আপনার কন্যাশিশুটিকে মানুষ করুন

কোন মন্তব্য নেই

ফারহানা একদিন হন্তদন্ত হয়ে অফিসে ঢুকতে ঢুকতে আমাকে বসে থাকতে দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আপা, আপনার কথাই মনে করছিলাম’।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি উদ্দেশ্যে?’
সে ব্যাগ, খাবার গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলতে শুরু করল, ‘আজকে বাজারে দেখলাম বিকিনি বিক্রি করছে...’
কিছুক্ষণ আমার কোন শব্দ না পেয়ে চকিতে আমার দিকে তাকিয়ে আমার বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে থাকা দেখে সে হো হো করে হেসে ফেলল, ‘না আপা, আপনি ভয় পেয়েন না!বাজারে দেখলাম ছোট ছোট বাচ্চা মেয়েদের বিকিনি বিক্রি হচ্ছে, এত্ত আদর লাগছে! আমার তো মেয়ে নেই, আমার ভাইয়ের মেয়েটার জন্য কিনতে চাচ্ছিলাম। ওর মাত্র দেড়বছর বয়স। কিন্তু নিতে গিয়ে হঠাৎ আপনার কথা মনে হোল। ভাবলাম আগে আপনার কাছে পরামর্শনেই’।
বান্ধবীদের এই ভালবাসা আর বিশ্বাস আমাকে খুব স্পর্শ করে।সম্পর্ক যখন বিশ্বাসের শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় তখন অনেক কথাই খোলাখুলি বলা যায় যা অনেকে একসাথে পঞ্চাশ বছর সংসারকরেও পরস্পরকে বলতে পারেনা।
ফারহানা অত্যন্ত রুচিশীল এবং সৌখিন একটা মেয়ে। ওকে বললাম, ‘তুমি আমার কাছে জানতে চেয়েছ এতে আমি অভিভূত। কিন্তু তুমি তো জানোই আমি কাউকে খুশী করার জন্য কথা বলতে পারিনা, যা ঠিক মনে হয় সেটাই বলি...’
সে বলল, ‘আপা, এই জন্যই তো আপনার কাছে এলাম’।
আশ্বস্ত হয়ে বললাম, ‘দেখ, শিশুদের পর্দা নেই, তাই অনেক সময় আমরা শিশুদের উলঙ্গও রাখি।কিন্তু আমার কাছে মনে হয় উলঙ্গ থাকার চেয়ে খোলামেলা পোশাক পরাআরো ভয়ানক ব্যাপার। অভ্যাস এবংস্বভাব ছোটবেলা থেকেই তৈরী হয়।যে শিশুটি উলঙ্গ থাকে, সে বড় হতে হতে বুঝতে শেখে তার পোশাক পরা উচিত। কিন্তু যে শিশুটি ছোটবেলা থেকে খোলামেলা পোশাকে অভ্যস্ত হয় তার মধ্যে লজ্জার conceptটাই সৃষ্টি হয়না। বড় হয়েও সে বুঝতে পারেনা তার শরীরের কতটুকু ঢাকা উচিত বা কেন ঢাকা উচিত। তাই আমার মনে হয়বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই এমন পোশাক পরানো উচিত যা বড় হতে হতেতাকে শালীনতার মানদন্ড অনুযায়ীএকটি মার্জিত রুচি গড়ে তোলার প্রতি উৎসাহিত করবে’।
উদাহরণস্বরূপ বললাম- একবার ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা চলছে, পরিক্ষার্থীদের খাতাও দেয়া হয়েগেছে, প্রশ্ন দিতে যাব এমনসময় এক পুরুষ সহকর্মী এসে কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন যেন তাঁকে আমার কামরায় বসতে দিয়ে আমি ওনার রুমে ইনভিজিলেশন দেই। আমিততক্ষণে গুছিয়ে বসেছি, কিছুতেই যাবনা, কিন্তু উনি নাছোরবান্দা। বেচারার কাঁদো কাঁদো অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার রুমে সমস্যা কি?’উনি বললেন, ‘আপা, আমি আপনাকে কিছুতেই বলতে পারবনা। আপনি আমার রুমে গেলে যান, না গেলে না যান, আমি এই রুমে বসে গেলাম’। সময় নেই তর্ক করার, পরীক্ষা সময়মত শুরু করতে হবে। সহকর্মীরওপর বিরক্ত হলেও গেলাম ওনার রুমে, গিয়ে অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়লনা। গজর গজর করতে করতে পরীক্ষা শুরু করলাম। প্রায় পৌণে একঘন্টা পর, সবার খাতা সাইন করে চেয়ারে বসেছি, অমনি ধাঁ করে চোখে পড়ল সমস্যাটা। আমার নিজেরই প্রচন্ড লজ্জা করতে লাগল। কিন্তু যার লজ্জা লাগা উচিত তার কোন খবর নেই। একদম সামনের সীটে বসা মেয়েটার পরনে সাদা কামিজ, মাথায় সাদা ওড়না, কিন্তু পাজামাটা ভুলক্রমে ওড়নার কাপড় দিয়ে বানিয়ে ফেলেছে কিনা বুঝতে পারলাম না। স্বচ্ছ সাদা পাজামার ভেতর দিয়ে প্রতিটি লোমকূপ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, আজকাল আবার জামার পাশে কাটা এত ওপরে যে প্রায় কোমরের কাছটা পর্যন্ত পা দেখা যাচ্ছে। আমার জীবনের সবচেয়ে অসহনীয় ইনিভিজিলেশন শেষ করে ঐ সহকর্মীভাই এবং বেয়াক্কেল ছাত্রী উভয়কে মনে মনে গালি দিতে দিতে খাতা নিয়ে বের হলাম।
পরে একদিন সেন্ট্রাল প্লাজায় কাপড় কিনতে গিয়ে দোকানদার ভাইকে ইচ্ছামত ঝাড়লাম, ‘ভাই, আপনারা কি বুঝে এমন কাপড় আনেন? ছাত্রীগুলো আপনাদের কাছে এত দাম দিয়ে কাপড় কেনে অথচ এতে শরীর ঠিকমত ঢাকেনা- একদিকে পাতলা, আরেকদিকে টাইট, আরেকদিকেওড়না ছোট’। আমাকে নিরুত্তর করে দিয়ে উনি বললেন, ‘আপা, আমরা তো মার্কেটে যা পাওয়া যায় তাই আনি। কিন্তু এগুলো বিক্রি হচ্ছে দেখেই তো আমরা এর বিকল্প কিছু আনার প্রয়োজন বোধ করিনা। আমাদের কাপড় নাহয় পাতলা কিন্তুওরা কি দুইগজ কাপড় কিনে ভেতরে লাইনিং দিয়ে নিতে পারেনা? আপা, কাপড় যথেষ্টই থাকে, কিন্তু ওরাইতো ডিজাইন দেয় এমনভাবে যে দেখলে মনে হয় কাপড় কম পড়েছিল। আর খুচরা ওড়না তো পাওয়া যায় আপা, ম্যাচিং করে কিনে নিলে হয়।যদি রেডিমেড সেটের পরিবর্তে কাপড় কিনে জামা বানানো হয় তাহলে তো এই সমস্যাগুলোর কোনটাই হয়না। আমরা তো ব্যাবসায়ী আপা, আমরা তো তাই আনবযা বিক্রি হবে। কিন্তু মেয়েরা পোশাক পরার সময় চিন্তা করবেনা এতে কাপড় পরার উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে কিনা?’একদিন ননদিনিকে নিয়ে নিউ মার্কেট গেছি। ফালুদা খাবার জন্য লিবার্টিতে ঢুকলাম। আমাদের পাশের টেবিলে একটা পরিবার বসল। বাবা মা আর ছোট্ট একটা মেয়ে, বড়জোর তিন চারবছর বয়স হবে। বাচ্চাটা হিন্দি সিনেমার মত স্কার্ট আর টপ্স পরা, অর্থাৎ মধ্যাংশ মিসিং। আমিবলিনা একটি শিশুকে ছোটবেলা থেকে বোরকা পরিয়ে দেয়া হোক, কিন্তু স্বাভাবিক মার্জিত রুচিবোধ তো বাবামারই শিক্ষা দিতে হবে। এই শিশুটির কি আর কোনদিন অনুভূতি জন্মাবে যে উদরদেখাবার জিনিস নয় বরং food processing zone? সে কি শিখবে যে পোশাকের মানদন্ড হিন্দি সিনেমা নয় বরং শালীনতা?
এই শিক্ষা ছোটবেলা থেকে না দিলে এই বোধ আর কোনদিন জাগ্রত হয়না। যেমন, বাংলাদেশ ছেড়ে আসারআগে অল্প কিছুদিন আগে এক বিয়েবাড়ীতে গিয়ে একদঙ্গল মেয়ে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ওরা কেবল পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে চলে এসেছে! বিয়েবাড়ীর ঝলমলে আলোর বিপরীতে এই পোশাকের ভেতরটাও দৃষ্টি থেকে নিরাপদ নয়। ওদের দেখে আমার নিজেরই লজ্জা লাগছিল,কিন্তু বরের স্টেজের সামনে ওরালাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে, ওদের না ডিঙ্গিয়ে খাবার জায়গায় ঢুকতে পারছিনা।অনেক কাছে যাবার পর টের পেলাম ওদের সবার শাড়ি আছে। কিন্তু তা একেবারেই স্বচ্ছ এবংজালি জালি যে কারণে দূর থেকে বোঝা সম্ভব নয় যে ওরা শাড়ি পরেছে। এই পোশাকে ওরা বাবামা ভাইবোন, দুলাভাই এবং এক বিয়ে বাড়ী মেহমানের সামনে দাঁড়িয়ে হৈ হুল্লোড়, নাচানাচি, হাসাহাসিকরছে। ওদের দেখে আমাদের মেয়েদেরই লজ্জা লাগছে, অথচ ওদেরকোন অনুভতিই হচ্ছেনা!

এখানে ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাবা মা স্বাভাবিকভাবেই নিজের সন্তানকে সাজাতে ভালোবাসেন। নিজের কাছে সর্বোৎকৃষ্ট যা থাকে তাই দিয়ে তারা সন্তানদের প্রতিপালন করেন। তন্মধ্যে মেয়েশিশুদের সাজানোর প্রতি বাবামা আত্মীয়স্বজন সবার দুর্বলতা থাকে। আমি নিজেও এর ব্যাতিক্রম নই। আমার মেয়ে যখন ছোট ছিল আমি নিজে কাপড়, লেইস, বোতাম কিনে কেটেকুটে ডিজাইন করে ওর জন্য জামা বানাতাম। সে জামার দাম এমন আহামরি কিছু ছিলোনা, কিন্তু সে জামার ডুপ্লিকেটও কারো ছিলোনা। সে বুঝতে শিখেছিল মা ওর জন্য সবচেয়ে ভালোটাই চায়। এখন সে বড় হয়েছে, এখন সালওয়ার কামিজ, ফুলস্কার্ট, ট্রাউজার যেটাই পরে, বেছে বেছে সেরাটাই ওকে দিতে চেষ্টা করি- দামে নয়, আকৃতিতে। আমি আমার সন্তানকে এমন কাপড় পরানো সমীচীন মনে করিনা যেটা দেখে মনে হয় কাপড় কমপড়েছিল তাই একদিকে টাইট হয়ে গেছে, আরেকদিকে হাত পা ছোট ছোট হয়ে গেছে; এমন পাতলা কাপড় পরাতেচাইনা যাতে কাপড় পরার উদ্দেশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। স্কার্ফ কেনার কথা বললে যত চাই,যেটা চাই নীতি অবলম্বন করি। কন্যা গ্র্যাজুয়েশনের জন্য একটা ফ্রক কিনতে চাইল, ট্রাউজারদিয়ে পরবে। আমি ওকে চারখানা সালওয়ার কামিজ সেট কিনে দিলাম গ্র্যাজুয়েশনে পরার জন্য। কোন বাঁধা নয়, নিষেধ নয়, তর্ক বিতর্ক নয়- শুধু একটা better alternative দেয়া। পছন্দ সে নিজেই করেছে। এখানে আমি আহামরিকোন কষ্ট বা খরচ অথবা স্বৈরশাসন কোনটাই করিনি, শুধু কয়েকটি অপশনের মধ্যে সেরাটি গ্রহণ করার মত মানসিকতা সৃষ্টিকরার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছি।

এই সামান্য সময় বা শ্রমটুকু দেয়ার অভাবেই আমাদের অনেকের বিশেষ করে কন্যা সন্তানদের মাঝে রুচিবোধ, শালীনতার নৈতিক মানদন্ড বা স্বাভাবিক লজ্জাবোধপর্যন্ত গড়ে ওঠেনা। বিয়েবাড়ীর মেয়েগুলোর ব্যাপারটাই দেখুন, ওরা কিন্তু হালফ্যাশনের সবচেয়েদামী পোশাকগুলোই শুধুমাত্র বিয়ে উপলক্ষ্যে কিনেছে। সুতরাং, এটুকু নিশ্চিত হওয়া যায়যে ওদের বাবামা ওদের ভালবাসেন এবং ওদের ব্যাপারে কার্পন্য করেননা।

অভাব এটুকুই যে ছোটবেলা থেকে ওদের সাজসজ্জার মধ্যে বড় করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এর কোন নীতি বা সীমা নির্ধারন করে দেয়া হয়নি। ফলে ওরা টিভি, সিনেমা এবং ডিজাইনাররা যা নির্দেশ দেয় সে অনুসারেই চলে, নিজেদের কোন মানদন্ড বা creativity ওদের মাঝে সৃষ্টি হয়নি। আমরা বান্ধবীরা রেডিমেড সেটে কাপড় কম পড়লে আলাদা কাপড় বা লেইস দিয়ে ডিজাইন করে ফুলহাতা করা থেকে, ওড়না পাতলা হলে আলাদা ওড়না দিয়ে এমনভাবে ডিজাইন করে নিতাম যে সবাই মনে করত এটা কোন নতুন ফ্যাশন। স্বাভাবিক দামে কাপড় কিনলে কিছু বাড়তি টাকা খরচ করে পোশাকটিকে মানসম্মত বামনমত করে বানিয়ে নেয়া কোন কঠিন ব্যাপার নয়। কিন্তু শালীনতা ও রুচিবোধের পরিচয় দেয়ার জন্য এইকষ্টটুকুও অনেকে করতে চান না, ফলে অদ্ভুত সব জামাকাপড় পরেন যা তাদের বয়স বা সামাজিক মর্যাদার সাথে খাপ খায়না। তাহলে তাদের সন্তান কার কাছে রুচিশীলতা শিখবে?

আসুন,আমরা আমাদের কন্যা শিশুদের কেবল পুতুল না বানাই বরং তাদের মাঝে এই অনুভূতি সৃষ্টি করি যে তার ভাইটির মত সেও একজন intellectual human being, তার creativity এবং যোগ্যতাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগিয়ে তাকেএকটি নিজস্ব ব্যাক্তিসত্ত্বা গড়ে তোলার ব্যাপারে সহযোগিতা করি যেন সে মিস ইউনিভার্স হবার স্বপ্ন দেখার পরিবর্তে অ্যাস্ট্রোনট হবার স্বপ্ন দেখে, যেন সে মডেল হবার পরিবর্তে শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখে, যেন সে অভিনেত্রী হবার স্বপ্ন দেখার পরিবর্তে বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন দেখে, যেনসে পুতুল হবার পরিবর্তে মানুষ হবার স্বপ্ন দেখে- এই স্বপ্ন রচনা করার এবং সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে সাহায্য করার দায়িত্ব আপনার, আমার, সবার। আপনার কন্যা শিশুটিকে মূল্যায়নকরে তাকে গড়ে তুলুন একজন মার্জিত এবং পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে।



লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস। বোন তোমাকে হাজার সালাম জানাই। এই বিষয় টি সবাই শেয়ার করুন। অধঃপতনের হাত থেকে আমাদের বোনদের রক্ষা করুণ। আমাদের সমস্যা আমাদের কেই সমাধান করতে হবে। ব্লগার_সৈয়দ রুবেল।

কোন মন্তব্য নেই :