শিশু ও মাতৃস্বাস্হ্য রক্ষায় জন্মনিয়ন্ত্রণ |

কোন মন্তব্য নেই

খাবার বড়ি
অনিয়ন্ত্রিত বা ঘন ঘন সন্তান
জন্মদান মা এবং শিশু উভয়ের জন্য
ঝুঁকিপুর্ণ। এমনিতেই গর্ভধারণ
কোনো কোনো মহিলার জন্য মারাত্মক
সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। গর্ভধারণ মায়ের
স্বাস্হ্যহানি ঘটাতে পারে,
এমনকি মায়ের জীবনের জন্য
ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। উন্নত
দেশগুলোর চেয়ে আমাদের
দেশে গর্ভজনিত কারণে মাতৃমৃত্যুর
সম্ভাবনা ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি।
সন্তান যত বেশি হয় এ সম্ভাবনাও
তত বেশি বাড়াতে থাকে। ঘন ঘন
সন্তান জন্মদানের ফলে মায়ের
মারাত্মক রক্তস্বল্পতা, গর্ভপাত,
গর্ভকালীন রক্তপাত, এমনকি মৃত্যু
পর্যন্ত হতে পারে। মায়ের স্বাস্হ্য ও
পুষ্টির সঙ্গে নবজাতকের স্বাস্হ্য
সম্পর্কিত। ঘন ঘন সন্তান
জন্মদানের ফলে মায়ের
স্বাস্হ্যহানি ঘটে। এ কারণে গর্ভস্হ
শিশু যথাযথভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়
না এবং স্বাভাবিকের চেয়ে (২.৫
কেজি) কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ
করে। এ ধরনের শিশু
মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হতে পারে,
কানে কম শুনতে পারে, অপুষ্টি,
পরিপাকতন্ত্র ও শ্বাসতন্ত্রের
ইনফেকশনে আক্রান্ত
হতে পারে এবং চোখের
দৃষ্টিতে ত্রুটি থাকতে পারে। কম ওজন
নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশু
পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক বৃদ্ধি,
পরিপুর্ণ বিকাশ এবং দক্ষতা অর্জন
করতে ব্যর্থ হয়। সাধারণত এদের
স্কুল পারফরমেসও খারাপ হয়ে থাকে।
গর্ভকাল মহিলাদের জন্য
একটি ঝুঁকিপুর্ণ সময়। এ সময়ে একজন
মহিলার শারীরিক এবং মানসিক ব্যাপক
পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। একবার
সন্তান জন্মদানের ফলে মহিলাদের
শরীরের যে ক্ষতি বা ঘাটতি হয়
তা পুরণ হতে বেশ সময়ের প্রয়োজন
হয়। শরীর পরবর্তী গর্ভের জন্য
উপযুক্ত হওয়ার আগেই পুনরায়
গর্ভধারণ করলে মারাত্মক
জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে যার
অতি দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন।
দেখা গেছে ঘন ঘন সন্তান
জন্মদানকারী মায়ের সব গর্ভ ৯ মাস
ধরে চলে না।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২৮ সপ্তাহের
আগেই সন্তান নষ্ট হয়ে যায়।
মানবদেহের রক্তের একটি অত্যন্ত
গুরুত্বপুর্ণ উপাদান
হচ্ছে হিমোগ্লোবিন। রক্তে এ
হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের
চেয়ে কমে গেলে তাকে রক্তস্বল্পতা বা
এনিমিয়া বলে। আয়রন বা লৌহ
রক্তে হিমোগ্লোবিনের সঠিক
মাত্রা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
আমাদের দেশের অনেক মহিলাই
শরীরে আয়রনের অভাবজনিত
কারণে রক্তস্বল্পতায় ভুগে থাকেন।
এর কারণ হিসেবে ঘন ঘন সন্তান
জন্মদান, মহিলাদের প্রতি সামাজিক
বৈষম্যমুলক আচরণ, খাবারের পুষ্টিগুণ
সম্পর্কে অজ্ঞতা, বয়ঃসন্ধিকাল
থেকে শুরু করে সমগ্র
প্রজননকালে প্রতি মাসে একবার
করে ঋতুবতী হওয়ার ফলে শরীর
থেকে রক্তক্ষরণ, কৃমির সংক্রমণ
প্রভৃতিকে দায়ী করা যেতে পারে।
গর্ভকালীন সময়ে মহিলাদের
শরীরে আয়রনের চাহিদা বেড়ে যায়।
গর্ভকালে মা এবং গর্ভস্হ শিশুর
চাহিদা পুরণের জন্য স্বাভাবিক
অবস্হার চেয়ে দুই বা তিনগুণ আয়রন
বা লৌহের প্রয়োজন হয়। ঘন ঘন
সন্তান জন্মদানকারী মহিলার
আগে থেকেই রক্তস্বল্পতা বিদ্যমান
থাকে। গর্ভকালে পুর্ব থেকে বিদ্যমান
রক্তস্বল্পতা মারাত্মক আকার ধারণ
করে। রক্তস্বল্পতাজনিত
কারণে গর্ভবর্তী মহিলা প্রায় সব
সময়ই ক্লান্ত এবং দুর্বল বোধ করেন।
অবসন্নতা, মাথা ঝিমঝিম করা, বুক
ধড়ফড় করা, অল্প
পরিশ্রমে হাঁপিয়ে ওঠা, শ্বাসকষ্ট
হওয়া কিংবা হাত-
পায়ে পানি আসা মারাত্মক
রক্তস্বল্পতার লক্ষণ। এ সময়
চামড়া ফ্যাকাশে হয়ে যায়। হাত-পায়ের
তালু, জিহ্বা, দাঁতের মাঢ়ি এবং চোখের
নিচের পাতার ভেতরের দিকে এ
ফ্যাকাশে ভাব পরিলক্ষিত হয়।
গর্ভকালীন রক্তস্বল্পতার
চিকিৎসা না করালে গর্ভবতী মহিলার
হার্ট ফেইলুর বা গর্ভপাত
হয়ে যেতে পারে।
এছাড়া রক্তস্বল্পতা গর্ভবতী মহিলার
ইনফেকশন এবং গর্ভকালীন ও
গর্ভপরবর্তী অতিরিক্ত
রক্তক্ষরণের জন্যও দায়ী। এ
কারণে গর্ভকালীন
রক্তস্বল্পতাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
উপরোক্ত জটিলতার কথা মাথায়
রেখে রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত
একজন মহিলার সুস্হ না হওয়া পর্যন্ত
গর্ভধারণ করা উচিত নয়। গর্ভকালীন
সময়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খাবার
এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
প্রচুর পরিমাণে রঙিন শাক-
সবজি (যেমন-কচুশাক, ডাঁটাশাক,
লালশাক) ও ফলমুল, দুধ, মাছ, মাংস,
কলিজা, ডিম প্রভৃতি লৌহসমৃদ্ধ খাবার
খেলে রক্তস্বল্পতা দুর হয়।
এছাড়া ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ খাবার
যেমন-আমলকি, লেবু, জামবুরা, আমড়া,
আনারস, পেয়ারা ইত্যাদিও খেতে হবে।
এতে শরীরে আয়রন বা লৌহের শোষণ
ভালোমত হয়। দুই গর্ভধারনের
মাঝে কয়েক বছর (দুই থেকে তিন বছর)
সময় নিলেও রক্তস্বল্পতার
ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।
জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং সুস্বাস্হ্য পরস্পর
সম্পর্কিত। জন্মনিয়ন্ত্রণ মায়ের
অসুস্হতা, অপুষ্টি, গর্ভজনিত
জটিলতা তথা মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধ।
সর্বোপরি মায়ের স্বাস্হ্য সুরক্ষিত
রাখে। নিয়ন্ত্রিত গর্বধারণ গর্ভস্হ
শিশুর অস্বাভাবিকতা বা মৃত্যুর
ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে আনে এবং
নবজাতকের স্বাস্হ্য রক্ষা করে।
বস্তুত জন্মনিয়ন্ত্রণ
মানে হচ্ছে অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ
পরিহার করা, মায়ের বয়স
অনুসারে প্রথম ও শেষ সন্তান
উপযুক্ত সময়ে (বিশ থেকে পঁয়ত্রিশ
বছর বয়সের মধ্যে) গ্রহণ করা,
সন্তান সংখ্যা সীমিত
রাখা এবং একটি সন্তান জন্মদানের দুই
থেকে তিন বছর পর পরবর্তী সন্তান
গ্রহণ করা। এসব বিষয় বিবেচনায়
নিয়ে একজন
মহিলা গর্ভবর্তী হলে তার স্বাস্হ্য
ঝুঁকির মধ্যে পড়ে না এবং এর
ফলস্বরুপ মাতৃমৃত্যুর হার কমে যায়।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ঘন ঘন
সন্তান জন্মদানের ফলে শিশু
মৃত্যুরহার বেড়ে যায়। দুটি গর্ভধারণের
মধ্যবর্তী দুই থেকে তিন বছর সময়
নিলে শিশু মৃত্যুরহার কমে আসে। এজন্য
বলা হয়ে থাকে জন্মনিয়ন্ত্রণ
হচ্ছে একটি পরিবারের শিশুকে রক্ষার
অন্যতম উপায়। জন্মনিয়ন্ত্রণের
ফলে শিশু সঠিক ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ
করে। শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ,
পুষ্টি এবং দক্ষতাও বেড়ে যায়। সমান
সংখ্যা কম হলে পরিবারের
জীবনযাত্রার মানেরও উন্নতি ঘটে।
পরিবার
পরিকল্পনা বা জন্মনিয়ন্ত্রণের
বিভিন্ন পদ্ধতি আছে।
গ্রহণকারী কোন পদ্ধতি নেবেন
তা বস্তুত একটি ব্যক্তিগত পছন্দের
ব্যাপার। একজন
গ্রহীতা সেবাদানকারীর কাছ থেকে তার
জন্য উপযোগী সব পদ্ধতির
বিস্তারিত, এমনকি পার্শ্ব-
প্রতিক্রিয়াসহ সব তথ্য
সঠিকভাবে জেনে নেবেন।
সেবাদানকারীর কাছ
থেকে পদ্ধতি গ্রহণের
ব্যাপারে সহায়তা নেবেন।
ইদানীং লক্ষ্য করা গেছে শিক্ষিত
বা সচ্ছল শ্রেণীর লোকদের সন্তান
সংখ্যা একটি বা দুটি।
অন্যদিকে অশিক্ষিত,
বস্তিবাসী কিংবা শ্রমিক শ্রেণীর
লোকদের
গড়ে পাঁচটি বা ছয়টি করে সন্তান।
ফলে দেশে এ শ্রেণীর
লোকসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে যা একটি
জাতির জন্য সুখকর নয়। তাই শিক্ষিত
বা সচ্ছল জনগোষ্ঠীর
পাশাপাশি অশিক্ষিত বা দরিদ্র
জনগোষ্ঠীকে পরিবার পরিকল্পনার
আওতায় আনতে হবে। পরিবার
পরিকল্পনা কার্যক্রমকে সার্থক
করতে এবং সর্বস্তরে এর
গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি ও
বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য সেবার মান
উন্নয়ন অপরিহার্য।
দ্রুত বর্ধনশীল সংখ্যার চাপে আমাদের
দেশে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
ব্যাহত হচ্ছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্হান,
শিক্ষা এবং স্বাস্হ্যের মতো মৌলিক
চাহিদাগুলো মেটাতেই হিমশিম
খেতে হচ্ছে রাষ্ট্রকে। এমতাবস্হায়
মানুষকে ছোট পরিবারের সুফল
সম্পর্কে বোঝাতে হবে।
জন্মনিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সামাজিক
পরিবর্তন আনতে হবে। উপযুক্ত
বয়সে বিয়ে করা, সমাজে পুরুষের
পাশাপাশি মহিলাদের অবস্হান উন্নত
করা, শিক্ষা, স্বাস্হ্য, কর্মসংস্হান,
বৃদ্ধ বয়সের নিরাপত্তা, সন্তানের
বাধ্যতামুলক শিক্ষা তথা অর্থনৈতিক
পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের মাথাপিছু
আয় বাড়াতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক
উন্নয়নই হচ্ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের
সর্বোত্তম পন্থা।
———————————

ডা. মুহাম্মদ কামরুজ্জামান খান
২০০৮-০৫-১৩
জনস্বাস্হ্য ও প্রিভেনন্টিভ মেডিসিন
বিশেষজ্ঞ
কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল
কলেজ

সূত্রঃ বাংলা হেলথ । শেয়ার করে আপনার বন্ধুদের কে জানার সুযোগ দিন । আপনি জেনেছেন হয়তো সে জানেনা । আমার ব্লগ বাড়ীতে বেড়াতে আসার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।সাথে থাকুন সব সময় ।আল্লাহ্ হাফেজ ।

কোন মন্তব্য নেই :