উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে করণীয়

কোন মন্তব্য নেই
ডা. এম শমশের আলী
আমাদের শরীরে রক্তনালির মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালিত হয়ে থাকে। রক্ত প্রতিটি দেহকোষে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং দেহকোষ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ অপসারণ করে থাকে। সুতরাং দেহে সার্বক্ষণিকভাবে রক্তপ্রবাহ নির্দিষ্ট করা খুব জরুরি। হার্ট প্রতিবার সংকোচনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্তরক্তনালিতে সঞ্চালন করে। হার্টের এ রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে রক্তনালিতে চাপ উৎপন্নহয়। এ চাপের ধারায় সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালিত হয়ে থাকে। রক্তনালির ভেতরে এ চাপকে ব্লাডপ্রেসার বলা হয়। রক্তনালিগুলোর চাপ ধারণের একটানির্দিষ্ট ক্ষমতা থাকে এবং সুষ্ঠু রক্তপ্রবাহের জন্য একটিনির্দিষ্ট পরিমাণ চাপের প্রয়োজন স্বাভাবিক-এ দুয়ের সমন্বয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা রক্তচাপের একটি স্বাভাবিক মাত্রা নির্ধারণ করেছে এবং দেখা যাচ্ছে, সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের শরীরে রক্তচাপ পরিলক্ষিত হয়, যার পরিমাণ ১৪০/৯০ অথবা তার নিচে, তবে অবশ্যই ৯০/৬০-এর নিচে নয়। রক্তচাপ সৃষ্টির জন্য দুটি উপাত্ত কাজ করে থাকে-একটি হলো হার্টের পাম্পিং পাওয়ার এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে রক্তনালির স্থিতিস্থাপকতা। যেকোনো কারণে স্বাভাবিক রক্তচাপের চেয়ে বেশিরক্তচাপ থাকাকে উচ্চরক্তচাপ বলে।
উচ্চরক্তচাপের কারণ
শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে উচ্চরক্তচাপের সঠিক কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এ ধরনের উচ্চচাপকে প্রাইমারি হাইপারটেনশন বলে। মাত্র ৫ ভাগ রোগীর রক্তচাপের কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়, যার জন্য এসব উচ্চরক্তচাপকে সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন বলে। যদিও প্রাইমারি হাইপারটেনশনের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা যায়নি। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিভিন্ন ধরনের গবেষণার মাধ্যমে বেশ কিছু বিষয়কে উচ্চরক্তচাপের কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে যেমন অধিক লবণ গ্রহণ করা, ধূমপান করা, কায়িক শ্রমের অভাব, শারীরিক ও মানসিক টেনশন, খুব বেশি তৈলাক্ত খাবার গ্রহণ করা, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকা, বংশগত প্রবণতা, রক্তের চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া এবং ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়া।
উপসর্গ
উচ্চরক্তচাপকে নীরব ঘাতক বলা হয়। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো রকম শারীরিক উপসর্গ ছাড়াইরক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। রোগীরা রক্তচাপের জটিলতা হওয়ারআগ পর্যন্ত বুঝতেই পারেন না তারা উচ্চরক্তচাপে ভুগছেন। তাই৩০ বছর বয়স পার হওয়ার পরেই বছরেঅন্তত একবার আপনার রক্তচাপ মেপে নিন।
কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থা থেকেই উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে। উপসর্গগুলো হলো- বুক ব্যথা করা,সহজে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, অল্প পরিশ্রমে ক্লান্তি অনুভব করা, অনিদ্রা হওয়া, পরিশ্রমে বুকে ব্যথা হওয়া অন্যতম। আরও কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন পা ফুলে যাওয়া, চোখের দৃষ্টি কমে যাওয়া, মাথা ঘোরানো,অস্থিরতা, সহজে শরীর অত্যধিক ভেঙে যাওয়া, গরম এবং ঠান্ডা সহ্য করার প্রবণতা কমে যাওয়া।
জটিলতা
*. অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ বহুবিধ জটিলতা সৃষ্টি করে থাকে যেমন-
*. কিডনি ফেইলিউর
*. হার্ট ফেইলিউর
*. ইসকেমিক হার্ট ডিজিড (হূৎপিণ্ডের রক্তনালির অসুখ)
*. ব্রেইন স্ট্রোক
*. অন্ধ হয়ে যাওয়া অথবা চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া
*. হার্টঅ্যাটাক বা স্ট্রোক
*. হূৎপিণ্ডের স্পন্দন বন্ধ হয়েহার্ট অ্যারেস্ট হয়ে তাৎক্ষণিক মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
রক্তচাপের তীব্রতার কারণ নির্ণয় এবং জটিলতা দেখা ও সঠিক চিকিৎসাব্যবস্থার জন্য বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন হতে পারে। যেমন- ইসিজি,বুকের এক্স-রে, রক্তে শর্করার পরিমাণ/ব্লাড সুগার, রক্তের কোলেস্টেরল/চর্বির মাত্রা (লিপিড প্রোফাইল), সিরাম ক্রিয়েটিনিন, আল্ট্রসনোগ্রাফি,ইকো কার্ডিওগ্রাম, ক্ষেত্রবিশেষে থাইরয়েড হরমোন টেস্ট, রক্তের কর্টিসল ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা লাগতে পারে।
চিকিৎসা
খাদ্যের মাধ্যমে খুব কম লবণ গ্রহণ করা। শারীরিক ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখা, কায়িক শ্রম করা, ক্ষেত্রবিশেষে ব্যায়াম করা। ডায়াবেটিস থাকলে নিয়ন্ত্রণে রাখা, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা, কিডনি সমস্যা থাকলে সুচিকিৎসা গ্রহণ করা, কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত পরীক্ষা করে রোগের অবস্থান নির্ণয় করে সঠিকমাত্রার ওষুধ গ্রহণ করা। এখানেবলে রাখা ভালো, উচ্চরক্তচাপের চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে কোনো উপায়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা। আমরাপ্রায়ই লক্ষ করি, রোগী কিছুদিন ওষুধ গ্রহণ করার পর এবং খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা নিয়ন্ত্রণের পর অনেকে সেটা বন্ধ করে দেয়; ফলে উচ্চরক্তচাপের জটিলতাসহ রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকে।সুতরাং উচ্চ রক্তচাপ দীর্ঘ সময়ধরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা উচ্চরক্তচাপ চিকিৎসার একটি বড় লক্ষ্য। প্রচুর শাকসবজি খেতে হবে। চর্বিজাতীয় খাবার বিশেষ করে চর্বিযুক্ত মাংস বর্জন করা। কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার বর্জন করা। খাবারের মাধ্যমে শারীরিক ওজন নিয়ন্ত্রণ করা (ভাত, আলু, রুটি, চিনি, মিষ্টি) গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে আনা।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, হূদরোগ বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

কোন মন্তব্য নেই :