সন্তানহীনতাঃ বন্ধ্যা পুরুষ

কোন মন্তব্য নেই
ডা. বশির আহমেদ তুষার
সন্তান জন্মদানের অক্ষমতা বোঝাতে ‘বন্ধ্যা’ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়। অক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে একজন পুরুষও যে জড়িত থাকতে পারে সেটা সামাজিকভাবে মনে করা হয় না। এদেশে আজও সন্তানদানে অক্ষমতার জন্য মুখ্যত স্ত্রীকেই হেনস্তা হতে হয় পদে পদে, প্রকাশ্যে আড়ালে। অথচ প্রকৃত তথ্য হলো অক্ষম দম্পতির শতকরা ৫০ ভাগ দায় পুরুষের ওপর বর্তায়। কমবেশি এ হিসাবেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। বন্ধ্যাত্ব এমনই এক শারীরিক অপূর্ণতা যা পুরুষ-নারী যে কাউকেই নিষ্ফল করে রাখতে পারে। পুরুষের অক্ষমতার নানা কারণ রয়েছে। আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে একে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছিঃ
১. প্রি-টেস্টিকুলার
২. টেস্টিকুলার
৩. পোস্ট টেস্টিকুলার
প্রি-টেস্টিকুলার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মস্তিষ্ক থেকে বীর্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদানের অক্ষমতা যেমনহাইপোথেলামাস থেকে একান্ত প্রয়োজনীয় গোনাডোট্রফিন, লিউটিনাইজিং হরমোন কিংবা ফলিকুল স্টিমুলেটিং হরমোনের ঘাটতি। এসব হরমোনের প্রভাব ছাড়া অণ্ডকোষ কিছুতেই ভালোভাবেবীর্য তৈরি করতে পারে না। পিটুইটারি নামের আরেক জরুরি গ্রন্থি রয়েছে মস্তিষ্কে, যার অপর্যাপ্ত কার্যক্ষমতার জন্য বা প্রলেকটিনের মাত্রা বেশি হওয়ার জন্যে অণ্ডকোষের উৎপাদন মাত্রা হ্রাস বা নষ্ট হতে পারে।
স্বয়ং অণ্ডকোষের ত্রুটির কারণেবীর্য তৈরি বিঘ্নিত হয়। এটাকে টেস্টিকুলার কারণ বলা হয়। নানাবিষয়ের মধ্যে ক্রোমোজমের ত্রুটির কারণ এবং জন্মগত ত্রুটি অণ্ডকোষের প্রজনন ক্ষমতা বিনষ্ট করতে পারে। নানারোগের জন্য আমরা যে ওষুধ খাই তাঅনেককে পূর্ণ বন্ধ্যা-পুরুষে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারে। সাধারণ পেটের আলসারের চিকিৎসায়ব্যবহৃত সিমিটিডিন, চর্মরোগে বহুল ব্যবহৃত কেটাকোনাজল, ক্যান্সারে ব্যবহৃত কিছু ওষুধপত্র, নেশার জন্য ব্যবহৃত মারিজুয়ানা, হিরোইন অণ্ডকোষের বীর্য তৈরির মাত্রা বিনষ্ট করেফেলতে পারে পুরোপুরি। গনোরিয়াসহ নানা যৌনরোগও সন্তান উৎপাদনক্ষমতা নষ্ট হওয়ার জন্য দায়ী। এর মধ্যে কেমোডিয়া নামের যৌনবাহিত জীবাণুর প্রকোপের যথার্থ চিকিৎসার ফলে নিষ্ফল দম্পতি সন্তান লাভ করেছেন এমন তথ্য অনেক। এ ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে নানা ওষুধ প্রয়োগে আমি নিজেও সন্তোষজনক ফল পেয়েছি।
মাম্পস নামের এক ভাইরাসজনিত অণ্ডকোষের প্রদাহের কারণে, অণ্ডকোষের আঘাত, ভেরিকোসিল ইত্যাদি কারণে পুরুষের বীর্য উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হতে পারে।পোস্ট-টেস্টিকুলার কারণের মধ্যে রয়েছে জন্মগত ত্রুটি যেমন ভাস-ডিফারেন্স, সেমিনাল ভেসিকেল, ইপিডিডাইমিসের আঙ্গিকে ত্রুটি। নানা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়, কিংবা নানা কারণে যৌন অক্ষমতার ফলে পুরুষ সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয়ে পড়ে । তাছাড়া উৎপাদিত বীর্য ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে, অপর্যাপ্ত হতে পারে, কিংবা বীর্যের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি গড়ে উঠে বীর্যের কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। নানা রকম চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে বন্ধ্যা পুরুষকে সক্ষম করে তোলা অনেকাংশে সম্ভব হয়ে উঠেছে। মূলত পুরুষ বন্ধ্যাত্বের জন্য চার রকম চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছেঃ
১. মেডিসিন প্রয়োগজনিত চিকিৎসা
২. শল্য চিকিৎসা
৩. বীর্যের মান উন্নয়নের নানা ব্যবস্থা
৪. অ্যাসিসট্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনিক (এআরটি)
ক. হরমোনজনিত ত্রুটির সমাধান করা যেমন লিউটিনাইজিং হরমোন, কোরিওনিক গোনাডোট্রফিন ইত্যাদির প্রয়োগ। এদেশেও বর্তমানে এই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগ করা হচ্ছে। বর্তমানে এদেশে এসব উন্নতমানেরওষুধ পাওয়া যায়।
খ. বীর্যের বিরুদ্ধে অ্যান্টিস্পার্ম অ্যান্টিবডিরনিরসনের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বীর্যে বা রক্তে অ্যান্টিস্পার্ম অ্যান্টিবডিরপ্রকোপের পরিমাণ অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে এদেশেই নির্ণয় করা হচ্ছে। ফলে যথার্থ চিকিৎসা প্রয়োগও সম্ভব হচ্ছে।
শল্য চিকিৎসায় মুখ্যত ভেরিকোসিল রিপিয়ার করা এবং অণ্ডকোষ থেকে বীর্য প্রবাহের পথ রুদ্ধ হলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এর বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণই প্রধান।
নানা কারণে বীর্য নির্ধারিত পথে প্রবাহিত না হয়ে উল্টোপথে মূত্রথলিতে চলে যায়, ফলে স্বাভাবিক বীর্যপাত হয় না। প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রয়োগ করে তা পুনরায় সঠিক পথে প্রবাহিত করা যায়।
প্রস্টেটগ্রন্থিতে যৌনরোগের জীবাণু বাসা বাঁধলে বীর্যের মটিলিটি বা নড়াচড়ার মাত্রা খুবকমে যায়। ফলে পুরুষ নিষ্ফল হয়ে পড়ে। এ জন্য পুরুষের বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় যৌনব্যাধি বিশেষজ্ঞের পরামর্শও একান্ত প্রয়োজন। কিছুওষুধ যেমন ক্লামিফেন (অ্যান্টিঅ্যান্ড্রোজেন), ব্রোমোক্রিপটিন (অ্যান্টিপ্রলেকটিন), আরজিনিন, থাইরয়েড, স্টেরয়েড ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসবের সঠিকপ্রয়োগ বহু বন্ধ্যা পুরুষের জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছে।যে সকল ক্ষেত্রে শল্য কিংবা মেডিকেল চিকিৎসা কাজে আসেনি সেখানে অ্যাসিসট্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনিক বা ‘এআরটি’র সাহায্য নেয়া হচ্ছে। মাত্র কয় বছর আগে এটা ভাবাই যেতনা। নানা পদ্ধতির মধ্যে মুখ্যতএকটি হলো আরটিফিসিয়াল ইনসেমিনেসন বাই হাসবেন্ড আর অন্যটি হলো বাই ডোনার। স্বামীরবীর্য, জরায়ুর মুখ অতিক্রম করে ভেতরে...। আধুনিক পদ্ধতি যেমন GIFT, IFT, ZIFT, EIFT এসবে সফলতা আরো বেশি। তবে এ ধরনের চিকিৎসা কিছুটা ব্যয়বহুল এবং জটিল।
যেখানে প্রচলিত পদ্ধতি কাজ করেনা বা স্বামীর বীর্যে সন্তান উৎপাদনের জন্য একান্ত প্রয়োজন শুক্রাণু পাওয়া যাচ্ছে না বা খুবই কম পাওয়া যাচ্ছে তাদের জন্যও উন্নততর কিছু পদ্ধতি আবিষকৃত হয়েছে। অণ্ডকোষ থেকে TESA, TESE ইত্যাদি পদ্ধতির মাধ্যমে বীর্য সংগ্রহ করে ওঈঝওবা ICSI ev Lutracytoplosmic sperm injection- এর মাধ্যমে স্ত্রীকে গর্ভবতী করা সম্ভব হচ্ছে। এসব অত্যাধুনিক ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি প্রতিদিনই বন্ধ্যা পুরুষের জীবনে অমিত সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে।
লেখকঃ গবেষক, ফিমেল সেক্সুয়াল মেডিসিন
আজমিরীগঞ্জ পৌরসভা, হবিগঞ্জ
ফোনঃ ০১৭১৭-০৫৩৫৭৭

কোন মন্তব্য নেই :