প্রেম যখন ঘাতক
কোন মন্তব্য নেই
‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল- অমিয়া সাগরে সিনান করিতে- সকলি গরল ভেল’ বাস্তবে পরিণত হয়েছে বর্তমানের প্রেমিক-প্রেমিকাদেরজন্য। প্রেমের মধ্যে বাড়ছে অবিশ্বাস আর সন্দেহ। হচ্ছে ত্রিভুজ প্রেম। পরকীয়ার জন্য ঘটছে হত্যাকাণ্ড। ঘটছে বিচ্ছেদ। বাড়ছে আত্মহত্যা। যে প্রেম স্বর্গ থেকে আসে সে প্রেমই এখন ঘাতকের ভূমিকা পালন করছে। গত কয়েক দিনে যে কয়জন আত্মহত্যা করেছে তার প্রায় সবকটি প্রেমে ব্যর্থ বা ত্রিভুজপ্রেমের কারণে। আরা আত্মহত্যার শিকার সবাই বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থী। আর প্রায় সবক’টি আত্মহত্যার পেছনে রয়েছে প্রেমসংক্রান্ত জটিলতা। হতাশাগ্রস্ত মানুষের মধ্যে কাউন্সিলিং করেন এমন প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ছাত্র-শিক্ষক পরামর্শ কেন্দ্র। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী পরমর্শ নেয় এ কেন্দ্র থেকে। যারা পরামর্শ নেন তাদের বেশিরভাগই প্রেমে ব্যর্থ হয়ে হতাশায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন পরামর্শদাতারা। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, গত কয়েক দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীআত্মহত্যা করেছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন- প্রেমসংক্রান্ত জটিলতা, আর্থিক সঙ্কট, পারিবারিক সমস্যা, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইতে না পারা, ভবিষ্যৎ নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা, বেকারত্ব প্রভৃতি কারণেমানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পেতে পারে। এ সমস্যা যখন নিজেরা সমাধানের পথ খোঁজে না পায় তখনই আত্মহত্যা করে। তারা বলেছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাউন্সিলিং বাড়াতে হবে। এর মাধ্যমেই আত্মহত্যার প্রবণতা কমানো সম্ভব। ৮ই অক্টোবর কুড়িগ্রাম শহরের একটি ছাত্রী মেস থেকে নুরুন্নাহার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ শ্রেণীর ছাত্রী সালমা বেগমের ঝুলন্ত লাশউদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ বলছে, ওই ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। পিতার গোপন বিয়ে মেনে নিতে না পেরে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী দিহান মেহজাবিন ওরফে রিদিতা ৯ই অক্টোবর আত্মহত্যা করে।ত্রিভুজ প্রেমের শিকার হয়েরাজধানীর আদমজী ক্যান্টেনমেন্টস্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র রাকিব হাসান ৮ই অক্টোবর ও উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রী নাফিজা আনজু ৯ই অক্টোবর আত্মহত্যা করে। ১২ই অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়েজিদ বোস্তামী কটেজের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র আজমীর হোসেন আত্মহত্যা করে। প্রেমসংক্রান্ত কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে সহপাঠীরা জানিয়েছেন। ১৪ই অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার শিল্পী বেগম (২৫) ও তেজগাঁও এলাকায় অজ্ঞাত পরিচয়ের এক নারী আত্মহত্যা করেন। ১৫ই অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাত্র প্রণব দাশ বাবলুর মৃতদেহ আজিমপুরের একটি বাসা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। বাবলু পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ১৯৯৯-২০০০ শিক্ষাবর্ষে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে সম্মান প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। শনিবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে শেখ সাহেব বাজার এলাকার শেফালি গার্ডেন নামে বাড়ির তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটেফাঁসিতে ঝুলন্ত অবস্থায় বাবলুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৯শে সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সেরছাত্র তাপস ঘোষ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। তিনি পূর্ব ভবনের ৩১১ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। তিনি মৃত্যুর আগে একটি চিরকুট লিখে গেছেন। তাতে লেখা আছে ‘আমি দীর্ঘদিন ধরেই মানসিক সমস্যায় ভুগছি। আর সহ্য করতে পারছি না। তাই আত্মহত্যা করলাম। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’। তার সহপাঠীরা বলেছেন, প্রেমসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে তাপস কিছুদিন ধরেই চিন্তিত ছিলেন। এজন্যই তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন বলে সহপাঠীদের ধারণা। ৩০শে সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যাকরেছেন। নিহত ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। মৃত্যুর আগে জান্নাতুলের ঘর থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়। ওই চিরকুটে লেখা ছিল, ‘কিরণ আমাকে বাঁচতে দিলো না’।তবে কিরণের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। একই তারিখে যশোরের কেশবপুর উপজেলার লক্ষ্মীনাথকাঠি গ্রামের নূর মোহাম্মদের দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করে।
শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শামীম ফেরদৌস করিম বলেন, যখন সমস্যা সমাধানের কোন উপায় থাকে না তখনই মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। কয়েক দিনের ব্যবধানে কয়েকজন ছাত্রী আত্মহত্যা করে। আমরা তখন হলগুলোতে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করি। এতে ফলাফল এসেছে।ছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক কমে গেছে। তিনি বলেন, তখন ছাত্র হলগুলোতেও পর্যায়ক্রমে কাউন্সিলিং করার কথা ছিল। এটা এখনই করা জরুরি। টিএসসিতে কাউন্সিলিং করা হয়। এটা খুবই উপকারী। অধ্যাপক করিম বলেন, মানুষ নানা রকম সমস্যায় পড়ে। যখনই দেখে তার সমাজে বেঁচে থেকে লাভ নেই। সমাজ তাকে গ্রহণ করছে না। সমাজে সে মুখ দেখাতে পারবে না। তখন সে মনে করে আত্মহত্যাই সমস্যা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ। তখনই সে আত্মহত্যা করে। তখন তাকে কাউন্সিলিং করা গেলে মৃত্যুর পথথেকে সে ফিরে আসবে। কাউন্সিলিং করায় অনেকে বেঁচে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ছাত্রনির্দেশনা ও পরামর্শ দপ্তরের সহকারী পরিচালক আশরাফুজ্জামান বাবুল বলেন, প্রতিদিন আমাদের কাছে ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী পরামর্শ নেন। পরামর্শের ফলে অনেক শিক্ষার্থীই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যান। তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল। সে কয়েকটি পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। আমাদের এখান থেকে পরামর্শ নিয়ে সে এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। তিনি জানান, টিএসসিতে কয়েক ধাপে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সমস্যা গোপন রাখা হয়। তিনি বলেন,অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের লোকজনকেও বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়।

কোন মন্তব্য নেই :