খাটো হলেই সমস্যা নয়

কোন মন্তব্য নেই
১১ বছর বয়সে গ্রোথ হরমোনের অভাবজনিত খর্বাকৃতি জটিলতায় আক্রান্ত হন লিওনেল মেসি। খেলোয়াড় জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। কিন্তু বার্সেলোনার স্পোর্টিং ডিরেক্টর কার্লস রিক্সাচ মেসির মধ্যে দেখেছিলেনঅমিত সম্ভাবনা। কিশোর মেসির সব চিকিৎসার ব্যয়ভার গ্রহণ করেদলটি, শর্ত থাকে যে মেসি আর্জেন্টিনায় নিজের দল ছেড়ে চলে আসবেন ইউরোপে। আজ সবাই জানে, কার্লসের চোখ ভুল করেনি।
এখনো বাংলাদেশে খর্বাকৃতি বা বামনাকৃতি মানুষকে তামাশার পাত্র হিসেবে দেখা হয়। সার্কাস বা যাত্রাপালায় ব্যবহার করা হয় অন্যের মনোরঞ্জনের উদ্দেশে। কিন্তু বিশ্বে খর্বাকৃতি মানুষেরা যথাযথ চিকিৎসার পর প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছে। বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি নিজেই বাল্যকালে এ সমস্যায় ভুগেছিলেন।
বয়সের তুলনায় অপ্রত্যাশিত কম উচ্চতাসম্পন্ন (খাটো আকৃতি) মানুষকে বামন বলা হয়। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের রোগীরা সময়মতো রোগ নির্ণয় করে এর চিকিৎসা নিলেও বাংলাদেশে জনসচেতনতার অভাবে অনেক অভিভাবক জানতেই পারেন না যে তাঁর সন্তান গ্রোথ হরমোনের অভাবে খর্বাকৃতি (খাটো) রোগে ভুগছে। ফলে শিশুটিতার সমবয়সীদের তুলনায় শারীরিকভাবে আর বাড়তে পারে না অথবা খাটো থেকে যায়, যা থেকে সে হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এসব রোগী এমন বয়সে এসে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় যখন চিকিৎসা নিয়েও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না।
গ্রোথ হরমোন কী
গ্রোথ হরমোন তৈরি হয় মানুষের মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের সোমাট্রোপ কোষ থেকে। গ্রোথ হরমোন শরীরের উচ্চতা বৃদ্ধি, কোষ বিভাজন এবং নতুন কোষ তৈরিতে উদ্দীপনা জোগায়। এ হরমোনের অভাব ঘটলে শারীরিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। প্রাকৃতিকভাবে মানুষের শরীরে যে গ্রোথ হরমোন তৈরি হয় তাকে সোমাটোট্রপিন এবং রিকমবিন্যান্ট ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি গ্রোথহরমোনকে সোমাট্রপিন বলে। সোমাটপিন একটি প্রোটিন সমন্বয়েতৈরি পেপটাইড হরমোন, যা বিগত প্রায় ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই গ্রোথ হরমোনের অভাবের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
অন্যান্য প্রোটিন হরমোনের মতো গ্রোথ হরমোন কোষের নির্দিষ্ট গ্রাহক বা রিসেপ্টরের ওপর কাজ করে। সরাসরি কোষ বিভাজনের মাধ্যমে তরুণাস্থির বৃদ্ধি ঘটায়। এ ছাড়া গ্রোথ হরমোন ইনসুলিনের মতো গ্রোথ ফ্যাক্টর ১ (আইজিএফ-১) তৈরিতে উদ্দীপনা জোগায়। আইজিএফ-১ শরীরের বিভিন্ন কলায় (টিস্যু) বৃদ্ধির উদ্দীপনা ঘটায়, বিশেষ করে অস্থি(হাড়) এবং তরুণাস্থির কোষের ওপর(হাড়) এবং তরুণাস্থির কোষের ওপরকাজ করে অস্থির বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
এ ছাড়া এই হরমোন ক্যালসিয়াম ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে হাড়কে মজবুতকরে এবং সোডিয়াম ও পটাশিয়াম ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে খনিজ পদার্থের পরিমাণ বাড়ায়। শরীরে মাংসপেশির পরিমাণ বাড়ায় ও চর্বি ভেঙে ফেলে। প্রোটিন তৈরিকরে কোষের বৃদ্ধি ঘটায়। মগজ ব্যতীত সব অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি ঘটায়। প্রাপ্তবয়স্কদের মস্তিষ্কের প্রতিনিয়ত ক্ষয় ও কার্যকারিতায় বিশেষ ভূমিকা রাখে এটি।
গ্রোথ হরমোনের অভাবের কারণ
পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে স্বল্প পরিমাণে অথবা একেবারেই গ্রোথ হরমোন নিঃসৃত না হওয়া। এ অবস্থা জন্মের সময় থেকে অথবা জন্মের পর হতে পারে, যেমন অস্বাভাবিক পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে চাহিদার তুলনায়কম পরিমাণে গ্রোথ হরমোন তৈরি হয়। এ ছাড়া মস্তিষ্কের সংক্রমণটিউমার, ক্ষত, পিটুইটারি এলাকায়অস্ত্রোপচার, রেডিয়েশন ইত্যাদির কারণেও হরমোনের অভাব দেখা দিতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই গ্রোথ হরমোনের অভাবের কারণ খুঁজে নাও পাওয়া যেতে পারে। মাতৃগর্ভে থাকাকালেহরমোন কম নিঃসৃত হওয়ায় কোষ সঠিকভাবে তৈরি না হলে পরবর্তী জীবনে পিটুইটারি গ্রন্থি সংকুচিত হয়। হঠাৎ অত্যধিক রক্তক্ষরণ হলে গ্রোথ হরমোন কমেযেতে পারে।
কিছু রোগে গ্রোথ হরমোনের কার্যকারিতা কমে যায়, যেমন টারনার সিনড্রম, প্রাডার উইলি সিনড্রম যেসব শিশু গর্ভকাল পূর্ণ না করেই জন্মে, ইডিওপ্যাথিক শর্ট স্ট্যাচু (অজানা কারণে খাটো আকৃতি), বংশগত কারণ এবং কিডনির অকার্যকারিতা।
গ্রোথ হরমোনের অভাব হলে যেসব শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় তা হলো উচ্চতায় খাটো, বয়সের তুলনায়ধীরগতিতে উচ্চতা বৃদ্ধি, কোমরের আশপাশে চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি, সমবয়সীদের তুলনায় ছোট দেখানো, দাঁতের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তি বিলম্বিত হওয়া, বিলম্বিত বয়ঃসন্ধিকাল, কাজকর্মে, ব্যায়াম করার সময় শক্তি না পাওয়া, মাংসপেশির বৃদ্ধি না হওয়া, হীনম্মন্যতায় ভোগা, পাতলা এবং শুষ্ক চামড়া। এসব কারণে দেখা দেয় কিছু সামাজিক সমস্যাও। যেমন হীনম্মন্যতা, বিয়ে না হওয়া, চাকরিতে সমস্যা, মানসিক অশান্তি, কটূক্তি-টিপ্পনী শোনা।
প্রাপ্তবয়স্কদের শরীরে গ্রোথ হরমোনের অভাবে কিছু সমস্যা দেখা যায়, যেমন শারীরবৃত্তীয় উপাদানের পরিবর্তন, শরীরের (বিশেষ করে কোমরের চারপাশে) চর্বির পরিমাণ বেড়ে যায়, মাংসপেশির শক্তি কমে যায়, ক্লান্তি ভর করে এবং যৌনক্ষমতাও ইচ্ছা কমে যায়। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়, চিন্তাশক্তি কমতে থাকে, অবসাদ পেয়ে বসে।রক্তের কোলেস্টেরলেরপরিবর্তন ঘটে। এলডিএলের পরিমাণএইচডিএলের পরিমাণের চেয়ে বেড়ে যায়। এ ছাড়া রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা কিনা রক্তনালি বন্ধ করে দিতে পারে। গরম ও ঠান্ডা উভয়ই বেশি পরিমাণে অনুভূত হয়।
শক্তি, উদ্যম কমে যায়। হাড়ের খনিজের পরিমাণ কমে যায়। জীবনযাত্রার মান কমে যায় (কর্মোদ্দীপনা কমিয়ে দেয়, অনুভূতির মাত্রা বাড়িয়ে খিটমিটে করে তোলে এবং একাকিত্ববাড়িয়ে দেয়)। হৃদরোগের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।
কীভাবে সমস্যাগুলো নিরূপণ করা যায়
এখানে হরমোন বিশেষজ্ঞ ও শিশু বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন চিকিৎসক বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। তবেচিকিৎসায় ভালো ফল পেতে হলে যত অল্প বয়সে চিকিৎসকের কাছে আসা যায়, ততই ভালো। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ হরমোন বিশেষজ্ঞ মায়ের গর্ভাশয় থেকে বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত বিস্তারিত ইতিহাস নিয়েথাকেন। শারীরিক পরীক্ষা, হাড়ের বয়স নির্ধারণ ইত্যাদির মাধ্যমেসিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন কীভাবে এবং কী ধরনের হরমোন পরীক্ষা করা দরকার। সর্বোপরি কোন কোন পরিস্থিতিতে হরমোন নিলে সর্বোচ্চ উপকার হবে তা বিশদ আলোচনা করে চিকিৎসায় হাত দিতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই :