প্রসূতি মায়ের প্রস্তুতি

ডা. নাফিসা আবেদীন
স্বাভাবিক গর্ভকালীন সময়সীমা সাধারণত দশ মাস হলেও সুস্থ শিশু জন্মদানকল্পে গর্ভধারণের আগের তিন মাস সময়সহ এ সময়কালকে ১২ মাস বিবেচনা করতে হবে। একজন মা যখনই গর্ভধারণ করবেন বলে মনস্থির করেছেন, তখন থেকেই তাকে পরিকল্পনা মাফিক চলা উচিত।
প্রসূতি মাকে গর্ভধারণের আগে একজন চিকিৎসক দেখিয়ে প্রয়োজনীয় চেকআপ করে নেয়া উচিত। কারও যদি ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো অসুস্থতা থেকে থাকে তবে তা চিকিৎসককে জানাতে হবে। এছাড়া পারিবারিক বা অন্যান্য রোগজনিত পূর্ব ইতিহাস, জন্মগত ত্রুটি, জেনেটিক কন্ডিশন, আগে চিকিৎসাদি নিয়ে থাকলে বা কোনো ওষুধ সেবন করে থাকলে সে বিষয়েও চিকিৎসককে অবহিত করুন। এতে একজন মা গর্ভকালীন অনেক বেশি নিরাপদ থাকবেন। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের গ্রুপ, হেপাটাইটিস বি ও সি, যৌনবাহিত সংক্রামক ব্যাধি এবং এইচআইভি আছে কি না পরীক্ষা করুন। স্বাস্থ্যজনিত যে কোনো সমস্যা যেমন্য-ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ বা ওজন যদি অতিরিক্ত হয়ে থাকে তবে এসব সমস্যার সঠিক সমাধানের জন্য চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
গর্ভবতী মায়ের পুষ্টি
গুরুজনরা বলে থাকেন গর্ভবতী অবস্থায় একজন নয়; বরং দুজনের জন্য খেতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো আপনাদের দুজনের জন্য আপনি কী খাবেন? প্রতিদিন আপনাকে যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন এবং মিনারেল খেতে হবে। এছাড়া গর্ভবতী হওয়ার আগে থেকেই আপনার স্বাস্থ্যকর সুষম খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি প্রিন্যাটাল ভিটামিনসমৃদ্ধ (গর্ভকালীন চাহিদাকৃত ভিটামিন) খাবার গ্রহণ করা উচিত। প্রতিবার খাবার গ্রহণের সময় আপনার থালা সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, দানাদার শস্যকণাসমৃদ্ধ খাবার (গমের রুটি) দিয়ে পূর্ণ করুন। এছাড়া ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার যেমন ব্রকলি (এক ধরনের সবুজ ফুলকপি) ও কম স্নেহযুক্ত দুধ প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত। এতে বাড়ন্ত ভ্রূণের বা শিশুর হাড় ও দাঁতের বৃদ্ধি সাধিত হবে। তাছাড়া চর্বিবিহীন মাংস যেমন মুরগির মাংস নিয়মিতভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। গর্ভকালীন নিম্নোক্ত খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত-কাঁচা মাছ, অপাস্তুরিত দুধ এবং পনির জাতীয় খাবার। কেননা এসব খাবারে লিস্টেরিয়া নামক ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা গর্ভাশয়ে প্রবেশের ফলে ভ্রূণের ঝুঁকিপূর্ণ সংক্রামক রোগ এমনকি গর্ভপাতও হতে পারে। এছাড়া অর্ধসিদ্ধ মাংস দিয়ে তৈরি স্যান্ডউইচ জাতীয় খাবারে লিস্টেরিয়া ব্যাকটেরিয়া থাকার আশঙ্কা থাকে বিধায় তাও পরিহার করা উচিত। কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, গর্ভকালীন পরিমিত মাত্রার ক্যাফেইন গ্রহণে কোনো অসুবিধা নেই। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অত্যধিক ক্যাফেইন গ্রহণে গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই গর্ভধারণের প্রথম তিন মাস ক্যাফেইন (চা বা কফি) জাতীয় খাবার গ্রহণ পরিহার করা উচিত। এছাড়া অতিরিক্ত পরিমাণে ক্যাফেইন জাতীয় খাবার গ্রহণে অপূর্ণাঙ্গ এবং স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই গর্ভকালীন ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা সবচেয়ে ভালো। আর একেবারেই ছাড়তে না পারলে সীমিত পরিমাণ (৩০০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন) অর্থাৎ প্রতিদিন ২ কাপ কফি গ্রহণ করা যেতে পারে। গর্ভকালীন অ্যালকোহল সেবন করলে তা নবজাতকের শারীরিক ও মানসিক কাঠামোর স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। তাই গর্ভকালীন অবশ্যই অ্যালকোহল সেবন পরিহার করা উচিত।
গর্ভকালীন লাইফস্টাইল
গর্ভকালীন কী পরিহার করা উচিত আর কী বেশি করা উচিত তার তালিকা আসলে অনেক দীর্ঘ। নিম্নে কোন কাজগুলো গর্ভকালীন বেশি করা উচিত এবং কোন কাজগুলো এড়িয়ে চলা উচিত সে সম্পর্কে সুদীর্ঘ তালিকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
যে কাজগুলো করা উচিত
গর্ভকালীন হালকা ও পরিমিত ব্যায়াম আপনার জন্য খুবই উপকারী। কেননা এতে আপনার পশ্চাতের এবং উদরের (অ্যাবডোমিনাল) মাংসপেশিগুলো শক্তিশালী হবে। ভারসাম্য রক্ষা সহজতর হবে ও প্রসবের পর খুব দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা সম্ভব হবে। খাবার প্রস্তুত ও গ্রহণের আগে এবং কাঁচা মাছ বা মাংস স্পর্শ ও বাথরুম ব্যবহারের পর আপনার হাত খুব ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধোবেন। আপনার বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। বাড়ি পরিষ্কার করার সময় আপনার ঘরে অবাধে বায়ু চলাচল করতে পারে কি না তা নিশ্চিত হোন।
নিয়মিত ডেন্টিস্টের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এ সময়ে শরীরে হরমোন লেভেল বেড়ে যাওয়ায় তা মাড়ির রক্তপাত ঘটাতে পারে এবং যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। এছাড়া মাড়ির ইনফেকশনের সঙ্গে নবজাতকের অকাল জন্ম সম্পর্কযুক্ত বিধায় গর্ভবতী মায়েদের দাঁতের সুস্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় যদি বিমানে ভ্রমণের প্রয়োজন হয়, তবে দ্বিতীয় বা তৃতীয় মাসে আকাশপথে বিমানে ভ্রমণ করা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। কেননা, এ সময় গর্ভপাতের ঝুঁকি খুব কম থাকে। বিমান ভ্রমণকালে আপনাকে অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় পদার্থ পান করা এবং সিটবেল্ট বেঁধে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া আপনি মোটরকার, ট্রেন বা বাসেও ভ্রমণ করতে পারেন। তবে দীর্ঘ ভ্রমণে মাঝেমধ্যে আপনাকে সিট থেকে উঠে একটু চলাফেরা করতে হবে এবং আপনার পা ও পশ্চাৎ অংশ কিছুক্ষণ পরপর প্রসারিত করতে হবে। গর্ভধারণজনিত উচ্চমাত্রার ঝুঁকি রয়েছে এবং চিকিৎসক আপনাকে নিষেধ করেছেন এরূপ ক্ষেত্র ছাড়া আপনি যৌনসঙ্গমে মিলিত হতে পারেন। কেননা, গর্ভকালীন যৌনমিলন নিরাপদ। অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড দিয়ে বাড়ন্ত ভ্রূণ সুরক্ষিত থাকে। গর্ভকালীন যৌনমিলনের ক্ষেত্রে উপুড় হয়ে শোয়া পরিহার করা উচিত। এতে জরায়ু আপনার উদর বা পেটের শিরাকে সংকুচিত করতে পারে এবং মাথা ঝিমঝিম এমনকি বমি বমি ভাবও হতে পারে।
যা করা উচিত নয়
উত্তপ্ত বা গরম পানিপূর্ণ গোসলের চৌবাচ্চা ব্যবহার করা উচিত নয়। অতিরিক্ত তাপের কারণে বাড়ন্ত শিশুর মেরুদণ্ড বিকলাঙ্গ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কোনো উপায়ান্তর না থাকলেই শুধু এক্স-রে করান। বাড়ন্ত ভ্রূণের জন্য ক্ষতিকর বিধায় এক্স-রে, ম্যামোগ্রাফি প্রভৃতি পরীক্ষা এড়িয়ে চলা উচিত। আর যদি এক্স-রে এড়ানোর কোনো সুযোগ না থাকে তাহলে আপনি যে গর্ভবতী তা চিকিৎসককে জানান, যাতে তিনি অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেন।
গর্ভধারণকালীন ব্যায়াম
অধিকাংশ স্বাস্থ্যবতী মহিলার জন্য গর্ভকালীন ব্যায়াম করা নিরাপদ, যা অনেক ক্ষেত্রে মহিলাদের গর্ভকালীন বিভিন্ন অস্বস্তিবোধ থেকে পরিত্রাণ দেয়। কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যায়াম যেমন-নিয়মিত হাঁটা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, যোগব্যায়াম প্রভৃতি একজন গর্ভবতী মহিলার জন্য অত্যন্ত উপকারী। সাধারণত যেসব ব্যায়ামে ভারোত্তোলন বা ভার বহনের প্রয়োজন হয় না এবং প্রচুর পরিমাণে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজন পড়ে না; গর্ভকালীন সে ধরনের ব্যায়াম করার ওপর জোর দেয়া উচিত। ব্যায়ামের প্রাক্কালে হালকা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করা উচিত। প্রচুর পরিমাণ তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করুন এবং পরিশ্রান্ত অবস্থায় কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। ছয় মাস থেকে নয় মাস পর্যন্ত গর্ভধারণকালে যে ধরনের ব্যায়ামে পেছনের দিকে শুয়ে পড়তে হয়, সে ধরনের ব্যায়াম পরিহার করতে হবে। যে কোনো ধরনের ব্যায়াম শুরু করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যেসব মহিলার ঘন ঘন গর্ভপাতের অভিজ্ঞতা, গর্ভপাতের ঝুঁকি, উচ্চরক্তচাপ বা হার্টের সমস্যা রয়েছে অথবা যাদের প্রি-একলাম্পসিয়া হয়েছে তাদের জন্য ব্যায়াম না করাই উত্তম।
গর্ভকালীন মায়ের ওজন
গর্ভকালীন খুব বেশি পরিমাণ ওজন বেড়ে যাওয়া যেমন গ্রহণযোগ্য নয়,  তেমনি ওজন কমে যাওয়াও গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এ সময় ওজন হতে হবে ঠিক যা হওয়া উচিত তাই। যদি ওজন খুব বেশি পরিমাণে বেড়ে যায় তবে গর্ভজনিত ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। আবার ওজন যদি কমে যায় তবে নবজাতকের স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজন নিয়ে জন্মলাভের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। তাই আপনাকে স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখতে হবে। গর্ভধারণের আগে আপনি যদি স্বাভাবিক ওজনের অধিকারী হয়ে থাকেন তবে গর্ভকালীন আপনার ওজন বৃদ্ধির গ্রহণযোগ্য সীমা হলো ২৫ থেকে ৩৫ পাউন্ড। গর্ভধারণের আগে আপনি যদি স্বাভাবিকের  চেয়ে বেশি ওজনের অধিকারী হয়ে থাকেন তবে সে ক্ষেত্রে আপনার ওজন বৃদ্ধির গ্রহণযোগ্য সীমা হলো ১৫ থেকে ২৫ পাউন্ড। গর্ভধারণের আগে আপনি যদি স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের অধিকারী হয়ে থাকেন তবে  সে ক্ষেত্রে আপনার ওজন বৃদ্ধির গ্রহণযোগ্য সীমা হলো ২৮ থেকে ৪০ পাউন্ড। একের অধিক শিশুর ভ্রূণ ধারণের ক্ষেত্রে ওজন বৃদ্ধির মাত্রার বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন (সাধারণত যমজ শিশুর ক্ষেত্রে ওজন বৃদ্ধির গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৩৫ থেকে ৪৫ পাউন্ড)। গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে গড়ে একজন গর্ভবতী মায়ের ওজন প্রায় ২ থেকে ৪ পাউন্ড বেড়ে যায় এবং পরবর্তী অবশিষ্ট সময়ে প্রতি সপ্তাহে ওজন প্রায় ১ পাউন্ড করে বাড়ে।
অ্যান্টিনেটাল চেক-আপ
গর্ভধারণের পর থেকে পরবর্তী নয় মাস হয়তো আপনি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ কর্তৃক নিয়মিত বিরতিতে চেকআপ করছেন। কিন্তু আপনি কীভাবে বুঝবেন গর্ভজনিত চেকআপের নিয়মিত বিরতির মাঝামাঝি কোন সময় আপনাকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে? এই সময় কোন পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং কোন উদ্ভূত পরিস্থিতি অস্বাভাবিক তা আপনাকে জানতে হবে। আপনি যদি গর্ভবতী হয়ে থাকেন তবে নিচের যে কোনো উপসর্গ বা লক্ষণ পরিলক্ষিত হওয়ামাত্রই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন- অস্বাভাবিক খিঁচুনি, মাংসপেশির যন্ত্রণা বা উদরে অস্বাভাবিক ব্যথা অনুভূত হওয়া। ২৮ সপ্তাহের পর থেকে বাড়ন্ত ভ্রূণের নড়াচড়া লক্ষণীয় পরিমাণে কমে গেলে (১২ ঘণ্টায় নড়াচড়ার সংখ্যা ১০ বারের কম হলে), শ্বাসকষ্ট পরিলক্ষিত হলে, গর্ভকালীন যৌনপথে রক্তপাত হলে।
এভাবে গর্ভধারণকালীন আপনি যদি একটু চিন্তাভাবনা তথা পরিকল্পনা করে চলাফেরা করেন তবে নির্বিঘ্নে আশা করি মাতৃত্বের অধিকারী হতে পারবেন।