুলো অবশ্যই আমাদের খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। এ-জাতীয় তেল-চর্বিযুক্ত খাদ্য বেশি গ্রহণ করলে চর্বির পুরু আস্তর জমে রক্তনালির ফুটো বুজে যায়। ফলে হূৎপিণ্ডে রক্ত চলাচল কমে যায় কিংবা অংশবিশেষে একেবারে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে হূদরোগ এবং মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত বা স্ট্রোক হয়।
প্রতিদিন হূদবান্ধব খাবারে সর্বোচ্চ কতটুকু চর্বি থাকতে পারে তার একটি তালিকা নিচে দেয়া হলো।
খাবারে সম্পৃক্ত চর্বি এবং ট্রান্সফ্যাট কমাতে হলে আমাদের মাখন, ঘি, মার্জারিন ইত্যাদির ব্যবহার কমাতে হবে। এ ছাড়া গরু কিংবা খাসির চর্বিযুক্ত মাংস গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। খাবারে চর্বির পরিবর্তে বিকল্প উপাদান ব্যবহার করা যেতে পারে যেমন- মাখনের পরিবর্তে ফলের সস, জ্যাম, জেলি কিংবা দই। যে কোনো কুকি, ক্র্যাকার, চিপস খাওয়ার আগে গায়ের মোড়কে কী লেখা আছে তা দেখা উচিত। আজকাল সবাই কম চর্বিযুক্ত উপাদান ব্যবহার করছে। এসব খাবারে ট্রান্সফ্যাট বেশি থাকে। ট্রান্সফ্যাট বলতে আংশিক বিজারিত চর্বি বা Partially Hydrogenated fat-কে বোঝানো হয়। হোটেল কিংবা বাড়িতে ভাজি করার জন্য যে তেল ব্যবহার করা হয়, অনেক সময় কড়াইয়ের অতিরিক্ত তেল রেখে দিয়ে তা পরদিন আবার অন্য তরকারি রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের ব্যবহূত তেল রেখে দিলে ওটাতে প্রচুর ট্রান্সফ্যাট তৈরি হওয়ার অবকাশ থাকে। অতএব, প্রতিবার রান্নার সময় নতুন তেল ব্যবহার করা উত্তম; আগের দিনের ভাজাভুজির পর কড়াইয়ে থেকে যাওয়া তেল ব্যবহার করা ক্ষতিকর। আর অবশ্যই রান্নার জন্য অসম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত তেল যেমন- সয়াবিন, জলপাই কিংবা ক্যানোলা তেল ব্যবহার করা উচিত। বাদাম এবং সয়া বীজের তেলে অসম্পৃক্ত চর্বি বেশি থাকে। সম্পৃক্ত চর্বির পরিবর্তে অসম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত তেল ব্যবহার করলে রক্তে কোলেস্টেরল কম থাকে। অবশ্য সব ধরনের তেল-চর্বিতে ক্যালরির পরিমাণ অনেক বেশি থাকে।
কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে
আমাদের দৈনন্দিন প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে হবে। কিন্তু এ জন্য এমন প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে যেখানে চর্বি নেই কিংবা চর্বির পরিমাণ খুব কম। যেমন-চর্বিমুক্ত খাসি, গরু কিংবা মুরগির মাংস, মাছ, ডিমের সাদা অংশ ইত্যাদি। ক্রিমমুক্ত বা সর ছাড়া দুধ খেলেও যথেষ্ট প্রোটিন পাওয়া যায়। তবে চর্বিযুক্ত মাংস খাওয়ার চেয়ে মাছ ভালো। কতগুলো মাছে আবার হূৎপিণ্ডের জন্য উপকারী ওমেগা-৩-ফ্যাটি এসিড থাকে। এরা রক্তের অতিরিক্ত ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। শীতপ্রধান দেশের নদী-সাগরের মাছে সবচেয়ে বেশি ওমেগা-৩-ফ্যাটি এসিড থাকে। যেমন-স্যামন, ম্যাকারেল, হেরিং মাছ ইত্যাদি। কাঠবাদাম, সয়াবিন এবং ক্যানোলা তেলেও যথেষ্ট ওমেগা-৩-ফ্যাটি এসিড আছে।
ডাল, মটরশুঁটি, শিমের বিচিত্র এগুলো প্রোটিনের উৎস হিসেবে খুব ভালো। বাড়তি সুবিধা হচ্ছে এসবের চর্বিতে কোনো কোলেস্টেরল নেই। কাজেই যারা চর্বিমুক্ত প্রোটিন খুঁজছেন তারা ডাল, মটরশুঁটি, শিমের বিচি খেতে পারেন। প্রাণিজ প্রোটিনের পরিবর্তে সয়া প্রোটিন ব্যবহার করা স্বাস্থ্যকর। হ্যাম বার্গার কিংবা বিফ বার্গারের পরিবর্তে সয়াবার্গার খাওয়া যেতে পারে। এতে বার্গার খাওয়ার শখও মিটবে এবং অতিরিক্ত চর্বি ও কোলেস্টেরলের হাত থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে।
ভালো প্রোটিন এবং মন্দ প্রোটিন
কম ননীযুক্ত/ননীমুক্ত দুধ পূর্ণ ননীযুক্ত দুধ, পনির, দই গরু-খাসির মাংস, যকৃৎ, ডিমের সাদা অংশ, ডিমের কুসুম, মাছ হটডগ, সসেজ, চামড়ামুক্ত মুরগির মাংস বেকন, শিমের বিচি ফ্রাই মিট-কাবাব, সয়াবিন, কিমা মাংস, শাকসবজি ও ফলমূল বেশি খেতে হবে।
শাকসবজি ও ফলমূলে প্রচুর লবণ এবং ভিটামিন থাকে। এসবে ক্যালরি কম কিন' প্রচুর আঁশ থাকে। এ ছাড়া শাকসবজি ও ফলমূলে আরও কিছু বাড়তি উপাদান থাকে যা হূদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে, আর বেশি বেশি সবজি-ফল খেলে অতিরিক্ত চর্বি, মাংস, মাখন-ল্যাকসের হাত থেকেও মুক্ত থাকা যায়। এ জন্য প্রতিবার খাবারের সময় কিছু সবজি, ফল প্রস'ত রাখা উচিত।
যেসব শাকসবজি ও ফল বেশি খাওয়া উচিত
তাজা সবজি ও ফল, কম নোনা সবজি, কৌটায় সংরক্ষিত ফল।
যেসব শাকসবজি ও ফল কম খাওয়া উচিত
নারকেল, ক্রিম সসযুক্ত সবজি, ভাজা সবজি, চিনির সিরাপে সংরক্ষিত ফল, চিনিযুক্ত হিমায়িত ফল।
আকর শস্যদানা গ্রহণ করা উপকারী
আকর শস্যদানায় প্রচুর পুষ্টি ও আঁশ থাকে। এগুলো হূৎপিণ্ড তথা সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। অতি পরিশোধিত খাদ্যের চেয়ে আকর শস্যদানা বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা ভালো।
যেসব শস্যদানা বেশি খাওয়া উচিত
আকর গমের আঁটা, তুষযুক্ত আটার র"টি, পাউরুটি, আঁশযুক্ত শস্য (প্রতিবার পাঁচ গ্রাম বা তার বেশি), আকাঁড়া চাল, বার্লি, গম, ওট মিল
যেসব শস্যদানা কম খাওয়া উচিত
পরিশোধিত সাদা ময়দা, সাদা রুটি, মাফিনস, হিমায়িত ওয়াফেল, ডো-নাট, বিস্কুট, কেক, পাই, এগ-নুডুলস, মাখনযুক্ত পপকর্ন, অতি চর্বিযুক্ত ল্যাক, ক্র্যাকার্স।
খাবারে লবণের পরিমাণ কমাতে হবে
অতিরিক্ত লবণ খেলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। উচ্চরক্তচাপ হূদরোগের প্রধান কারণ। এ জন্য খাবারে লবণের পরিমাণ কম রাখা খুব গু্রুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের খাদ্যে সব মিলিয়ে আড়াই গ্রামের বেশি অর্থাৎ এক চা-চামচের কম লবণ থাকা উচিত। যাদের বয়স ৫১-এর বেশি এবং যাদের উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস কিংবা কিডনির সমস্যা আছে তাদের কখনোই প্রতিদিন দেড় গ্রামের বেশি সোডিয়াম গ্রহণ করা উচিত নয়। পাতে আলাদা লবণ না খাওয়া কিংবা রান্নার সময় তরকারিতে অতিরিক্ত লবণ যোগ না করা লবণ কমানোর প্রাথমিক পদক্ষেপ। পাশাপাশি এ কথাও মনে রাখতে হবে, আমাদের দৈনন্দিন আহারের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লবণ আসে কৌটাজাত খাদ্যদ্রব্য, প্রক্রিয়াজাত করা খাবার, সুপ, হিমায়িত খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি উৎস থেকে। অতএব লবণ গ্রহণের মাত্রা কমানোর জন্য এ ধরনের খাদ্যদ্রব্যের ব্যাপারেও আমাদের নজর রাখতে হবে।
  • কম নোনা খাদ্যদ্রব্য অতিরিক্ত নোনা খাদ্যদ্রব্য
  • হার্বস এবং মশলপাতের আলগা লবণ
  • লবণের বিকল্প কৌটাজাত সুপ
  • কম নোনা কৌটাজাত সুপ ইত্যাদি টমেটো সস
  • কম নোনা সয়াসস, কেচাপ সয়া সস
  • পাতে কম খাবার গ্রহণ
কী খেতে হবে, কোন খাদ্যদ্রব্য স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, এটা জানা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, কতটুকু খেতে হবে সেটা নির্ধারণ করাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য খেতে বসে প্রথমে প্লেটে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ না করা উত্তম। এক প্লেট খাদ্য গ্রহণের পর দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়  প্লেট খাদ্য খাওয়া থেকে বিরত থাকা অবশ্যই বুদ্ধিমানের কাজ।
খাবারের তালিকা আগেভাগে ঠিক করা
খাবারের তালিকা আগেভাগে ঠিক করা থাকলে তা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
খাবারের দৈনিক তালিকা নির্ধারণের সময়
সবজি এবং ফলমূলের পরিমাণ বেশি রাখতে হবে। চর্বিমুক্ত প্রোটিনকে প্রাধান্য দিতে হবে। অসম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবার রাখতে হবে। খাবারে লবণের পরিমাণ সীমিত রাখতে হবে। খাবারের পরিমাণ এবং বৈচিত্র্যের বিষয়টিকে ভুলে গেলে চলবে না।
মাঝেমধ্যে বৈচিত্র্য দরকার
হূদবান্ধব খাবার বিস্বাদ কিংবা আকর্ষণবিহীন হলে তো চলবে না। এ জন্য অবশ্যই খাবারে বৈচিত্র্য থাকতে হবে। মাঝেমধ্যে একটি ক্যান্ডি বার কিংবা একমুঠ আলুর চিপস খাওয়া দোষের নয়। তবে এটা যেন মাত্রাতিরিক্ত কিংবা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিশষে বলা যায় আমরা হূদবান্ধব খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কে এতক্ষণ যে দিকনির্দেশনা দিয়েছি তা অনুসরণ করলে যে-কেউ উপকৃত হবেন। এটা বাস্তবসম্মত এবং আনন্দদায়কও বটে।
লেখকঃ
অধ্যাপক ডা. এআরএম সাইফুদ্দীন একরাম
বিভাগীয় প্রধান, মেডিসিন বিভাগ
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ


 পোস্ট @ মনোজগত 

শেয়ার করে আপনার বন্ধুদেরকে জানান । তাদের কে জানতে দিন অজানা বিষয় গুলি।  প্রকাশক ও সম্পাদক ব্লগার_সৈয়দ রুবেল লেখকজানার আছে অনেক কিছু

কোন মন্তব্য নেই :