ইসলাম বিরোধিতাই প্রগতিশীলতা নয়

কোন মন্তব্য নেই
 ইসলাম বিরোধিতাই প্রগতিশীলতা নয়

ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী

সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর  প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪


‘প্রগতিশীল’ বলতে আমরা কী বুঝব? ‘ইসলাম বিরোধিতা’ই কি প্রগতিশীলতা? ইসলাম ধর্ম এবং মহানবীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এবং মুসলমান পরিচয় যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখাই কি আধুনিক ও প্রগতিশীল মননের পরিচায়ক?
‘ধর্মান্ধতা’ যেমন সমাজকে কুসংস্কার, অদৃষ্টবাদ ও অতীতচারিতায় আবদ্ধ করে স্থবির করে রাখে, তেমনি ‘অতি-প্রগতিশীল’ হতে গিয়ে ‘ধর্মবিদ্বেষী’ হয়ে ওঠাও কল্যাণ বয়ে আনে না। আমাদের জাতি গঠনের পথে তা বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। অবশ্য কেউ যদি মনে করেন ‘জাতি’ থাকবে কেন, আমরা তো ‘আন্তর্জাতিকতা’য় বিশ্বাসী; অথবা মনে করেন, সারা দুনিয়ার সব জাতি বা রাষ্ট্রের সীমানা তুলে দিয়ে একক বিশ্বমানবতার বিজয় কেতন ওড়ানোর জন্যই আমাদের সংগ্রাম; তাহলে বলার কিছু থাকে না। কিন্তু যদি আমরা বর্তমানকালের ‘জাতি-রাষ্ট্র’ভিত্তিক বিশ্ব সমাজকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই, তাহলে অংকটা ভিন্নতর হতে হবে।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ‘বিশ্বায়নে’র উচ্চকিত স্লোগান সত্ত্বেও আজকের দিনে বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরা ক্রমেই নিশ্ছিদ্র হয়ে উঠছে। জাতি-রাষ্ট্রের বিভাজন ও সীমান্ত রেখার এ নিশ্ছিদ্রকরণ বিশ্বমানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে নেতিবাচক মনে হতে পারে, তবে ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণ, সামাজিক শৃংখলা প্রবর্তন এবং ব্যক্তির জাগতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনে ‘জাতি-রাষ্ট্র’গুলোকে যথাসম্ভব স্বনির্ভর ও সক্ষম করে তোলার বিকল্প নেই। ভূমি ও জনশক্তির ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিকোণ থেকেও তা অপরিহার্য। এ অপরিহার্যতা আরও বেড়ে যায় যখন সীমিত সম্পদের সুষম বণ্টন এবং শক্তিমান জনগোষ্ঠী কর্তৃক দুর্বলতর জনগোষ্ঠীর সম্পদ লুণ্ঠনের অব্যাহত প্রক্রিয়া প্রতিহত করার বিষয়টি সামনে চলে আসে।
গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, কথিত ‘বিশ্বায়ন’ এবং তা থেকে উৎসারিত ‘মুক্তবাজার’ সবার জন্য পথচলা সমভাবে উন্মুক্ত করে না। এই ‘মুক্ত’ বাজারে মুষ্টিমেয় শক্তিমানের বিশ্বময় দাপিয়ে বেড়ানোর সুযোগ অবারিত হয়েছে বটে, কিন্তু তার বিপরীতে দুর্বলতর মানুষকে শক্তিমানের মাটিতে অন্তর্বাস খুলে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে (অতি সম্প্রতি এক ভারতীয় কূটনীতিকের দূরবস্থার বিষয়টি স্মর্তব্য)। এ অসম আদান-প্রদানকে ‘বিশ্বায়ন’ বলা পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের একমুখী প্রবাহকে ‘মুক্তবাজার’ আখ্যা দেয়াও সঠিক শব্দচয়ন নয়।
এ ‘বিশ্বায়ন’ ও ‘মুক্তবাজারে’র শেষ গন্তব্য পশ্চিমের কয়েকটি ধনকুবের দেশ। যাদের ধনের উৎস অতীতের সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসন। তারই নতুন সংস্করণ এই ‘বিশ্বায়ন’ ও ‘মুক্তবাজার’। যার সুরক্ষায় উদ্ভাবিত হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনীতির নয়া মূলমন্ত্র- ‘সভ্যতার সংঘাত’ (Clash of civilization)-এর সভ্যতাবিনাশী তত্ত্ব। মার্কিন নব্য-রক্ষণশীলতার (Neo-con) এ প্রেসক্রিপশন মেনে নিয়েই নির্ধারিত হয়েছে পশ্চিমা শক্তির নয়া রণকৌশল।
Clash of civilization তত্ত্বের উদ্গাতা হান্টিংটন একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বকে দেখেছেন ‘পশ্চিমা সভ্যতা’র বিপরীতে ‘ইসলামী সভ্যতা’র নিরবচ্ছিন্ন লড়াই হিসেবে। এ লড়াইয়ে তিনি চীনকে দেখেছেন সরাসরি ইসলামী সভ্যতার মিত্র হিসেবে। আর রাশিয়া (অর্থডক্স ক্রিশ্চিয়ানিটি) এবং ভারতকে রেখেছেন দুয়ের বাইরে ধূসর অবস্থানে। ১৯৯০ সালের দিকে প্রথম প্রচারিত এ তত্ত্বেরই আক্ষরিক প্রয়োগ দেখা গেছে বিগত দুই দশকে পশ্চিমা কূটনীতি ও রণনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে। যার প্রয়োগ শুরু হয়েছে ইরাককে দিয়ে। অতঃপর আফগানিস্তান, লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, পাকিস্তান- একে একে গোটা মুসলিম বিশ্ব। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা ইউরোপের দেশগুলোতে কোন দল বা কোন ক্ষমতাধর নেতা ক্ষমতায় থাকছেন তাতে হেরফের ঘটছে না।
আমাদের রাজনীতিতেও কি এর প্রভাব পড়ছে?
ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমের এ ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকাকে লক্ষ্য করে শুরু হলেও দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াও তার বাইরে আছে বলে মনে হয় না। সম্ভবত পশ্চিমকে সতর্ক করে দিতেই হান্টিংটন চীনকে ইসলামী সভ্যতার মিত্র এবং ভারতকে ‘গ্রে এরিয়া’ হিসেবে অনিশ্চিত অবস্থানে রেখেছেন। তাই পশ্চিমের তীক্ষè দৃষ্টি এখন এ দুটি দেশের দিকে। এ দুই দেশের সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্কের টানাপোড়েনে তার প্রতিফলন স্পষ্ট। এ দুই উদীয়মান পরাশক্তিকে ইসলাম ও মুসলমান থেকে দূরে সরিয়ে রাখা এখন যেন পশ্চিমের রণকৌশলের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে আছে। যার প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতেও পড়ছে বলে মনে হয়।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনো অর্থেই ইসলামবিরোধী দল নয়। অতীতে মার্ক্সবাদী রাজনীতি করেছেন এমন বেশ কিছু রাজনীতিক ও তাদের অনুসারীরা এ দলে যোগ দিয়েছেন। ধর্ম বিষয়ে তাদের কিছুটা উদাসীন থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে মূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ব্যক্তি জীবনে তাদের ধর্মীয় পরিচয় দৃঢ়তার সঙ্গেই ধারণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তার দৃষ্টান্ত। রাজনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র কথা জোরেশোরে বললেও।
কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বলয়ে অবস্থানকারী কিছু কিছু গোষ্ঠীর ‘ইসলাম বিদ্বেষ’ মোটেই অস্পষ্ট নয়। কেবল তা-ই নয়, এ দেশের ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে নিয়ে তাদের নানাবিধ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচি ও বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে আহত করে। যার মাশুল দিতে হয় আওয়ামী লীগকেই।
মৌলবাদী ধর্মাচার যারা পালন করেন না, এমনকি যারা ধর্মহীন জীবন দর্শনের অনুসারী, তাদের দিক থেকেও মুসলমান বা ইসলামের সঙ্গে অযথা সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি করা রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী। এর ফলে এ ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে কেবল যে সংশ্লিষ্ট দল-উপদল সম্পর্কে জনমনে বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠে তা-ই নয়, এ অপরিণামদর্শিতা দেশে কট্টর মৌলবাদের ভিত প্রসারিত করে। যা পরিণামে তথাকথিত ধর্মীয় ‘জঙ্গিবাদ’ বা ‘সন্ত্রাসবাদ’কে উস্কে দিয়ে হিতে বিপরীত ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশে এখন সেই পরিস্থিতিই বিরাজ করছে।
‘ধর্মান্ধতা’ বনাম ‘ধর্মবিদ্বেষ’
এখন বাংলাদেশে একদিকে কট্টর ‘ধর্মান্ধতা’ এবং অপরদিকে চরম ‘ধর্মবিদ্বেষ’ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এ ধর্মবিদ্বেষ কার্যক্ষেত্রে আবার শুধু ‘ইসলাম বিদ্বেষ’ (অন্য কোনো ধর্ম নয়)। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছু দল-উপদল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের পাশ কাটিয়ে ‘সংখ্যালঘু রাজনীতি’র চর্চায় অনেক সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করে থাকে। সংখ্যালঘুদের প্রতি সংবেদনশীল থাকা এবং তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার সংরক্ষণে সচেতন থাকা অবশ্যই উন্নত মনমানসিকতার পরিচায়ক। তবে জাতীয় রাজনীতিতে কোনো অর্থবহ অবদান রাখতে হলে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিন্তা-ভাবনা, পছন্দ-অপছন্দকে মূল্য দেয়া জরুরি। তাছাড়া কেউ যদি হতদরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করতে চান, তাহলেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর হতদরিদ্র মানুষের কথা ভুলে থাকলে চলবে কেন? সারা দেশের কথা থাক, শুধু এ ঢাকা শহরে যতজন মানুষ ফুটপাতে বা বস্তিতে অবাসযোগ্য পরিবেশে অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করে, তাদের সংখ্যা সম্ভবত সারা দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সব মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে। হতদরিদ্র মানুষ হিসেবে তাদেরও হিসাবে নিতে হবে। কেবল মুসলমান হওয়ার ‘অপরাধে’ তাদের হিসাবের বাইরে রেখে মানবতার কথা বলা যুক্তিসিদ্ধ নয়।
প্রয়োজন ‘হিন্দু-মুসলমানে’র ঐক্য
আরেকটি দিক থেকেও বিষয়টি ভাবতে হবে। বৃহত্তর মুসলমান জনগোষ্ঠী থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা কথিত ‘আদিবাসী’ সম্প্রদায়কে আলাদা করে রাখার বিপজ্জনক দিক এই যে, এতে করে একটি একক জাতীয় সত্তা গড়ে ওঠা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
দেশে একটি ‘হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ আছে। সদা সক্রিয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবেই তার পরিচয়। ইদানীং বিএনপির সমর্থক অনুরূপ আরেকটি সংগঠনও দেখা যাচ্ছে- ‘হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কল্যাণ ঐক্য ফ্রন্ট’। এ দুই সংগঠনের লক্ষ্য কী? এ দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের আলাদা করে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে কেন? কাদের প্রতিপক্ষে এ ঐক্য? সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুর ঐক্য?
মুুসলমানের বিরুদ্ধে দেশের সব অমুসলিম সম্প্রদায়কে একত্র করার এ প্রয়াসে যারা উৎসাহ যোগাচ্ছেন তাদের মধ্যে দু’ধরনের লোক থাকতে পারেন। প্রথমত, কেউ হয়তো যথার্থই মানবতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অথবা সংখ্যালঘু হিসেবে অবহেলিত কিংবা পিছিয়ে থাকা মানুষের কল্যাণ চিন্তা থেকেই এতে ব্রতী হয়েছেন। পাশাপাশি ভিন্ন কোনো এজেন্ডায় সংখ্যালঘুদের ব্যবহার করার উদ্দেশ্য নিয়েও এ কাজটি হতে পারে। বাংলাদেশের জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশের এসব ক্ষুদ্রতর জনগোষ্ঠীকে মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈরী অবস্থানে রাখার দূরভিসন্ধী থাকাও বিচিত্র নয়। আবার দুর্বলের সেবার নামে নিছক বৈষয়িক লাভের জন্য ‘প্রকল্প’ খাড়া করার লোকের অভাবও এ দেশে আছে বলে মনে হয় না।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের জনসমষ্টিতে ধর্মীয় বিভাজনে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় তা হাজার বছর ধরেই কমবেশি চলে আসছে।
অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা প্রায় সমান সমান ছিল। মুসলমানরা সংখ্যায় কিছুটা বেশি থাকলেও তাদের অধিকাংশই ছিল গ্রামীণ দরিদ্র কৃষক। ধন-সম্পদ, শিক্ষা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে হিন্দুরা ছিল অনেক এগিয়ে। বিশেষ করে আধুনিক বিদ্যাশিক্ষায় মুসলমানরা ছিল অনেক পিছিয়ে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত (১৯১২) ‘ব্রিটিশ ভারতের’ রাজধানী ছিল কলকাতা। সেখানে মুসলমানের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। ত্রিশের দশকে এসে কলকাতায় মুসলমানের সংখ্যা দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। আর তখনই হিন্দু সমাজপতিরা তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হওয়ার আশংকায় সংক্ষুব্ধ হতে থাকে। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনের অধীনে নির্বাচন হলে বাংলার বিধান সভায় মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিফলিত হতে থাকে। পরপর তিনজন প্রধানমন্ত্রীই হয়েছেন মুসলমান। ফলে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক-রেষারেষি রাজনৈতিক বিভাজনে রূপান্তরিত হয়। যে বাঙালি হিন্দু ১৯০৫ সালে ‘বঙ্গভঙ্গ’ বাতিল করার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, আÍঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ দিয়েছে, তারাই আবার বাংলা বিভাগের জন্য লড়তে শুরু করেন। ফলে ১৯৪৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে বাংলাকে ভাগ করা, না করার প্রশ্নে যখন ভোটাভুটি হয় তাতে মুসলমান সদস্যরা প্রায় সবাই যুক্ত বাংলার পক্ষে ভোট দেন, আর হিন্দু সদস্যদের প্রায় সবাই সাম্প্র্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলাকে ভাগ করার পক্ষে রায় দেন। ফলে মুসলমান সদস্যদের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও হিন্দু সদস্যদের ভোটে বাংলা বিভাগ কার্যকর হয়। মুসলমানদের জন্য পূর্ব বাংলা, আর হিন্দুদের জন্য পশ্চিম বাংলা নির্ধারিত হয়ে গেল। একটি গেল দিল্লির অধীনে, আরেকটি পাকিস্তানে। উপমহাদেশে বাংলার অগ্রবর্তী অবস্থানটি চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল।
এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পূর্ব বাংলার বাঙালি হিন্দুরা। তাদের পিতৃপুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে ভিন দেশে পাড়ি জমাতে হয় অবর্ণনীয় অত্যাচার ও দুঃখ-দুর্দশা মাথায় নিয়ে। যে পূর্ব বাংলায় একদা হিন্দুর জনসংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশের বেশি, আজকের বাংলাদেশে তা ১০ শতাংশের নিচে।
সেই ‘দেশ বিভাগ’কালীন বৈরিতার জের এখনও থেমে যায়নি। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশেও ধর্মীয় বিভাজনে মূল দ্বন্দ্ব হিন্দু ও মুসলমানের সেই বৈরিতা ও পারস্পরিক অবিশ্বাস। বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। সংখ্যালঘু হওয়ার বিড়ম্বনা থাকলেও তাদের নিয়ে সে রকম কোনো সংকট নেই।
তাই আজকের বাংলাদেশে যদি ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য আন্দোলন করতে হয়, তা হওয়া প্রয়োজন হিন্দু ও মুসলমানের সম্প্রীতির জন্য। প্রয়োজন ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্য’; হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের ঐক্য নয়। হিন্দু ও মুসলমানের দূরত্ব কমে এলেই এ দেশে এবং সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলজুড়ে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির নবদিগন্ত উন্মোচিত হবে।
বাংলাদেশই তা থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে।
শেষ কথা
বাংলাদেশে এখন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নামে যা হচ্ছে তাতে কার্যত ‘ইসলাম বিরোধিতা’র প্রবণতাই অধিক পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ আত্মঘাতী প্রবণতারও অবসান হওয়া অত্যাবশ্যক।
যারা ধর্মাচার পালন করেন না, তাদের ‘ধর্মবিরোধী’ হওয়ার প্রয়োজন নেই। ভালো হিন্দু, ভালো মুসলমান, ভালো বৌদ্ধ কিংবা ভালো খ্রিস্টান- পরস্পরকে দূরে সরিয়ে নয়, পরস্পরকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই কেবল যথার্থ ‘অসাম্প্রদায়িকতা’র চর্চা করতে পারেন।
‘ধর্মান্ধতা’ ও ‘ধর্মবিদ্বেষ’ কোনোটাই আধুনিকতা বা প্রগতিশীলতার ধারক হতে পারে না।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
shapshin@gtlbd.com
- See more at: http://www.jugantor.com/sub-editorial/2014/01/16/59206#sthash.wXnGEM7t.dpuf
ইসলাম বিরোধিতাই প্রগতিশীলতা নয়
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪

‘প্রগতিশীল’ বলতে আমরা কী বুঝব? ‘ইসলাম বিরোধিতা’ই কি প্রগতিশীলতা? ইসলাম ধর্ম এবং মহানবীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এবং মুসলমান পরিচয় যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখাই কি আধুনিক ও প্রগতিশীল মননের পরিচায়ক?
‘ধর্মান্ধতা’ যেমন সমাজকে কুসংস্কার, অদৃষ্টবাদ ও অতীতচারিতায় আবদ্ধ করে স্থবির করে রাখে, তেমনি ‘অতি-প্রগতিশীল’ হতে গিয়ে ‘ধর্মবিদ্বেষী’ হয়ে ওঠাও কল্যাণ বয়ে আনে না। আমাদের জাতি গঠনের পথে তা বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। অবশ্য কেউ যদি মনে করেন ‘জাতি’ থাকবে কেন, আমরা তো ‘আন্তর্জাতিকতা’য় বিশ্বাসী; অথবা মনে করেন, সারা দুনিয়ার সব জাতি বা রাষ্ট্রের সীমানা তুলে দিয়ে একক বিশ্বমানবতার বিজয় কেতন ওড়ানোর জন্যই আমাদের সংগ্রাম; তাহলে বলার কিছু থাকে না। কিন্তু যদি আমরা বর্তমানকালের ‘জাতি-রাষ্ট্র’ভিত্তিক বিশ্ব সমাজকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই, তাহলে অংকটা ভিন্নতর হতে হবে।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ‘বিশ্বায়নে’র উচ্চকিত স্লোগান সত্ত্বেও আজকের দিনে বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরা ক্রমেই নিশ্ছিদ্র হয়ে উঠছে। জাতি-রাষ্ট্রের বিভাজন ও সীমান্ত রেখার এ নিশ্ছিদ্রকরণ বিশ্বমানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে নেতিবাচক মনে হতে পারে, তবে ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণ, সামাজিক শৃংখলা প্রবর্তন এবং ব্যক্তির জাগতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনে ‘জাতি-রাষ্ট্র’গুলোকে যথাসম্ভব স্বনির্ভর ও সক্ষম করে তোলার বিকল্প নেই। ভূমি ও জনশক্তির ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিকোণ থেকেও তা অপরিহার্য। এ অপরিহার্যতা আরও বেড়ে যায় যখন সীমিত সম্পদের সুষম বণ্টন এবং শক্তিমান জনগোষ্ঠী কর্তৃক দুর্বলতর জনগোষ্ঠীর সম্পদ লুণ্ঠনের অব্যাহত প্রক্রিয়া প্রতিহত করার বিষয়টি সামনে চলে আসে।
গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, কথিত ‘বিশ্বায়ন’ এবং তা থেকে উৎসারিত ‘মুক্তবাজার’ সবার জন্য পথচলা সমভাবে উন্মুক্ত করে না। এই ‘মুক্ত’ বাজারে মুষ্টিমেয় শক্তিমানের বিশ্বময় দাপিয়ে বেড়ানোর সুযোগ অবারিত হয়েছে বটে, কিন্তু তার বিপরীতে দুর্বলতর মানুষকে শক্তিমানের মাটিতে অন্তর্বাস খুলে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে (অতি সম্প্রতি এক ভারতীয় কূটনীতিকের দূরবস্থার বিষয়টি স্মর্তব্য)। এ অসম আদান-প্রদানকে ‘বিশ্বায়ন’ বলা পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের একমুখী প্রবাহকে ‘মুক্তবাজার’ আখ্যা দেয়াও সঠিক শব্দচয়ন নয়।
এ ‘বিশ্বায়ন’ ও ‘মুক্তবাজারে’র শেষ গন্তব্য পশ্চিমের কয়েকটি ধনকুবের দেশ। যাদের ধনের উৎস অতীতের সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসন। তারই নতুন সংস্করণ এই ‘বিশ্বায়ন’ ও ‘মুক্তবাজার’। যার সুরক্ষায় উদ্ভাবিত হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনীতির নয়া মূলমন্ত্র- ‘সভ্যতার সংঘাত’ (Clash of civilization)-এর সভ্যতাবিনাশী তত্ত্ব। মার্কিন নব্য-রক্ষণশীলতার (Neo-con) এ প্রেসক্রিপশন মেনে নিয়েই নির্ধারিত হয়েছে পশ্চিমা শক্তির নয়া রণকৌশল।
Clash of civilization তত্ত্বের উদ্গাতা হান্টিংটন একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বকে দেখেছেন ‘পশ্চিমা সভ্যতা’র বিপরীতে ‘ইসলামী সভ্যতা’র নিরবচ্ছিন্ন লড়াই হিসেবে। এ লড়াইয়ে তিনি চীনকে দেখেছেন সরাসরি ইসলামী সভ্যতার মিত্র হিসেবে। আর রাশিয়া (অর্থডক্স ক্রিশ্চিয়ানিটি) এবং ভারতকে রেখেছেন দুয়ের বাইরে ধূসর অবস্থানে। ১৯৯০ সালের দিকে প্রথম প্রচারিত এ তত্ত্বেরই আক্ষরিক প্রয়োগ দেখা গেছে বিগত দুই দশকে পশ্চিমা কূটনীতি ও রণনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে। যার প্রয়োগ শুরু হয়েছে ইরাককে দিয়ে। অতঃপর আফগানিস্তান, লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, পাকিস্তান- একে একে গোটা মুসলিম বিশ্ব। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা ইউরোপের দেশগুলোতে কোন দল বা কোন ক্ষমতাধর নেতা ক্ষমতায় থাকছেন তাতে হেরফের ঘটছে না।
আমাদের রাজনীতিতেও কি এর প্রভাব পড়ছে?
ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমের এ ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকাকে লক্ষ্য করে শুরু হলেও দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াও তার বাইরে আছে বলে মনে হয় না। সম্ভবত পশ্চিমকে সতর্ক করে দিতেই হান্টিংটন চীনকে ইসলামী সভ্যতার মিত্র এবং ভারতকে ‘গ্রে এরিয়া’ হিসেবে অনিশ্চিত অবস্থানে রেখেছেন। তাই পশ্চিমের তীক্ষè দৃষ্টি এখন এ দুটি দেশের দিকে। এ দুই দেশের সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্কের টানাপোড়েনে তার প্রতিফলন স্পষ্ট। এ দুই উদীয়মান পরাশক্তিকে ইসলাম ও মুসলমান থেকে দূরে সরিয়ে রাখা এখন যেন পশ্চিমের রণকৌশলের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে আছে। যার প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতেও পড়ছে বলে মনে হয়।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনো অর্থেই ইসলামবিরোধী দল নয়। অতীতে মার্ক্সবাদী রাজনীতি করেছেন এমন বেশ কিছু রাজনীতিক ও তাদের অনুসারীরা এ দলে যোগ দিয়েছেন। ধর্ম বিষয়ে তাদের কিছুটা উদাসীন থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে মূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ব্যক্তি জীবনে তাদের ধর্মীয় পরিচয় দৃঢ়তার সঙ্গেই ধারণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তার দৃষ্টান্ত। রাজনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র কথা জোরেশোরে বললেও।
কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বলয়ে অবস্থানকারী কিছু কিছু গোষ্ঠীর ‘ইসলাম বিদ্বেষ’ মোটেই অস্পষ্ট নয়। কেবল তা-ই নয়, এ দেশের ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে নিয়ে তাদের নানাবিধ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচি ও বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে আহত করে। যার মাশুল দিতে হয় আওয়ামী লীগকেই।
মৌলবাদী ধর্মাচার যারা পালন করেন না, এমনকি যারা ধর্মহীন জীবন দর্শনের অনুসারী, তাদের দিক থেকেও মুসলমান বা ইসলামের সঙ্গে অযথা সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি করা রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী। এর ফলে এ ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে কেবল যে সংশ্লিষ্ট দল-উপদল সম্পর্কে জনমনে বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠে তা-ই নয়, এ অপরিণামদর্শিতা দেশে কট্টর মৌলবাদের ভিত প্রসারিত করে। যা পরিণামে তথাকথিত ধর্মীয় ‘জঙ্গিবাদ’ বা ‘সন্ত্রাসবাদ’কে উস্কে দিয়ে হিতে বিপরীত ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশে এখন সেই পরিস্থিতিই বিরাজ করছে।
‘ধর্মান্ধতা’ বনাম ‘ধর্মবিদ্বেষ’
এখন বাংলাদেশে একদিকে কট্টর ‘ধর্মান্ধতা’ এবং অপরদিকে চরম ‘ধর্মবিদ্বেষ’ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এ ধর্মবিদ্বেষ কার্যক্ষেত্রে আবার শুধু ‘ইসলাম বিদ্বেষ’ (অন্য কোনো ধর্ম নয়)। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছু দল-উপদল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের পাশ কাটিয়ে ‘সংখ্যালঘু রাজনীতি’র চর্চায় অনেক সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করে থাকে। সংখ্যালঘুদের প্রতি সংবেদনশীল থাকা এবং তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার সংরক্ষণে সচেতন থাকা অবশ্যই উন্নত মনমানসিকতার পরিচায়ক। তবে জাতীয় রাজনীতিতে কোনো অর্থবহ অবদান রাখতে হলে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিন্তা-ভাবনা, পছন্দ-অপছন্দকে মূল্য দেয়া জরুরি। তাছাড়া কেউ যদি হতদরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করতে চান, তাহলেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর হতদরিদ্র মানুষের কথা ভুলে থাকলে চলবে কেন? সারা দেশের কথা থাক, শুধু এ ঢাকা শহরে যতজন মানুষ ফুটপাতে বা বস্তিতে অবাসযোগ্য পরিবেশে অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করে, তাদের সংখ্যা সম্ভবত সারা দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সব মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে। হতদরিদ্র মানুষ হিসেবে তাদেরও হিসাবে নিতে হবে। কেবল মুসলমান হওয়ার ‘অপরাধে’ তাদের হিসাবের বাইরে রেখে মানবতার কথা বলা যুক্তিসিদ্ধ নয়।
প্রয়োজন ‘হিন্দু-মুসলমানে’র ঐক্য
আরেকটি দিক থেকেও বিষয়টি ভাবতে হবে। বৃহত্তর মুসলমান জনগোষ্ঠী থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা কথিত ‘আদিবাসী’ সম্প্রদায়কে আলাদা করে রাখার বিপজ্জনক দিক এই যে, এতে করে একটি একক জাতীয় সত্তা গড়ে ওঠা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
দেশে একটি ‘হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ আছে। সদা সক্রিয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবেই তার পরিচয়। ইদানীং বিএনপির সমর্থক অনুরূপ আরেকটি সংগঠনও দেখা যাচ্ছে- ‘হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কল্যাণ ঐক্য ফ্রন্ট’। এ দুই সংগঠনের লক্ষ্য কী? এ দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের আলাদা করে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে কেন? কাদের প্রতিপক্ষে এ ঐক্য? সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুর ঐক্য?
মুুসলমানের বিরুদ্ধে দেশের সব অমুসলিম সম্প্রদায়কে একত্র করার এ প্রয়াসে যারা উৎসাহ যোগাচ্ছেন তাদের মধ্যে দু’ধরনের লোক থাকতে পারেন। প্রথমত, কেউ হয়তো যথার্থই মানবতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অথবা সংখ্যালঘু হিসেবে অবহেলিত কিংবা পিছিয়ে থাকা মানুষের কল্যাণ চিন্তা থেকেই এতে ব্রতী হয়েছেন। পাশাপাশি ভিন্ন কোনো এজেন্ডায় সংখ্যালঘুদের ব্যবহার করার উদ্দেশ্য নিয়েও এ কাজটি হতে পারে। বাংলাদেশের জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশের এসব ক্ষুদ্রতর জনগোষ্ঠীকে মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈরী অবস্থানে রাখার দূরভিসন্ধী থাকাও বিচিত্র নয়। আবার দুর্বলের সেবার নামে নিছক বৈষয়িক লাভের জন্য ‘প্রকল্প’ খাড়া করার লোকের অভাবও এ দেশে আছে বলে মনে হয় না।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের জনসমষ্টিতে ধর্মীয় বিভাজনে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় তা হাজার বছর ধরেই কমবেশি চলে আসছে।
অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা প্রায় সমান সমান ছিল। মুসলমানরা সংখ্যায় কিছুটা বেশি থাকলেও তাদের অধিকাংশই ছিল গ্রামীণ দরিদ্র কৃষক। ধন-সম্পদ, শিক্ষা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে হিন্দুরা ছিল অনেক এগিয়ে। বিশেষ করে আধুনিক বিদ্যাশিক্ষায় মুসলমানরা ছিল অনেক পিছিয়ে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত (১৯১২) ‘ব্রিটিশ ভারতের’ রাজধানী ছিল কলকাতা। সেখানে মুসলমানের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। ত্রিশের দশকে এসে কলকাতায় মুসলমানের সংখ্যা দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। আর তখনই হিন্দু সমাজপতিরা তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হওয়ার আশংকায় সংক্ষুব্ধ হতে থাকে। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনের অধীনে নির্বাচন হলে বাংলার বিধান সভায় মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিফলিত হতে থাকে। পরপর তিনজন প্রধানমন্ত্রীই হয়েছেন মুসলমান। ফলে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক-রেষারেষি রাজনৈতিক বিভাজনে রূপান্তরিত হয়। যে বাঙালি হিন্দু ১৯০৫ সালে ‘বঙ্গভঙ্গ’ বাতিল করার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, আÍঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ দিয়েছে, তারাই আবার বাংলা বিভাগের জন্য লড়তে শুরু করেন। ফলে ১৯৪৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে বাংলাকে ভাগ করা, না করার প্রশ্নে যখন ভোটাভুটি হয় তাতে মুসলমান সদস্যরা প্রায় সবাই যুক্ত বাংলার পক্ষে ভোট দেন, আর হিন্দু সদস্যদের প্রায় সবাই সাম্প্র্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলাকে ভাগ করার পক্ষে রায় দেন। ফলে মুসলমান সদস্যদের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও হিন্দু সদস্যদের ভোটে বাংলা বিভাগ কার্যকর হয়। মুসলমানদের জন্য পূর্ব বাংলা, আর হিন্দুদের জন্য পশ্চিম বাংলা নির্ধারিত হয়ে গেল। একটি গেল দিল্লির অধীনে, আরেকটি পাকিস্তানে। উপমহাদেশে বাংলার অগ্রবর্তী অবস্থানটি চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল।
এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পূর্ব বাংলার বাঙালি হিন্দুরা। তাদের পিতৃপুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে ভিন দেশে পাড়ি জমাতে হয় অবর্ণনীয় অত্যাচার ও দুঃখ-দুর্দশা মাথায় নিয়ে। যে পূর্ব বাংলায় একদা হিন্দুর জনসংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশের বেশি, আজকের বাংলাদেশে তা ১০ শতাংশের নিচে।
সেই ‘দেশ বিভাগ’কালীন বৈরিতার জের এখনও থেমে যায়নি। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশেও ধর্মীয় বিভাজনে মূল দ্বন্দ্ব হিন্দু ও মুসলমানের সেই বৈরিতা ও পারস্পরিক অবিশ্বাস। বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। সংখ্যালঘু হওয়ার বিড়ম্বনা থাকলেও তাদের নিয়ে সে রকম কোনো সংকট নেই।
তাই আজকের বাংলাদেশে যদি ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য আন্দোলন করতে হয়, তা হওয়া প্রয়োজন হিন্দু ও মুসলমানের সম্প্রীতির জন্য। প্রয়োজন ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্য’; হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের ঐক্য নয়। হিন্দু ও মুসলমানের দূরত্ব কমে এলেই এ দেশে এবং সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলজুড়ে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির নবদিগন্ত উন্মোচিত হবে।
বাংলাদেশই তা থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে।
শেষ কথা
বাংলাদেশে এখন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নামে যা হচ্ছে তাতে কার্যত ‘ইসলাম বিরোধিতা’র প্রবণতাই অধিক পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ আত্মঘাতী প্রবণতারও অবসান হওয়া অত্যাবশ্যক।
যারা ধর্মাচার পালন করেন না, তাদের ‘ধর্মবিরোধী’ হওয়ার প্রয়োজন নেই। ভালো হিন্দু, ভালো মুসলমান, ভালো বৌদ্ধ কিংবা ভালো খ্রিস্টান- পরস্পরকে দূরে সরিয়ে নয়, পরস্পরকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই কেবল যথার্থ ‘অসাম্প্রদায়িকতা’র চর্চা করতে পারেন।
‘ধর্মান্ধতা’ ও ‘ধর্মবিদ্বেষ’ কোনোটাই আধুনিকতা বা প্রগতিশীলতার ধারক হতে পারে না।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
shapshin@gtlbd.com
- See more at: http://www.jugantor.com/sub-editorial/2014/01/16/59206#sthash.wXnGEM7t.dpuf
ইসলাম বিরোধিতাই প্রগতিশীলতা নয়
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪

‘প্রগতিশীল’ বলতে আমরা কী বুঝব? ‘ইসলাম বিরোধিতা’ই কি প্রগতিশীলতা? ইসলাম ধর্ম এবং মহানবীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এবং মুসলমান পরিচয় যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখাই কি আধুনিক ও প্রগতিশীল মননের পরিচায়ক?
‘ধর্মান্ধতা’ যেমন সমাজকে কুসংস্কার, অদৃষ্টবাদ ও অতীতচারিতায় আবদ্ধ করে স্থবির করে রাখে, তেমনি ‘অতি-প্রগতিশীল’ হতে গিয়ে ‘ধর্মবিদ্বেষী’ হয়ে ওঠাও কল্যাণ বয়ে আনে না। আমাদের জাতি গঠনের পথে তা বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। অবশ্য কেউ যদি মনে করেন ‘জাতি’ থাকবে কেন, আমরা তো ‘আন্তর্জাতিকতা’য় বিশ্বাসী; অথবা মনে করেন, সারা দুনিয়ার সব জাতি বা রাষ্ট্রের সীমানা তুলে দিয়ে একক বিশ্বমানবতার বিজয় কেতন ওড়ানোর জন্যই আমাদের সংগ্রাম; তাহলে বলার কিছু থাকে না। কিন্তু যদি আমরা বর্তমানকালের ‘জাতি-রাষ্ট্র’ভিত্তিক বিশ্ব সমাজকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই, তাহলে অংকটা ভিন্নতর হতে হবে।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ‘বিশ্বায়নে’র উচ্চকিত স্লোগান সত্ত্বেও আজকের দিনে বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরা ক্রমেই নিশ্ছিদ্র হয়ে উঠছে। জাতি-রাষ্ট্রের বিভাজন ও সীমান্ত রেখার এ নিশ্ছিদ্রকরণ বিশ্বমানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে নেতিবাচক মনে হতে পারে, তবে ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণ, সামাজিক শৃংখলা প্রবর্তন এবং ব্যক্তির জাগতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনে ‘জাতি-রাষ্ট্র’গুলোকে যথাসম্ভব স্বনির্ভর ও সক্ষম করে তোলার বিকল্প নেই। ভূমি ও জনশক্তির ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিকোণ থেকেও তা অপরিহার্য। এ অপরিহার্যতা আরও বেড়ে যায় যখন সীমিত সম্পদের সুষম বণ্টন এবং শক্তিমান জনগোষ্ঠী কর্তৃক দুর্বলতর জনগোষ্ঠীর সম্পদ লুণ্ঠনের অব্যাহত প্রক্রিয়া প্রতিহত করার বিষয়টি সামনে চলে আসে।
গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, কথিত ‘বিশ্বায়ন’ এবং তা থেকে উৎসারিত ‘মুক্তবাজার’ সবার জন্য পথচলা সমভাবে উন্মুক্ত করে না। এই ‘মুক্ত’ বাজারে মুষ্টিমেয় শক্তিমানের বিশ্বময় দাপিয়ে বেড়ানোর সুযোগ অবারিত হয়েছে বটে, কিন্তু তার বিপরীতে দুর্বলতর মানুষকে শক্তিমানের মাটিতে অন্তর্বাস খুলে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে (অতি সম্প্রতি এক ভারতীয় কূটনীতিকের দূরবস্থার বিষয়টি স্মর্তব্য)। এ অসম আদান-প্রদানকে ‘বিশ্বায়ন’ বলা পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের একমুখী প্রবাহকে ‘মুক্তবাজার’ আখ্যা দেয়াও সঠিক শব্দচয়ন নয়।
এ ‘বিশ্বায়ন’ ও ‘মুক্তবাজারে’র শেষ গন্তব্য পশ্চিমের কয়েকটি ধনকুবের দেশ। যাদের ধনের উৎস অতীতের সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসন। তারই নতুন সংস্করণ এই ‘বিশ্বায়ন’ ও ‘মুক্তবাজার’। যার সুরক্ষায় উদ্ভাবিত হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনীতির নয়া মূলমন্ত্র- ‘সভ্যতার সংঘাত’ (Clash of civilization)-এর সভ্যতাবিনাশী তত্ত্ব। মার্কিন নব্য-রক্ষণশীলতার (Neo-con) এ প্রেসক্রিপশন মেনে নিয়েই নির্ধারিত হয়েছে পশ্চিমা শক্তির নয়া রণকৌশল।
Clash of civilization তত্ত্বের উদ্গাতা হান্টিংটন একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বকে দেখেছেন ‘পশ্চিমা সভ্যতা’র বিপরীতে ‘ইসলামী সভ্যতা’র নিরবচ্ছিন্ন লড়াই হিসেবে। এ লড়াইয়ে তিনি চীনকে দেখেছেন সরাসরি ইসলামী সভ্যতার মিত্র হিসেবে। আর রাশিয়া (অর্থডক্স ক্রিশ্চিয়ানিটি) এবং ভারতকে রেখেছেন দুয়ের বাইরে ধূসর অবস্থানে। ১৯৯০ সালের দিকে প্রথম প্রচারিত এ তত্ত্বেরই আক্ষরিক প্রয়োগ দেখা গেছে বিগত দুই দশকে পশ্চিমা কূটনীতি ও রণনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে। যার প্রয়োগ শুরু হয়েছে ইরাককে দিয়ে। অতঃপর আফগানিস্তান, লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, পাকিস্তান- একে একে গোটা মুসলিম বিশ্ব। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা ইউরোপের দেশগুলোতে কোন দল বা কোন ক্ষমতাধর নেতা ক্ষমতায় থাকছেন তাতে হেরফের ঘটছে না।
আমাদের রাজনীতিতেও কি এর প্রভাব পড়ছে?
ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমের এ ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকাকে লক্ষ্য করে শুরু হলেও দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াও তার বাইরে আছে বলে মনে হয় না। সম্ভবত পশ্চিমকে সতর্ক করে দিতেই হান্টিংটন চীনকে ইসলামী সভ্যতার মিত্র এবং ভারতকে ‘গ্রে এরিয়া’ হিসেবে অনিশ্চিত অবস্থানে রেখেছেন। তাই পশ্চিমের তীক্ষè দৃষ্টি এখন এ দুটি দেশের দিকে। এ দুই দেশের সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্কের টানাপোড়েনে তার প্রতিফলন স্পষ্ট। এ দুই উদীয়মান পরাশক্তিকে ইসলাম ও মুসলমান থেকে দূরে সরিয়ে রাখা এখন যেন পশ্চিমের রণকৌশলের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে আছে। যার প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতেও পড়ছে বলে মনে হয়।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনো অর্থেই ইসলামবিরোধী দল নয়। অতীতে মার্ক্সবাদী রাজনীতি করেছেন এমন বেশ কিছু রাজনীতিক ও তাদের অনুসারীরা এ দলে যোগ দিয়েছেন। ধর্ম বিষয়ে তাদের কিছুটা উদাসীন থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে মূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ব্যক্তি জীবনে তাদের ধর্মীয় পরিচয় দৃঢ়তার সঙ্গেই ধারণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তার দৃষ্টান্ত। রাজনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র কথা জোরেশোরে বললেও।
কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বলয়ে অবস্থানকারী কিছু কিছু গোষ্ঠীর ‘ইসলাম বিদ্বেষ’ মোটেই অস্পষ্ট নয়। কেবল তা-ই নয়, এ দেশের ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে নিয়ে তাদের নানাবিধ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচি ও বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে আহত করে। যার মাশুল দিতে হয় আওয়ামী লীগকেই।
মৌলবাদী ধর্মাচার যারা পালন করেন না, এমনকি যারা ধর্মহীন জীবন দর্শনের অনুসারী, তাদের দিক থেকেও মুসলমান বা ইসলামের সঙ্গে অযথা সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি করা রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী। এর ফলে এ ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে কেবল যে সংশ্লিষ্ট দল-উপদল সম্পর্কে জনমনে বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠে তা-ই নয়, এ অপরিণামদর্শিতা দেশে কট্টর মৌলবাদের ভিত প্রসারিত করে। যা পরিণামে তথাকথিত ধর্মীয় ‘জঙ্গিবাদ’ বা ‘সন্ত্রাসবাদ’কে উস্কে দিয়ে হিতে বিপরীত ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশে এখন সেই পরিস্থিতিই বিরাজ করছে।
‘ধর্মান্ধতা’ বনাম ‘ধর্মবিদ্বেষ’
এখন বাংলাদেশে একদিকে কট্টর ‘ধর্মান্ধতা’ এবং অপরদিকে চরম ‘ধর্মবিদ্বেষ’ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এ ধর্মবিদ্বেষ কার্যক্ষেত্রে আবার শুধু ‘ইসলাম বিদ্বেষ’ (অন্য কোনো ধর্ম নয়)। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছু দল-উপদল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের পাশ কাটিয়ে ‘সংখ্যালঘু রাজনীতি’র চর্চায় অনেক সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করে থাকে। সংখ্যালঘুদের প্রতি সংবেদনশীল থাকা এবং তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার সংরক্ষণে সচেতন থাকা অবশ্যই উন্নত মনমানসিকতার পরিচায়ক। তবে জাতীয় রাজনীতিতে কোনো অর্থবহ অবদান রাখতে হলে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিন্তা-ভাবনা, পছন্দ-অপছন্দকে মূল্য দেয়া জরুরি। তাছাড়া কেউ যদি হতদরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করতে চান, তাহলেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর হতদরিদ্র মানুষের কথা ভুলে থাকলে চলবে কেন? সারা দেশের কথা থাক, শুধু এ ঢাকা শহরে যতজন মানুষ ফুটপাতে বা বস্তিতে অবাসযোগ্য পরিবেশে অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করে, তাদের সংখ্যা সম্ভবত সারা দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সব মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে। হতদরিদ্র মানুষ হিসেবে তাদেরও হিসাবে নিতে হবে। কেবল মুসলমান হওয়ার ‘অপরাধে’ তাদের হিসাবের বাইরে রেখে মানবতার কথা বলা যুক্তিসিদ্ধ নয়।
প্রয়োজন ‘হিন্দু-মুসলমানে’র ঐক্য
আরেকটি দিক থেকেও বিষয়টি ভাবতে হবে। বৃহত্তর মুসলমান জনগোষ্ঠী থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা কথিত ‘আদিবাসী’ সম্প্রদায়কে আলাদা করে রাখার বিপজ্জনক দিক এই যে, এতে করে একটি একক জাতীয় সত্তা গড়ে ওঠা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
দেশে একটি ‘হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ আছে। সদা সক্রিয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবেই তার পরিচয়। ইদানীং বিএনপির সমর্থক অনুরূপ আরেকটি সংগঠনও দেখা যাচ্ছে- ‘হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কল্যাণ ঐক্য ফ্রন্ট’। এ দুই সংগঠনের লক্ষ্য কী? এ দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের আলাদা করে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে কেন? কাদের প্রতিপক্ষে এ ঐক্য? সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুর ঐক্য?
মুুসলমানের বিরুদ্ধে দেশের সব অমুসলিম সম্প্রদায়কে একত্র করার এ প্রয়াসে যারা উৎসাহ যোগাচ্ছেন তাদের মধ্যে দু’ধরনের লোক থাকতে পারেন। প্রথমত, কেউ হয়তো যথার্থই মানবতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অথবা সংখ্যালঘু হিসেবে অবহেলিত কিংবা পিছিয়ে থাকা মানুষের কল্যাণ চিন্তা থেকেই এতে ব্রতী হয়েছেন। পাশাপাশি ভিন্ন কোনো এজেন্ডায় সংখ্যালঘুদের ব্যবহার করার উদ্দেশ্য নিয়েও এ কাজটি হতে পারে। বাংলাদেশের জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশের এসব ক্ষুদ্রতর জনগোষ্ঠীকে মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈরী অবস্থানে রাখার দূরভিসন্ধী থাকাও বিচিত্র নয়। আবার দুর্বলের সেবার নামে নিছক বৈষয়িক লাভের জন্য ‘প্রকল্প’ খাড়া করার লোকের অভাবও এ দেশে আছে বলে মনে হয় না।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের জনসমষ্টিতে ধর্মীয় বিভাজনে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় তা হাজার বছর ধরেই কমবেশি চলে আসছে।
অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা প্রায় সমান সমান ছিল। মুসলমানরা সংখ্যায় কিছুটা বেশি থাকলেও তাদের অধিকাংশই ছিল গ্রামীণ দরিদ্র কৃষক। ধন-সম্পদ, শিক্ষা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে হিন্দুরা ছিল অনেক এগিয়ে। বিশেষ করে আধুনিক বিদ্যাশিক্ষায় মুসলমানরা ছিল অনেক পিছিয়ে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত (১৯১২) ‘ব্রিটিশ ভারতের’ রাজধানী ছিল কলকাতা। সেখানে মুসলমানের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। ত্রিশের দশকে এসে কলকাতায় মুসলমানের সংখ্যা দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। আর তখনই হিন্দু সমাজপতিরা তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হওয়ার আশংকায় সংক্ষুব্ধ হতে থাকে। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনের অধীনে নির্বাচন হলে বাংলার বিধান সভায় মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিফলিত হতে থাকে। পরপর তিনজন প্রধানমন্ত্রীই হয়েছেন মুসলমান। ফলে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক-রেষারেষি রাজনৈতিক বিভাজনে রূপান্তরিত হয়। যে বাঙালি হিন্দু ১৯০৫ সালে ‘বঙ্গভঙ্গ’ বাতিল করার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, আÍঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ দিয়েছে, তারাই আবার বাংলা বিভাগের জন্য লড়তে শুরু করেন। ফলে ১৯৪৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে বাংলাকে ভাগ করা, না করার প্রশ্নে যখন ভোটাভুটি হয় তাতে মুসলমান সদস্যরা প্রায় সবাই যুক্ত বাংলার পক্ষে ভোট দেন, আর হিন্দু সদস্যদের প্রায় সবাই সাম্প্র্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলাকে ভাগ করার পক্ষে রায় দেন। ফলে মুসলমান সদস্যদের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও হিন্দু সদস্যদের ভোটে বাংলা বিভাগ কার্যকর হয়। মুসলমানদের জন্য পূর্ব বাংলা, আর হিন্দুদের জন্য পশ্চিম বাংলা নির্ধারিত হয়ে গেল। একটি গেল দিল্লির অধীনে, আরেকটি পাকিস্তানে। উপমহাদেশে বাংলার অগ্রবর্তী অবস্থানটি চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল।
এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পূর্ব বাংলার বাঙালি হিন্দুরা। তাদের পিতৃপুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে ভিন দেশে পাড়ি জমাতে হয় অবর্ণনীয় অত্যাচার ও দুঃখ-দুর্দশা মাথায় নিয়ে। যে পূর্ব বাংলায় একদা হিন্দুর জনসংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশের বেশি, আজকের বাংলাদেশে তা ১০ শতাংশের নিচে।
সেই ‘দেশ বিভাগ’কালীন বৈরিতার জের এখনও থেমে যায়নি। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশেও ধর্মীয় বিভাজনে মূল দ্বন্দ্ব হিন্দু ও মুসলমানের সেই বৈরিতা ও পারস্পরিক অবিশ্বাস। বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। সংখ্যালঘু হওয়ার বিড়ম্বনা থাকলেও তাদের নিয়ে সে রকম কোনো সংকট নেই।
তাই আজকের বাংলাদেশে যদি ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য আন্দোলন করতে হয়, তা হওয়া প্রয়োজন হিন্দু ও মুসলমানের সম্প্রীতির জন্য। প্রয়োজন ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্য’; হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের ঐক্য নয়। হিন্দু ও মুসলমানের দূরত্ব কমে এলেই এ দেশে এবং সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলজুড়ে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির নবদিগন্ত উন্মোচিত হবে।
বাংলাদেশই তা থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে।
শেষ কথা
বাংলাদেশে এখন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নামে যা হচ্ছে তাতে কার্যত ‘ইসলাম বিরোধিতা’র প্রবণতাই অধিক পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ আত্মঘাতী প্রবণতারও অবসান হওয়া অত্যাবশ্যক।
যারা ধর্মাচার পালন করেন না, তাদের ‘ধর্মবিরোধী’ হওয়ার প্রয়োজন নেই। ভালো হিন্দু, ভালো মুসলমান, ভালো বৌদ্ধ কিংবা ভালো খ্রিস্টান- পরস্পরকে দূরে সরিয়ে নয়, পরস্পরকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই কেবল যথার্থ ‘অসাম্প্রদায়িকতা’র চর্চা করতে পারেন।
‘ধর্মান্ধতা’ ও ‘ধর্মবিদ্বেষ’ কোনোটাই আধুনিকতা বা প্রগতিশীলতার ধারক হতে পারে না।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
shapshin@gtlbd.com
- See more at: http://www.jugantor.com/sub-editorial/2014/01/16/59206#sthash.wXnGEM7t.dpuf


 বিষয় সমূহঃ >আল কোরআন/আরবী থেকে-বাংলা-ইংরেজী সহ<+>ইসলাম< +>আদর্শ নারী Adarsha Nari <+>নারী পুরুষের যৌন সমস্যা সমাধান<+>নারীস্বাস্থ্য সমস্যা ও পরামর্শ<+>মাসিক মনোজগত<+>যৌন শিক্ষা/যৌন মিলন/জন্মনিয়ন্ত্রন<+>ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য ও মধুর মিলন।<+>কামসূত্র (সংক্ষিপ্ত)<+>দাম্পত্য জীবন/বিবাহ<+>কারবালার করুণ ইতিহাস<+>ডাঃজাকির নায়েকের লেকচার।<+>কম্পিউটার/মোবাইল/ইন্টারনেট<+>সর্বাধিক পঠিত<+>সোনা মনিদের মজার মজার গল্পের ভাণ্ডার(আন লিমিটেড)<+>হাসির দুনিয়া -কৌতুক এবং জোকস(আন লিমিটেড)<+>এই পোস্ট গুলি কি আপনি পড়েছেন?<+>আমাদের রাজনিতি/মিডিয়া <



আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুণ।

 এই ব্লগে পড়তে কি সমস্যা হয়?আপনার কি টাকা বেশি খরচ হয়ে যায়?

কোন মন্তব্য নেই :