নবজাতকের যত্ন

কোন মন্তব্য নেই

নবজাতক, শিশু ও শিশু স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ
প্রথম মাতৃত্বের স্বাদই আলাদা। তাতে মিশে থাকে নিজের গর্ভজাত সন্তানটিকে বারবার ছুঁয়েদেখার আনন্দ। তাকে তিল তিল করে বড় করে তোলার স্বপ্ন। সেই সঙ্গে থাকে অনভিজ্ঞতাজনিত ভয়ের অনুভূতিও। এ জন্য রইল পরামর্শ। সেই সঙ্গে জানানো হলো বিশেষ কিছু সতর্কতাও।
শিশুর খাওয়াদাওয়া
 ছয় মাস পর্যন্ত যেকোনো শিশুর খাবার শুধুই মায়ের বুকের দুধ। এ সময় বাইরের কোনো খাবার তো নয়ই, পানিওখাওয়ানোর প্রয়োজন পড়ে না শিশুকে।
 বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব না হলে বাটিতে দুধ নিয়ে চামচ দিয়ে খাওয়ান। প্রতিবার ব্যবহারের আগে বাটি ও চামচ ফুটন্ত পানিতে ধুয়ে নিন।
 প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর শিশুকে দুধ খাওয়াতে পারেন। যদি শিশুটি ঘুমিয়ে পড়ে, জোর করে জাগিয়ে খাওয়াবেন না।
শিশুর জামাকাপড়
 সুতির হাল্কা রঙের পাতলা জামা শিশুর জন্য আরামদায়ক। এতে শিশুর ত্বকে ইনফেকশনের আশঙ্কা থাকে না।
 শিশুকে বোতামযুক্ত জামার বদলে ফিতাযুক্ত জামা পরান।
 পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে শিশুর জামা অ্যান্টিসেপটিক লোশনে ডুবিয়ে রাখা খুব একটা জরুরি নয়।
বরং প্রতিদিনের জামাকাপড়সাবান দিয়ে ধুয়ে ভালো করেরোদে শুকিয়ে নিন।
শিশুর গোসল
 শিশুকে নিয়মিত গোসল করান। চিকিৎসক পরামর্শ না দিলে গোসল বন্ধ করবেন না।
 খুব শীত পড়লে বা অতিরিক্ত ভেজা আবহাওয়ায় অবশ্য গোসল না করিয়ে মাথাধুইয়ে নরম কাপড় ভিজিয়ে গামুছে দিতে পারেন।
 শিশুর জন্য বিশেষভাবে তৈরি কম ক্ষারযুক্ত সাবান, তেল, শ্যাম্পুই ব্যবহার করুন। সাবান কেনার সময় তার পিএইচ লেভেল চেক করে নিন। এই লেভেল সাতের নিচে থাকলেই ভালো।
 চাইলে শিশুকে তেল মাখাতে পারেন। তবে খুব গরমে বা অত্যন্ত আর্দ্র আবহাওয়ায় তেল মাখানো উচিত নয়।
শিশুর শোয়া
 মাথার গড়ন যাতে ঠিক হয়, এ কারণে ছোটদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি বালিশ ছাড়া অন্য বালিশ ব্যবহার করবেন না।
 সব সময় কোনো বিশেষ দিক করেই শোয়া স্বাস্থ্যকর নয়। ঘুমানো অবস্থায় শিশুকে মাঝেমধ্যে এপাশ-ওপাশ করুন।
 শিশুকে উপুড় করে শোয়াবেন না। নিঃশ্বাসের অসুবিধা হতে পারে।
শিশুর ঘুম
 ঘরে কথা বললে, কাজ করলে শিশুর ঘুমের ব্যাঘাত হবে—এমন ভাববেন না। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ঘুমানোর অভ্যাস করালে পরবর্তীকালে ঘুমের সমস্যা কম হবে। ঘরে হালকাকরে গানও চালিয়ে রাখতে পারেন।
 শিশুকে বিছানায় ঘুমানোর অভ্যাস করান, না হলে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় শোয়ালেই ঘুম ভেঙে যাবে।সব শিশুই প্রয়োজনমতো ঘুমিয়ে নেয়। তাই সে যতক্ষণ ঘুমায়, ঘুমাতে দিন।
 শরীর খারাপ থাকলে, বিশেষ করে শিশুর পেটে ব্যথা হলে ঘুমের সমস্যা হয়। তখন শিশুকে কোলে নিয়েকাঁধে মাথা রেখে ঘুম পাড়ালে আরাম পায়।
শিশুকে কোলে নেওয়া
 কোলে নেওয়ার সময় বা খাওয়ানোর সময় আপনার একটা হাত শিশুর পিঠের তলায় শিরদাঁড়া বরাবর রাখুন।
 শিশুর ঘাড় যত দিন না শক্ত হয়, তত দিন পর্যন্ত কোলে নেওয়ার সময় অবশ্যই ঘাড়ের তলায় হাত দিয়ে রাখুন।
 সাধারণত শিশুকে কোলে নেওয়ার সময় বুকের ওপর নিয়ে মাথাটা কাঁধে রাখা হয়। তবে ভালো হয়, শিশুকে কোমরে করে কোলে নিলে, চলতি কথায় যাকে ‘কাঁখে’ নেওয়া বলে। এতে মায়ের কোমরের দুই পাশ দিয়ে শিশুর দুটো পা থাকে। এতে শিশুর কোমর ও সংলগ্ন অংশের গড়নে বেশ কিছু উপকার পাওয়া যায়।
শিশুর অসুস্থতার লক্ষণ
নবজাতকের শরীর অসুস্থ কি না, তা বোঝার জন্য কতগুলোসাধারণ লক্ষণ জেনে রাখুন। এ জাতীয় লক্ষণ দেখলেই বুঝতে পারবেন, সে কোনো অসুবিধার মধ্যে আছে কি না এবং সে অনুযায়ী বিশেষজ্ঞের পরামর্শও নিতে পারেন।
 খেয়াল করুন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার শিশুর ওজন ঠিকমতো বাড়ছে কি না।
 শিশুর প্রস্রাব নিয়মিত থাকা খুব জরুরি। নবজাতকের ক্ষেত্রে দিনে অন্তত ছয়বার প্রস্রাব হওয়া স্বাস্থ্যকর। পায়খানা অবশ্য দিনে বেশ কয়েকবার হতে পারে।
 শিশুকে দেখে যদি সুস্থ না মনে হয়, টোকা মারলে যদি না কাঁদে, ঝিমিয়ে থাকে, হাতের চেটো আর পায়ের তলা হলুদ হয়ে যায় বা অল্প খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে শিশু অসুস্থ বলে ধরে নেওয়া যায়।
 পেটে ব্যথা হলে অনেক শিশুই কী করবে, বুঝতে না পেরে বারবার খেতে চায়। খিদে না থাকায় অল্প খেয়েইশুয়ে পড়ে। শুলেই আবার পেটে ব্যথা শুরু হয়। এ রকম লক্ষণ দেখলেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
শিশুর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি
 শিশুর সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক তৈরির সহজ উপায় হলো তার সঙ্গে সময় কাটানো। দিনের যতটা সময় পারেন আপনার শিশুর সঙ্গে কাটান।
 শিশুকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, গোসল করানো যতটা সম্ভব নিজে করুন।
 শিশুর সঙ্গে মা ও পরিবারের অন্যরা যত মিশবেন, ততই শিশু হাসিখুশি ও মিশুক হবে। এ রকম পরিবেশে অনেক শিশুরই প্রাথমিক পর্যায়ে বৃদ্ধিভালো হয়।
বিশেষ সতর্কতা
 শিশুকে ধরার আগে সব সময়হাত ধুয়ে নিন। এ সময় ভালোমানের সাবান ব্যবহার করুন।
 নবজাতককে কোলে নেওয়ার সময় মায়ের হাতে আংটি বা চুড়ি না থাকলেই ভালো। কারণ, এগুলোয় জমে থাকা ময়লা থেকে শিশুর শরীরে ইনফেকশনের আশঙ্কা থাকে; কেটেও যেতে পারে।
শিশুর ঘর, আসবাব, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়সহ অন্য সামগ্রী নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
কর্মজীবী মায়েদের জন্য
কর্মজীবী মায়েরা যত দিন সম্ভব, তত দিন মাতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়ার চেষ্টা করুন। প্রতিদিন বের হওয়ার আগে এবং বাড়ি ফিরে নিয়ম করে অবশ্যই ওকে বুকের দুধ খাওয়ান। এতে শিশু প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবে।
বাইরে বের হওয়ার আগে বুকের দুধ এক্সপ্রেস করে একটা পরিষ্কার বাটিতে রেখে যেতে পারেন। আপনার অনুপস্থিতিতে এই দুধ আপনার শিশু অনায়াসে খেতে পারবে। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ছয় ঘণ্টা আর রেফ্রিজারেটরে রাখলে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত এই দুধ ব্যবহারযোগ্য। ফোটানোরও কোনো প্রয়োজন নেই। বিকল্প হিসেবে প্রয়োজনে শিশুকে কৌটার দুধ খাওয়াতে পারেন। তবে ফিডারে করে নয়, অবশ্যই বাটি-চামচ ব্যবহার করে।
শিশুকে বুকের দুধ পান করানো নিয়ে কোনো রকম সংশয়রাখবেন না। বুকের দুধ শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় ইমিউনিটি গড়ে তোলে। পাশাপাশি মায়েরাও বেশ কিছু উপকার পান।
গর্ভাবস্থায় মহিলাদের শরীরে যে ফ্যাট জমে, বুকের দুধ পান করানোর সময়তা অনেকটাই বেরিয়ে যায়। ফলে পোস্ট প্রেগনেন্সি স্টেজে মহিলাদের পক্ষে শরীর ঠিক রাখাও বেশ সহজ হয়। মুটিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কমে।

কোন মন্তব্য নেই :